ফিচার I খেলার আদি কথা
শুরুতে মানুষের মধ্যে খেলার প্রচলন থাকলেও পরে এর সঙ্গে পশুদের যুক্ত করা হয়। চিত্তবিনোদনের মধ্যে নিষ্ঠুরতার প্রবেশ ঘটে। লিখেছেন ইমদাদুল লিমন
সভ্য হয়ে ওঠার আগে খেলাধুলার সময় মানুষের থাকত না। কৃষি আবিষ্কারের পর ফসল বোনা থেকে তোলা পর্যন্ত তাদের বিভিন্ন কাজে ব্যস্ততা ছিল। তারপর আবার দীর্ঘ অবসর। সেই সময় তারা নানা রকম আমোদ আর খেলাধুলায় কাটাত। প্রাচীনকালের যেসব নিদর্শন পাওয়া গেছে, সেগুলো থেকে এসব অনুমান করা যায়। খেলার প্রথম বিবরণ পাওয়া গেছে গ্রিসের ইতিহাস থেকে।
গ্রিসের পেলোপনেসাসের অন্তর্গত অলিম্পিয়ার মাঠে গ্রিক দেবতাদের রাজা জিউসের মন্দির ছিল। সেখানে খ্রিস্টপূর্ব ৭৭৬ থেকে ৩৯৪ অব্দ পর্যন্ত নানা রকম খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মূলত প্রতিযোগিতা হতো। অলিম্পিয়ার মাঠে হতো বলে পরে তার নাম হয় অলিম্পিক প্রতিযোগিতা। গ্রিস দেশ তখন কতগুলো ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল। প্রায় প্রতিটি অঞ্চল থেকে দলে দলে খেলোয়াড় বিভিন্ন খেলা দেখাতে অলিম্পিকে আসত। বিজয়ীদের পুরস্কার হিসেবে টাকা বা সোনা-রুপার মেডেল নয়, দেওয়া হতো বুনো জলপাই গাছের পাতার মুকুট। সেটাই ছিল তখনকার খেলার শ্রেষ্ঠ সম্মান।
প্রথম অলিম্পিকে শুধু একটি খেলাই হয়েছিল- দৌড়। এত বেশি লোক এতে অংশ নিয়েছিল যে সেটি চলেছিল অনেক দিন ধরে। শেষে বিজয়ী হয়েছিল একজন রাঁধুনি, নাম কোরোয়েবাস। তখন মেয়েদের এসব খেলায় যোগ দেওয়া নিষেধ ছিল। ক্রমেই অলিম্পিকে ম্যারাথন দৌড়, হকিসহ নানান খেলা এবং শারীরিক কসরতের প্রদর্শনী যুক্ত হয়েছে। এসবের বাইরেও পৃথিবীতে অদ্ভুত কিছু খেলা রয়েছে। কিন্তুর পশুর সঙ্গে যুদ্ধ বা ক্রীতদাসদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে লড়াইও যে খেলার বিষয় হতে পারে, সেটিই প্রমাণ করেছিল রোমানরা।
১৮১৭ সালে পম্পেই নগরীর ধ্বংসস্তূপ খুঁড়ে পাওয়া যায় একটি গ্রাফিতি। তাতে আবিষ্কৃত হয় গ্ল্যাডিয়েটরদের টুকরো টুকরো ইতিহাস। এমনকি তখনকার মাটির তৈরি তৈজসপত্র থেকেও মিলেছে সেসব গল্প।
প্রাচীন রোমে মানুষে-পশুতে অথবা মানুষে-মানুষে যুদ্ধ বাধিয়ে উপভোগ করার ব্যবস্থা ছিল। এই খেলার যোদ্ধাদের বলা হত গ্ল্যাডিয়েটর। তারা ছিল সাধারণত বলিষ্ঠ ক্রীতদাস বা বন্দি। এরা তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ ও খুনোখুনি করত। সেসব দেখে আনন্দ পেত রাজা এবং তার আমন্ত্রিত অতিথিরা। কখনো কখনো গ্ল্যাডিয়েটরদের ওপর হিংস্র জন্তু লেলিয়ে দিয়েও মজা দেখত। জিততে পারলে পুরস্কার- সম্মান, শ্রদ্ধা, সম্পদ, নারীর সান্নিধ্য, স্বাধীনতা ও মুক্তি। খেলার জন্য ঘেরা জায়গাটাকে বলা হতো অ্যাম্ফিথিয়েটার। আজ সেসব স্থাপনা কিছুটা ভাঙাচোরা অবস্থায় রোম শহরে পড়ে আছে। তার নাম কলোসিয়াম। এখানে মাটির নিচের ঘরে জন্তু রাখা হতো। সিংহ মানুষকে কামড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে, রোমানদের কাছে এই দৃশ্য ছিল উপভোগ্য।
ক্রীতদাস হিসেবে কেনা হতো এদের। তারপর বছরের পর বছর পরিশ্রম, রক্তঝরানো প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে জন্ম হতো একেকজন গ্ল্যাডিয়েটরের। প্রাচীন রোমে এমন অন্তত দশজন যোদ্ধার কথা জানা যায়, যারা এই এরিনার [যেখানে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হতো, সেটিকে এরিনা বলে] ভেতরে ও বাইরে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন সাহসিকতা এবং বীরত্বের জন্য।
গ্ল্যাডিয়েটরদের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন স্পার্টাকাস। তিনি রীতিমতো মিথের জন্ম দেন। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন একজন থ্রেশিয়ান সৈনিক, যাকে রোমান সৈন্যরা বন্দি করে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। গ্ল্যাডিয়েটর প্রশিক্ষণকেন্দ্রের মালিক লেন্টুলাস বাতিয়াতুস স্পার্টাকাসকে কিনে নেয়। পরবর্তীকালে তিনি একজন বিখ্যাত গ্ল্যাডিয়েটর হয়ে ওঠেন এবং অনেক যুদ্ধ জয় করেন। কিন্তু লেন্টুলাস তাকে স্বাধীনতা দিতে চেয়েও প্রতারণা করে। ৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্পার্টাকাস সত্তরজন গ্ল্যাডিয়েটর নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এতে বাতিয়াতুস খুন হয়। বিদ্রোহীরা পালিয়ে যাওয়ার সময় অনেক ক্রীতদাসকে মুক্ত করে দেয়। ফলে সত্তর হাজার দাসের একটি বাহিনী তৈরি হয়। তারা পাহাড়ের ঢালে আশ্রয় নেয়।
পুরো শীতকাল গ্ল্যাডিয়েটর ও দাসরা নিজেদের প্রস্তুত করতে প্রশিক্ষণে ব্যয় করে। স্পার্টকাসকে হত্যার জন্য রোমান সম্রাট একের পর এক সৈন্যবাহিনী পাঠাতে থাকে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচারিত ও শোষিত ক্রীতদাসরা তাদের শক্তি ও অভিজ্ঞতা দিয়ে এসব বাহিনীকে পরাজিত করে। ৭১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট মার্কুইস লিসিনিয়াস বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের একটি দল পাঠায়। এতে উভয় পক্ষের যোদ্ধা মারা যায়। স্পার্টাকাস আটক হন ইতালিতে। রোমানরা ছয় হাজার বন্দিকে ক্রুশবিদ্ধ করে। ক্যাপুয়া থেকে রোম পর্যন্ত রাস্তার ধারে তাদের ক্রুশে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।
এই ঘটনা অবলম্বনে ২০০০ সালে রাসেল ক্রো অভিনীত সিনেমা ‘গ্ল্যাডিয়েটর’ নির্মিত হয়। পৃথিবীজুড়ে নির্যাতিত মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষাকে অনুপ্রাণিত করে আসছে স্পার্টাকাস। ক্রীতদাস ফ্ল্যামার কাহিনিও স্মরণীয় হয়ে আছে, যিনি ত্রিশ বছর বয়সে মারা যান। এই সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি ৩৪টি খেলায় অংশ নেন এবং ২১টিতে জয়লাভ করেন। ৯টি ড্র ও ৪টি খেলায় পরাজিত হন। তাকে মুক্তি দেওয়া হলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। একজন গ্ল্যাডিয়েটর হিসেবেই তার মৃত্যু হয়।
রোমান এক সম্রাটের কথাও জানা যায়। যে অ্যাম্ফিথিয়েটারে গ্ল্যাডিয়েটরদের সঙ্গে যুদ্ধ পছন্দ করত। কিন্তু তার বীরত্ব নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ছিল। ধারণা করা হয়, সে যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করত, তারা সবাই ছিল সাধারণ ক্রীতদাস। সম্রাট প্রতিপক্ষকে দিত কাঠের তলোয়ার, আর নিজে নিত ধারালো অস্ত্র। প্রতিটি খেলায় সে প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ হত্যা করত বলে কথিত। বলা হয় অ্যাম্ফিথিয়েটারের মর্যাদা ক্ষুণœ করায় ওই সম্রাটকে গ্ল্যাডিয়েটররাই খুন করে।
একবার একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল বলে কথিত। ক্রীতদাস অ্যান্ড্রোক্লিজকে শাস্তি দেওয়ার জন্য একটা ক্ষুধার্ত সিংহের সামনে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সবাই অবাক হয়ে দেখল, সিংহটা অ্যান্ড্রোক্লিজের পায়ের কাছে বসে লেজ নাড়ছে। শোনা যায়, ক্রীতদাসটি তার মালিকের কাছ থেকে পালিয়ে একবার পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেয়। সেখানে সে একটা অসুস্থ সিংহ দেখতে পায়। পশুটা অ্যান্ড্রোক্লিজকে কিছু বলছে না দেখে সে এগিয়ে যায় এবং তাকে সুস্থ করে তোলে। ক্রীতদাসটিকে খাওয়ার জন্য সে সিংহটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, সেটি ছিল পাহাড়ের গুহার সেই অসুস্থ পশুটি।
রোমের বাইরে স্পেনেও পশুর সঙ্গে রোমহর্ষ খেলার রীতি প্রচলিত। বুল ফাইট। ষাঁড়ের সঙ্গে মানুষের লড়াই। এতে দর্শক একটা ঘেরা জায়গার বাইরে থাকে, আর ভেতরে অবস্থান করে খেলোয়াড়েরা। এই খেলায় একটা তেজি ষাঁড় নিয়ে এসে তাকে পিটিয়ে, খুঁচিয়ে খেপিয়ে দিয়ে সবাই পালিয়ে যায়। থাকে কেবল একজন। যাকে বলে মাটাডর। সে নানা কৌশলে আত্মরক্ষা করে, আর ষাঁড়টাকে আরও খেপাতে থাকে। অবশেষে সে ছোট তলোয়ার বিঁধিয়ে ষাঁড়টাকে হত্যা করে, অথবা কখনো মাটাডর ওই ক্ষিপ্ত পশুর শিংয়ের গুঁতোয় প্রাণ হারায়।
পৃথিবীজুড়ে পশুর সঙ্গে খেলার ইতিহাস আরও আছে। যেমন সার্কাস। সব দেশেই এতে বাঘ, সিংহ, ভালুক, ঘোড়া, বানর, গাধা, ছাগল ইত্যাদি জন্তু-জানোয়ারের খেলা দেখানো হয়। কিন্তু সেসবে রক্ত ঝরানোর মতো কোনো ভয়ংকর ঘটনা ঘটে না। পশুরা এখানে মানুষের মতোই নানান অঙ্গভঙ্গি করে দর্শককে আনন্দ দেয়। এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে চিত্তবিনোদনের। নিষ্ঠুরতা এড়িয়ে পশুদের সঙ্গে মানবিক এই খেলা।
ছবি: ইন্টারনেট