স্বাদশেকড় I পানকাহন
ভোজনের অনুষঙ্গ হিসেবে এটি বহু আগে থেকেই প্রচলিত। এর সঙ্গে দেওয়া হয় নানান সুগন্ধি মসলা। পশ্চাৎপটে রয়েছে অনেক কাহিনি
ইতিহাস বলে, পান ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার লতানো উদ্ভিদ। নারকেল, কলা, সুপারি, সাগু ইত্যাদি বৃক্ষের সঙ্গেই আদিকালে কোনো এক সময়ে চড়ে বসেছিল দক্ষিণ ভারতগামী জাহাজে। কারণ, তামিল ভাষায় এই গাছগুলোর নাম নির্দেশ করে- এরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ারই আদি বাসিন্দা। প্রমাণও দিয়েছেন ভাষাতাত্ত্বিকেরা। নাগা আদিবাসীরা এশিয়ার মধ্যভাগ থেকে প্রথমে দক্ষিণ ভারতে, তারপর সেখান থেকে পরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়া আর জাপান অব্দি পৌঁছে গিয়েছিল। তাদের হাত ধরেই পানের বিস্তার।
পান-সুপারির আদি নাম তাম্বুল আর গুম্বাক মুন্ডা ভাষার শব্দ; যা এই অঞ্চলে পাতাটি খাওয়ার প্রাচীনত্বকেই নির্দেশ করে। বাংলা পান এসেছে সংস্কৃত পর্ণ (পাতা) থেকে।
খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে বৌদ্ধ-জৈন সংস্কৃত সাহিত্য ও অপস্থম্বধম্মসূত্রে প্রথম পানের উল্লেখ পাওয়া গেছে। প্রাচীনতম সুপারি ও খয়ের গাছের সন্ধান মিলেছে শ্যামদেশের দশ হাজার থেকে সাত হাজার বছর আগেকার স্তরে। দাঁতে পানের দাগসহ একখানা খুলি মিলেছে ফিলিপাইনে, সেটার বয়স তিন হাজার বছর।
পান্ডবদের অশ্বমেধ যজ্ঞের পর ব্রাহ্মণ আর অতিথি বিদায়ের সময় দেখা গেল, পান নেই। সেটি খুঁজতে একদল গিয়ে পৌঁছল পাতালে। কুন্তীর পরদাদা ছিলেন নাগবংশীয়। অতিথিদের সম্মান রাখতে এক নাগরানি তার আঙুল কেটে দিয়ে সেটা রোপণ করতে বললেন (এ কারণেই পানের আরেক নাম নাগবল্লরী)। সেখান থেকেই উদ্ভিদটি জন্মায়, আর সেটি খেয়ে ব্রাহ্মণেরা বিদায় নিয়েছিল- এমনটাই জানা যায় মহাভারতে।
বলা হয়, মোটা দাগে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে পান জনসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ এই পাতা, কাটা সুপারি, সামান্য চুন আর খয়ের দিয়ে খেত। অভিজাতেরা তাতে কর্পূর, এলাচি, দারুচিনি ও লবঙ্গ দিত। ৬৭১-৯৫ সালে ভারতে আসা চৈনিক পর্যটক আই চিং লিখেছেন, খাওয়া শেষে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা পান খেতেন হজমের সুবিধার্থে, কফ আর মুখের দুর্গন্ধ কমাতে। দ্বাদশ শতাব্দীতে চালুক্য রাজ তৃতীয় সোমেশ^র তার লেখা মানসোল্লাসা বইয়ে লিখেছেন, খাওয়া শেষে রাজপুরুষ আর অভিজাতেরা মুখে পুরতেন এলাচি, লবঙ্গ, জায়ফল, জয়ত্রী ও কর্পূর মেশানো পঞ্চসুগন্ধিকা তাম্বুল। ১২৯৫ সালে গুজরাটে আসা মার্কো পোলোর ধারণা ছিল, এখানকার মানুষের সাদা ঝকঝকে মজবুত দাঁতের পেছনে রয়েছে পানের অবদান।
পেরিপ্লাস থেকে জানা যায়, খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে ভারতের পশ্চিম উপকূল থেকে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হতো পান। অর্থাৎ এই এলাকার মানুষ একলাই খায়নি এই পাতা, গোটা পৃথিবীকেও খাইয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবে ভারতবর্ষে বসতি স্থাপনকারী মুসলিমরাও এই হিন্দুস্তানি রীতিকে আপন করে নিয়েছিল। তার প্রমাণ মেলে ইবনে বতুতার লেখায়। চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের মাঝামাঝি দিল্লির কাজীদের সম্মানে অনুষ্ঠিত এক ভোজে তিনি খাওয়া শেষে পান-সুপারি পরিবেশনের উল্লেখ করেছেন।
১৪০৬ সালে বাংলায় এসেছিলেন মাহুয়ান। তিনি চা না পেয়ে দুঃখিত হয়ে বলেছিলেন, এখানে চায়ের প্রচলন নেই, তবে অতিথি আপ্যায়নে পান ও সুপারি খেতে দেওয়া হয়। ১৪৪৩ সালের দিকে আবদুর রাজ্জাক সামারকন্দের দূত হিসেবে কালিকটের রাজা জামোরিনের দরবারে এসেছিলেন। তিনি রাজার পান চিবানোর অভ্যেসের কথা উল্লেখ করে এই পাতার গুণকীর্তন করেছেন, ‘…এর খ্যাতির কথা বলতেই হয়…এটা একই সঙ্গে মনকে প্রশান্ত ও উত্তেজিত করে, শরাবের মতোই। এটা ক্ষুধা দূর করে, হজমে সহায়তা করে আর মুখের দুর্গন্ধ দূর করার সঙ্গে দাঁতকেও শক্ত করে। এর স্বাদ বর্ণনাতীত আর এর বলবর্ধক আর কামোদ্দীপক গুণ নিয়ে মন্তব্য করা আমার শিষ্টাচারের ভেতরে পড়ে না।’ জামোরিনের হারেমে ৭০০ মহিলা দেখে তার মনে হয়েছিল, এসবই পানের অবদান। জামোরিনের পান-প্রীতির কথা ইতালীয় পর্যটক লুডোভিচো ডি ভার্থেমাও বলে গেছেন।
ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগিজ পর্যটক দুয়ার্চ বারবোসা এটির অনেক উপকারের কথা বলার পর সাবধান করেছেন, কর্পূর মেশানো পান পুরুষত্বের হানি করে।
অবশ্য সপ্তদশ শতাব্দীতে নিকোলাই মানুচ্চির অভিজ্ঞতা তেমন সুবিধের হয়নি। জর্দা দেওয়া পান মুখে দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমার মাথা এমনভাবে ঘুরে উঠল যে মনে হলো, আমি মারা যাচ্ছি। আমি পড়ে গিয়েছিলাম, চোখে ধাঁধা লেগে গিয়েছিল, আর মাথায় ভয়াবহ যন্ত্রণা হচ্ছিল; কিন্তু এক পরিচিত ইংরেজ আমার মুখে সামান্য লবণ দিয়ে আমার জ্ঞান ফিরিয়ে আনল। যারা পান খায়, তাদের সঙ্গে এমনই হয়, আর যেহেতু এটা তামাকের সঙ্গে পরিবেশিত হয়, তাই দিনে কয়েকবার এটা তাদের খেতে হয়।’ পান নিয়ে তার এমনই ধারণা হলো যে, এর রসে সিক্ত ঠোঁট তার কাছে ভয়ংকর অসুস্থতার লক্ষণ মনে হতে থাকে।
সপ্তদশ শতাব্দীতে কালেড়ি রাজ্যের শাসক বাসব রাজা তার সংস্কৃত ভাষায় লেখা কাব্য শিবতত্ত্ব রত্নাকরে উল্লেখ করেছেন যে নাগাবল্লি ও কর্পূরাবল্লি পান দক্ষিণাত্যের শ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হয়। আর মহারাষ্ট্রের সেরা পান ছিল গাঙ্গেরি ও রামটেকি। ফুলভদ্র এলাকার শ্রীবর্ধন রোটা কুলাপি বিড়া বানাতেন ১০-১২টা পানপাতা, সুপারি, খয়ের আর চুনের সঙ্গে এলাচি, জায়ফল, কাঠবাদাম, পেস্তা ও কুরোনো নারকেল দিয়ে।
দক্ষিণাত্যের রাজাদের বিশ্বাস ছিল, পানের উপরিভাগে থাকেন লক্ষ্মী, তার বোন জ্যৈষ্ঠ থাকেন পিছে; পার্বতী বামে, বিষ্ণু ভেতরে, চন্দ্র বাইরের ভাগে, শিব প্রতিটি কোনায়, কামদেব সব জায়গায় আর যম থাকে বোঁটায়। যে কারণে বোঁটা ফেলেই পান খাওয়া হয়। ডোগরা রাজপুতদের বিশ্বাস, রোববারে যে এই পাতা খায়, সে কোনো কাজে ব্যর্থ হয় না।
হাকিম হাবিবুর রাহমান বলেছেন, বাংলার সোনারগাঁয়ে বিখ্যাত কাফুরি পানের চাষ হতো। ছোট, পাতলা, মচমচে আর সুগন্ধি এই পাতা বিদেশেও পাঠানো হতো। তবে ১৯১৯ সালের সাইক্লোনে এই পানের শেষ চারাটিও নষ্ট হয়ে যায়। ঘোড়াশাল আর নান্দাইলের পানও বেশ ভালো জাতের ছিল। ঘরে ঘরে খাওয়ার জন্য গাছ পানের ব্যবহার হতো। জেমস টেলর ঢাকার ভেতর সোনারগাঁয়ে কর্পূরি (কাফুরি) আর এলাচি নামের সুগন্ধি পান চাষের উল্লেখ করেছেন।
ঢাকার সেরা পানের কারিগর পুরান ঢাকার নবাববাড়ির গেটের শেখ মেহবুব আসলাম। ১৯১৮ সালে তার প্রপিতামহ শেখ শামসুদ্দিন নবাব হাবিবুল্লাহকে পান খাইয়ে খুশি করেছিলেন। সেই থেকে শতবর্ষ আর পঞ্চম প্রজন্ম পেরিয়ে চলছে এই দোকানের মিষ্টি পানের কারবার। ১০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত খিলি। আরেকটা দোকান রয়েছে শাঁখারীবাজারে নকুল দেবনাথের। সেখানেও মিষ্টি শাহি পানের জয়জয়কার। প্রায় ৬০ বছর আগে শাঁখারীর ব্যবসা ছেড়ে পানের দোকান দেওয়াটা তার পরিবারে মঙ্গল বয়ে এনেছিল। এখন ছেলে বাপ্পী দেবনাথ এ ব্যবসা দেখছেন। ১০ টাকা থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে প্রতিটি খিলি। আরেকটা অভিজাত দোকান রয়েছে পানের- পান সুপারি নামে, যেটি শহর ঢাকায় এই খাদ্যানুষঙ্গটিকে আরেকটু আভিজাত্যে উন্নীত করেছে।
লিপস্টিকহীন যুগে ঠোঁট রাঙিয়ে রাখার চল সম্ভবত মোগলদের ভেতরেও প্রচলন ঘটিয়েছিলেন বর্ধমান এলাকা থেকে পান খাওয়ার নেশা ধরা সম্রাজ্ঞী নূরজাহান। তবে যত যা-ই বলা হোক না কেন, পানখোরদের নেশায় এই মিষ্টি পাতার কদর নেই, স্রেফ সুপারি, চুন, খয়ের, ক্ষেত্রবিশেষে যোগ হয় জর্দা। এটাই নাকি পান খাওয়ার মূল রেসিপি।
আল মারুফ রাসেল
ছবি: ইন্টারনেট