ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I ফ্যাশন উইক ২০২১
প্যারিস ও নিউইয়র্কে অতিমারির মধ্যেও দুটি ফ্যাশন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। একটিতে স্প্রিং-সামার, অন্যটিতে ফল-উইন্টার কালেকশন দেখানো হয়। লিখেছেন ফাহমিদা শিকদার
করোনাজনিত দুর্যোগ ফ্যাশনের পথচলায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি। এর মধ্যেও বছরের শুরু থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আয়োজিত হয়েছে বেশ কিছু ফ্যাশন উইক। প্যারিস ও নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত দুটি উৎসব সচেতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রযুক্তির কল্যাণে এই আয়োজনগুলো উপভোগ করা গেছে ঘরে বসেই।
প্যারিস ওত কতুর উইক স্প্রিং-সামার ২০২১
গত ২৫ থেকে ২৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হলো প্যারিস ওত কতুর উইক স্প্রিং-সামার-২০২১। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। অতিমারির সময়ে এটি দ্বিতীয় আয়োজন। আরও জাঁকজমক। উৎসবে অংশ নেয় শম্ব্রে সিন্দিকাল দে লা ওত কতুরের মেম্বার শ্যানেল, শিয়াপারেলি, গিয়ামবাতিস্তা ভালি, ডিওর, জুয়াহির মুরাদ, এলি সাবের মতো নামজাদা ব্র্যান্ড। অতিথি সদস্য হিসেবে অভিষেক হয়েছে নতুন ডিজাইনার চার্লস দে ভিলমরিনের। অনুষ্ঠানে রানওয়ে শো আর ফ্যাশন ফিল্মের মাধ্যমে নিজেদের কালেকশন প্রদর্শন করেন ডিজাইনাররা।
এবার সবার বিশেষ নজর ছিল ফেন্দি শোর দিকে। কার্ল লেগারফেল্ড মারা যাওয়ার পর সিলভিয়া ভেঞ্চুরিনি ফেন্দি ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরের দায়িত্ব নেন। তাকে সহযোগিতা করতে টিম ফেন্দির উইমেনস সেকশনে যোগ দিয়েছেন ব্রিটিশ ফ্যাশন ডিজাইনার কিম জোনস। উইকে নিজের ডেব্যু কালেকশন প্রদর্শন করেন তিনি। লেগারফেল্ডের পর জোনসের কতুরের সংগ্রহ কেমন হবে, এ নিয়ে সবার আগ্রহের কমতি ছিল না। জোনস নিরাশ করেননি কাউকে। কালেকশনটি ফ্যাশন সমালোচকদের বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। নারীর প্রতিটি পোশাকে তার সরল দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। প্রায় তিন বছর ধরে ডিওরের মেনস সেকশনটি পরিচালনা করছেন জোনস। ফেন্দির কতুর সংগ্রহে নারী-পুরুষের পোশাকের হাইব্রিড দেখে তাই কেউ খুব একটা অবাক হননি। হাইব্রিড গাউনের সঙ্গে ছিল সুন্দর কিছু স্যুট প্যান্ট। এর সঙ্গে কেপের ব্যবহার বেশ ছিল মানানসই। এসব পোশাকে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সাদা, কালো, ধূসর রং। ফেন্দির কালেকশন পরে রানওয়ে রাঙিয়েছে নাওমি ক্যাম্পবেল, ডেমি মুর, কেট মস, তার মেয়ে লিলা গ্রেস মস, বেলা হাদিদ, কারা ডেভিলেঞ্জের মতো হাই প্রোফাইল মডেলরা।
লেগারফেল্ড যখন শ্যানেলে ছিলেন, গ্র্যান্ড প্যালেস হোটেল, সুপারমার্কেট থেকে সমুদ্রসৈকত-ফ্যাশন রানওয়েতে রূপান্তরিত হয়েছিল। তবে এ বছর তার উত্তরসূরি ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ভার্জিনিয়া ভিয়ার্ড এখানে অতিমারিপ্রাণিত বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। পুরো ফ্যাশন শোটিতে মডেলরা বিয়ের অতিথি সেজে নতুন কালেকশন প্রদর্শন করেছেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন শ্যানেলের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর পেনেলোপি ক্রুজ, মারিয়ন কোতিয়ার্ড, ভেনেসা পারাদিস। এবারও শ্যানেলের পোশাক ছিল সিম্পল কিন্তু এলিগ্যান্ট। মডার্ন ও রোমান্টিক ধাঁচের রাফল বোলেরস, অরগ্যাঞ্জা বল স্কার্ট, এমব্রয়ডারি প্যাস্টেল ড্রেস, স্লিভলেস টুইড প্যান্টস্যুট, পকেটযুক্ত শের ড্রেস মুগ্ধতা ছড়িয়েছে।
এখনো অনেকেই ডিওরের ২০২০ সালের কতুর ফ্যাশন ফিল্ম ‘লে মিথ ডিওর’-এর কথা ভুলতে পারেনি। তার রেশ কাটতে না কাটতে ডিওর হাজির ‘লে শ্যাটো দু ট্যারো’ নিয়ে। আগের মতোই কালেকশনের শোকেসের জন্য মারিয়া গ্রাজিয়া চিউরি বেছে নিয়েছেন স্টোরি টেলিং ফরম্যাটকে। এবারের ফিল্মটিও পরিচালনা করেন ইতালিয়ান পরিচালক মাতেও গাররোনে। গল্পে দেখা যায়, একজন নারী তাসকান পালাজ্জোতে ঘুরে বেড়ানোর সময় মুখোমুখি হয় ট্যারোট প্যাকের মেজর আরকানা বা ট্রাম্প কার্ডের বিভিন্ন চরিত্রের জীবন্ত প্রতিমূর্তির সঙ্গে। সবার পরনে ছিল ডিওরের স্প্রিং-সামার কতুর কালেকশনের ভেলভেট, জ্যাকার্ড, সিল্কের গাউন, টপস, প্যান্ট, স্কার্ট, ভেইল ইত্যাদি।
অন্যদিকে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে প্রথম কতুর কালেকশন প্রদর্শন করে এখন ‘টক অব দ্য ফ্যাশন টাউন’ চার্লস দে ভিলমরিন। মাত্র এক বছর আগে ফ্যাশন স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে বের হওয়া ভিলমরিনের প্রতিভা দেখে তাকে শম্ব্রে সিন্দিকাল দে লা ওত কতুরের গেস্ট মেম্বার হিসেবে স্পন্সর করেছেন বিখ্যাত ডিজাইনার জ্য পল গতিয়ের। মান রেখেছেন তিনি। ভিলমরিনের পোশাকগুলো ছিল নজরকাড়া। রঙ নিয়ে খেলেছেন তিনি। নিজেই প্রতিটি ফ্যাব্রিক পেইন্ট করেছেন। মোটিফ হিসেবে বেছে নিয়েছেন সাইকেডেলিক নিউড, ফুল, প্রজাপতি, মানুষের মুখ। ১১টি পোশাকের ছোট কালেকশনে ছিল বোল্ড শোল্ডারড কোট, বিল্ট ইন ব্রেস্ট মিনি ড্রেস, কালারফুল টাইটস, ক্রপড পাফার কোট, পাফার স্কার্ট।
নিউইয়র্ক উইমেনস ফ্যাশন উইক ফল-উইন্টার ২০২১
উইকটি ছিল আগের চেয়ে ভিন্ন এবং দীর্ঘ। ফেব্রুয়ারির পুরোটা সময় এবং মার্চের প্রথম কয়েকটা দিন ধরে চলে এই উৎসব। ডিজাইনারদের সমসাময়িক পরিস্থিতিতে নিজেদের কালেকশন প্রদর্শন করা আর সেই সঙ্গে সংস্কৃতি উদ্যাপন এবং ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর নতুন উপায় সম্পর্কে চিন্তা করতে হয়েছে। ফ্যাশন উইকে অনেক বিখ্যাত ব্র্যান্ড হেমন্ত ও শীতের জন্য তাদের সংগ্রহ প্রদর্শন করেন।
অস্কার দে লা রেন্টার কালেকশনের থিম ছিল মহামারিকালীন একঘেয়েমি থেকে বের হয়ে আসার আহ্বান। এটি দিয়ে বোঝানো হয়েছে সোয়েটপ্যান্টকে। অন্তত ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ফার্নান্দো গারসিয়া এবং লরা কিমের কথা থেকে তাই বোঝা যায়। গারসিয়া বলেন, ‘আমি দুঃখিত যে সবকিছু সোয়েটপ্যান্ট হতে পারে না। মহামারি শেষ না হওয়ার আগ পর্যন্ত সবখানেই যদি খালি সোয়েটপ্যান্টই দেখা যায়, এর চেয়ে বিরক্তিকর আর কিছু হতে পারে না।’ এ জন্য এবার তাদের মোটিফ ‘আনন্দের স্ফুলিঙ্গ’। নয়নাভিরাম রেডি টু ওয়্যার কালেকশনে ছিল সুন্দর ফ্লোরাল অ্যাপ্লিকে ও প্রিন্টের গাউন, সিগারেট প্যান্ট, আরামদায়ক পার্টি ফ্রক, স্যুট প্যান্ট।
অন্যদিকে টম ফোর্ডের কালেকশনকে বলা যেতে পারে ‘কমফোর্টেবলি পাওয়ারফুল’। পুরো সংগ্রহে প্রাধান্য পেয়েছে কালো রঙ। এতে ছিল এক্সট্রাভ্যাগাঞ্জ স্লিপ ড্রেস, শিক কাশ্মীর সোয়েটার, অ্যানিমেল প্রিন্ট ব্লেজার, ব্লিচড জিনস, টপস, শের বডি স্যুট, রুমি পাফার কোট আর হট প্যান্ট ও স্কার্ট।
এ বছর ফ্যাশন হাউস ক্যারোলিনা হেরেরার রুবি জুবিলি (৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী) উপলক্ষে ডিজাইনার ওয়েস গর্ডন নতুন কালেকশনের মাধ্যমে ভক্তদের কাছে ভার্চ্যুয়াল লাভ লেটার উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। প্রতিটি পোশাক আর অনুষঙ্গে ছিল হার্ট শেপ মোটিফের সংযোজন। সাদা-কালোর সঙ্গে ছিল অল্প কিছু লাল, গোলাপি, গ্লিটারি ব্লু আর প্যাস্টেল রঙ ও পোলকা ডটের ব্যবহার। পুরো কালেকশনটি সাজানো হয়েছিল পাফি স্লিভের শার্ট, টপস, স্লিভলেস গাউন, ডেনিম স্কার্ট, কোট ড্রেস, হাই ওয়েস্ট প্যান্ট, লং বল স্কার্ট দিয়ে।
এবারের ফ্যাশন উইকের সবচেয়ে চোখধাঁধানো কালেকশনটি ছিল জিমারম্যানের দখলে। সত্তর-আশির দশকের অস্ট্রেলিয়ার একটি বিখ্যাত মিউজিক্যাল প্রোগ্রাম ‘কাউন্টডাউন’ শোটি ছিল নিকি জিমারম্যানের খুব প্রিয়। তাই ছোটবেলার পছন্দের অনুষ্ঠানের অনুপ্রেরণা নিয়ে বানিয়ে ফেললেন পুরো একটি কালেকশন। নিঃসন্দেহে সব পোশাকেই ছিল সত্তর দশকের বিখ্যাত কিছু ট্রেন্ডের ছাপ। যেমন পাফি স্লিভ, ভিক্টোরিয়ান কলার, চেক ও প্রিন্ট প্যাটার্ন, গ্রুভি স্যুট, বোহিমিয়ান টিউনিক, রাফল মিনি ড্রেস, বেল বটম জিনস, বুট কাট জিনস ইত্যাদি। আর পোশাকে মাস্টারড ইয়েলো কালারের নানা শেড, রাস্টিক, টোন, প্যাস্টেল শেডের বাহারি উপস্থিতি ছিল মুগ্ধ করার মতো।
ছবি: ইন্টারনেট