ফিচার I অলৌকিক বদ্যিগিরি
চিকিৎসার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিজ্ঞান। কিন্তু নিরাময়ের কাজে অলৌকিকত্ব আরোপের কারণে এর সত্যাসত্য উদ্ঘাটন হয়ে পড়ে মুশকিল। অপবিশ্বাস চিকিৎসাকে বিজ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে
বলা হয়ে থাকে, চিকিৎসাবিদ্যার উদ্ভব হয়েছিল প্রাচীন গ্রিসে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে। তবে সে দেশও আবার এ বিদ্যা নিয়েছিল ব্যাবিলনের ইহুদি এবং মিসর ও ভারতীয় সভ্যতা থেকে। এই তিন অঞ্চলের বিপুল জ্ঞানভান্ডারের সারবস্তু নিয়ে চিকিৎসাবিদ্যায় যিনি গ্রিসে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি হিপোক্রেটিস। সে দেশে সমুদ্রের ধারে কস নামক ছোট্ট একটি দ্বীপে তার জন্ম। বাবা ছিলেন চিকিৎসক। গ্রিক দেবতা এসকুলাপিয়াসের বংশধর।
এসকুলাপিয়াস আরোগ্য দেবতা অ্যাপোলোর ছেলে। কথিত আছে, চিকিৎসাবিদ্যায় তিনি এত বেশি পারদর্শী হয়ে উঠলেন যে, মানুষ দীর্ঘায়ু হলো। মৃত্যুহার কমে গেল। নরক প্রেতশূন্য হয়ে উঠল। তা দেখে দেবতা জিউস ভাবলেন, এসকুলাপিয়াসের জন্যই মানুষ একদিন অমর হবে। কাজেই বজ্রাঘাতে তাকে তিনি ধ্বংস করলেন। সেই থেকে এসকুলাপিয়াস চিকিৎসার দেবতা হয়ে গেলেন। পুরোহিতেরা পাহাড়ের ওপর ঝরনার ধারে তার মন্দির তৈরি করল। দূর দেশ থেকে রোগীরা দলে দলে আসত আরোগ্যের আশায়।
মন্দিরের চারপাশের মনোরম উদ্যান এবং পাথর খোদাই করা অ্যাপোলো ও জিউসের মূর্তি- পরিবেশের সৌন্দর্যও রোগীদের মানসিক শক্তি জোগাত। সেখানে প্রবেশের আগে রোগীদের ঝরনার হালকা গরম পানিতে স্নান করানোর রীতি ছিল। গায়ে মাখানো হতো সুগন্ধি তেল। পরে এসকুলাপিয়াসের চিকিৎসার অলৌকিক কাহিনি শুনিয়ে অসুস্থদের মনে আশা জাগিয়ে তোলা হতো। তারপর ছিল পূজা ও বলিদানের ব্যবস্থা। মোরগ বা ভেড়া বলি দিয়ে রোগীকে পূজার নিয়ম ছিল। পুরোহিতেরা এসকুলাপিয়াসের মূর্তির সামনে গম্ভীর স্বরে মন্ত্র পাঠ করতেন। বলতেন, গভীর রাতে দেবতার আদেশ পাওয়া যাবে। রোগীরা মন্দিরের চত্বরে বা কোনো কোঠায় ঘুমিয়ে গেলে পুরোহিতেরা দেবতার পোশাক পরে চুপি চুপি সেখানে প্রবেশ করে চিকিৎসার বিধান দিতেন। কেউ জেগে গেলে তার ভাগ্যে দেবতার দেখা মিলত। পরদিন তারা দেবতার আদেশ বুঝিয়ে দিতেন। রোগ বুঝে ব্যবস্থা নির্দেশ করতেন- রক্তমোক্ষম, জোলাপ কিংবা কোনো উদ্গারক।
আরোগ্য হলে দেহের যে অংশের রোগ সেরেছে মোম, ব্রোঞ্জ অথবা সোনা দিয়ে তার প্রতিকৃতি তৈরি করে মন্দিরে দিয়ে যেত। আর পাথরে খোদাই করে রোগীর বিবরণ এবং অলৌকিক এই আরোগ্যকথা লেখা হতো। সেগুলো ঝুলিয়ে রাখা হতো মন্দিরের দেয়ালে। এসব প্রস্তরলিপি থেকে জানা যায়, ক্লিও নামের এক নারী পাঁচ বছর অন্তঃসত্ত্বা ছিল। সন্তান আর প্রসব হয় না। অবশেষে সে একদিন এই মন্দিরে আসে। দেবতার দয়ায় পরদিনই সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে ওই পাঁচ বছরের ছেলে মায়ের হাত ধরে ঝরনায় স্নান সেরে পূজা দিতে এলো মন্দিরে।
নিকানর নামে একজন খঞ্জ ছিল। লাঠিতে ভর দিয়ে সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলত। এই মন্দিরে এসে সে একদিন লাঠি রেখে বসেছিল। এমন সময় হঠাৎ এক শিশু লাঠি নিয়ে পালিয়ে গেল। নিকানর উঠে তাকে তাড়া করল। অমনি তার খোঁড়া পা ভালো হয়ে গেল। এমন ঘটনা আরও শোনা যায়। অ্যালসেটাস ছিল অন্ধ। একদিন দেবতার দয়ায় সে দৃষ্টি ফিরে পায়। দেবতা তার চোখের সামনে আঙুল রেখে বললেন, চোখ খোলো। অ্যালসেটাস চোখ মেলে মন্দিরের গাছপালা দেখতে পায়।
দেবতা কেবল রোগ সারাতেন তা নয়, সার্জারিও করতেন। স্পার্টার একটি মেয়ের পেটে জল জমে ফুলে ওঠে। তার পা-ও ফুলে গেল। সে আরোগ্যের আশায় মন্দিরে এলে এসকুলাপিয়াস তার গলা কেটে দু পা ধরে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখলেন। এতে পা ও পেট থেকে সব পানি বেরিয়ে যায়। শেষে আবার তার কাটা গলা যথাস্থানে জুড়ে দেওয়া হয়।
এসব অলৌকিক ঘটনা মন্দিরের গায়ে ঝুলন্ত পাথরে লেখা থাকত। পুরোহিতেরা এসকুলাপিয়াসের মন্দির গড়ে এসব অলৌকিক চিকিৎসার দিকে ঝুঁকল, তখন গ্রিসের একদল চিকিৎসক একটা সংঘ তৈরি করে। এসকুলাপিয়াড। এরা চিকিৎসা করতেন এবং ছাত্রদের শেখাতেন। হিপোক্রেটিস এমনই এক চিকিৎসক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাবার কাছে চিকিৎসাবিদ্যা আয়ত্ত করেন। পরে দেশ-বিদেশে ঘুরে তার যে বিপুল জ্ঞান সঞ্চয় হয়, তা দিয়ে তিনি থ্রেস, থেসালি ও মেসিডোনিয়ায় চিকিৎসাবিদ্যার চর্চা করতেন।
তখনকার দিনে চিকিৎসকেরা পুরোহিতের মতো মন্ত্র, তন্ত্র এবং নামমাত্র ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করতেন। যুদ্ধের আহত রোগীদের নিয়ে করতেন সার্জারি। বিশেষ কোনো রোগের সব লক্ষণ খুঁটিয়ে দেখতেন না। পরিণতি কী হবে, তা নিয়েও তেমন মাথা ঘামাতেন না। সেসব মন্ত্র, তন্ত্র ও ডাকিনীবিদ্যার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। গ্রিক ভাস্করের মতো দেহের বাইরের দিকটাই কেবল বুঝতেন, ভেতরের খবর রাখতেন না। হিপোক্রেটিসই প্রথম এদিকে দৃষ্টি দিলেন। রোগীর বিছানার পাশে বসে দিনের পর দিন রোগ পর্যবেক্ষণ করতেন। চোখ, মুখ, জিহ্বা ও শ্বাস-প্রশ্বাসের কী পরিবর্তন হয় তা খুঁটিয়ে দেখতেন। কিসে রোগীর যন্ত্রণা কমে, তার ব্যবস্থা দিতেন। এভাবে তার হাতে একালের চিকিৎসাবিদ্যার সূচনা ঘটে। ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের সৃষ্টি হয় সে সময়। যদিও তখন হিপোক্রেটিস অ্যানাটমি বা শারীরবিদ্যার কিছুই জানতেন না, তবু নিজের বুদ্ধিমত্তা ও পর্যবেক্ষণ শক্তি দিয়ে তিনি চিকিৎসার বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির সূচনা ঘটান। একবার রাজধানী এথেন্সে প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। হিপোক্রেটিস শহরের চারপাশে আগুন জ্বালিয়ে দেন। এতে প্লেগ রোগ ছড়াতে পারেনি। এসবই করেছিলেন তিনি বুদ্ধিমত্তার জোরে।
এখন হাসপাতালে প্রত্যেক রোগীর বিছানার পাশে একটি করে চার্ট ঝোলানো থাকে। তাতে লেখা হয় রোগের বিবরণ ও রোগীর দৈনন্দিন অবস্থা। তা থেকে রোগনির্ণয়, চিকিৎসা এবং তার পরিণতি সম্পর্কে ধারণা করা যায়। হিপোক্রেটিস এপিডেমিক নামের একটি পুস্তিকায় ঠিক একই পদ্ধতিতে ৪২ জন রোগীর ইতিহাস লিখেছিলেন। তিনি যা কিছু পর্যবেক্ষণ করেছেন তাই লিখেছেন। কারণ, তিনি মনে করতেন, একজনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিফলতা থেকে অপরে শিক্ষা নিতে পারবে। ব্যর্থতার কারণ বুঝতে পারবে। এটিই বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসাবিদ্যার ভিত্তি। আজও তাই চিকিৎসাবিদ্যার শিক্ষার্থীরা তার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।
কিন্তু হিপোক্রেটিস চিকিৎসাবিদ্যার যে আদর্শ তুলে ধরেছিলেন, রোগ বর্ণনায় যে যুক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন, পরবর্তী চিকিৎসকেরা তা মানেননি। তাই এর সঙ্গে অলৌকিকতার যোগ হয়েছে। এমনকি হিপোক্রেটিসের নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে অবাস্তব কাহিনি। যেমন মৃত্যুর পর তার সমাধির ওপর বিশেষ এক ধরনের মৌমাছি বাসা বাঁধে। সেই মৌচাকের মধু খাওয়ালে শিশুদের মুখের ঘা সারে। এসব অলৌকিক কাহিনি প্রচারের ফলে হিপোক্রেটিসের লেখা চাপা পড়ে যায়।
সতেরো শ বছরের মধ্যে হিপোক্রেটিসের রোগ বর্ণনার মতো অমন নিখুঁত চিত্র আর পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, পরবর্তীকালে চিকিৎসার সঙ্গে অলৌকিকতার যোগ রয়ে যাওয়ার কারণই হলো ধর্মযাজকদের সেই তৎপরতা। মুসলমানদের মধ্যেও অনেক পীর-আউলিয়ার আশ্চর্যজনক ‘নিরাময় ক্ষমতা’ ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। মানুষ রোগে আক্রান্ত হলে মাজারে গিয়ে মানত করে, পীরের পানি-পড়া পান করে, তাবিজ ঝোলায়। এসব বিশ্বাস অবশ্য ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান- সব ধর্মের লোকদের মধ্যে প্রচলিত। ‘মুসলিম সেইন্টস অব সাউথ এশিয়া: দ্য ইলেভেনথ টু ফিফটিনথ সেঞ্চুরি’ বইতে আনা সুভরভা লিখেছেন, মধ্যযুগে প্লেগে আক্রান্ত দিল্লির লোকেরা নিরাময়ের আশায় দল বেঁধে কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার খিলজির মাজারে গিয়েছিল। ক্যাথলিক ইউরোপেও খ্রিস্টের অনুসারীদের মধ্যে রোগ সারাতে ওই ধর্মের বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মহাত্মাদের কাছে যাওয়ার রীতি দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর ‘ক্যাথলিক হেরাল্ড’ পত্রিকায় ১৯ মার্চ ২০২০ সংখ্যায় ‘দ্য বেস্ট সেইন্টস টু প্রেডিউরিং আ পেনডেমিক’ শিরোনামে একটি চিত্তাকর্ষক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, মহামারি থেকে মুক্তির জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সন্ত হলেন সেইন্ট সি বা সটিয়ান।
লাইফস্টাইল ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট