ফিচার I বাংলার টেরাকোটা
এই অঞ্চলের পোড়ামাটির নকশার ইতিহাস সুপ্রাচীন। আদি স্থাপত্যকলার বিশেষ এই উপাদান নতুন করে নজরে আসছে। লিখেছেন আল মারুফ রাসেল
লাতিন শব্দ টেরা ও কোটা- এর অর্থ যথাক্রমে মাটি ও পোড়ানো। অর্থাৎ মাটি পুড়িয়ে যেগুলো তৈরি হয়, সবই টেরাকোটা। আঠালো মাটির সঙ্গে খড়কুটো, তুষ ইত্যাদি মিশিয়ে কাদামাটি প্রস্তুত করে বিভিন্ন আকৃতি দিয়ে পুড়িয়ে তৈরি হতো প্রতিমা, ভাস্কর্য, টাইলস, তৈজসপত্র, খেলনা প্রভৃতি। পৃথিবীর নানান আদি সভ্যতার মতো বাংলা অঞ্চলেও মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন আমলের টেরাকোটার নিদর্শন মেলে। শুধু তা-ই নয়, ঔপনিবেশিকদের ভাগ করা ধর্মভিত্তিক ইতিহাসের যে শ্রেণিবিভাগ, তাতে মধ্যযুগ বলে পরিচিত মুসলিম শাসনামলেও টেরাকোটায় রীতিমতো বিপ্লব হয়ে গিয়েছিল বঙ্গে। মন্দিরের গায়ে পোড়ামাটির সৌন্দর্য দেখে মুসলিম শাসকেরাও তা গ্রহণ করেছিলেন, নিজেদের মতন করে। ইটের স্থাপত্যের বাইরের দিকের অলংকরণে পোড়ামাটির প্যানেল ও ফ্রিজ শিল্পজগতে বাংলার গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এই অঞ্চলে পাথরের স্বল্পতার কারণে ইট পুড়িয়ে ভবন, মূর্তি, ভাস্কর্য, টাইলস ইত্যাদি তৈরি তাই স্বাভাবিক ছিল।
বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো টেরাকোটা নিদর্শনের আকর উয়ারী-বটেশ্বর, মহাস্থানগড়সহ তার আশপাশের এলাকা। আড়াই হাজার বছর আগেকার এসব নিদর্শনই এখনকার বাংলা ভূখন্ডে পাওয়া সবচেয়ে পুরোনো পোড়ামাটির শিল্প-দৃষ্টান্ত। মহাস্থানগড়ে মিলেছে মৌর্য, কুশান, গুপ্তযুগের সব নিদর্শন। পাহাড়পুরেও পাল-পূর্ব যুগের নমুনা পাওয়া গেছে। প্রতিটি সময়ের ভিন্ন ভিন্ন সব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান এসবে। যেমন উয়ারী-বটেশ্বর এলাকার আদি মাতৃদেবীর একটি প্রতিকৃতি পাওয়া গেছে, যার সঙ্গে পশ্চিম এশিয়া ও সিন্ধু সভ্যতার মাতৃদেবীর মিল রয়েছে। পরবর্তী সময়ে মৌর্যযুগের টেরাকোটায় গ্রিক-পারস্য প্রভাবের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল এদেশীয় ধারা। তবে এই সময়ে হাতের পাশাপাশি ছাঁচের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ছাঁচে মুখাবয়ব তৈরি হতো, আর শারীরিক গড়ন দেওয়া হতো হাতে। তবে ছাঁচ থেকে বেরোনোর পর তা নিখুঁততর করতে আবারও হাতের পরশ দিত কুমার। শুঙ্গযুগের কিছু পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গেছে মহাস্থানে। কুষাণযুগের টেরাকোটা ফলক বা মূর্তিতে নারীদের সূক্ষ্ম ও স্বচ্ছ বসনা (মসলিন পরিহিতা!?) দেখানোর প্রয়াস ছিল, যা বাংলার প্রচলিত শিল্পরীতির সঙ্গে গ্রেকো-রোমান শিল্পরীতির মিশ্রণ বলে বিবেচিত। গুপ্তযুগে সেটা আরও পরিশীলিত ও শৈল্পিক রূপ লাভ করে। এ সময়কার আরও কিছু টেরাকোটার ফলক ও অন্যান্য প্রত্নবস্তু মিলেছে পাহাড়পুর এবং মঙ্গলকোটে। তারপর এ শিল্পের খানিক অবনমন ঘটে। মহাস্থানগড়ে পাওয়া ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীর টেরাকোটাগুলো এর প্রমাণ। সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর শালবন বিহারের চিত্রফলকগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। পাল আমলের সবচেয়ে বড় কীর্তি সোমপুর বা পাহাড়পুর মহাবিহার তৈরি হয়েছিল অষ্টম শতাব্দীর শেষ ভাগে। সেখানকার কেন্দ্রীয় মন্দিরের গায়ে প্রায় দুই হাজার টেরাকোটা ছিল। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল আরও ৮০০ টেরাকোটা। কিন্তু শৈল্পিক মানের বিচারে কোনোটাই উৎকৃষ্ট বলে মেনে নেওয়া যায় না। তবে শালবন আর সোমপুর বিহারের টেরাকোটার বর্ণনা দিতে গিয়ে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া বলেছেন, ‘পোড়ামাটির চিত্রফলকগুলোতে ধর্মীয় তাৎপর্য বা শৈল্পিক সৌন্দর্য থাক বা না থাক, এগুলোর মাধ্যমে তখনকার দিনের বাঙালির যে চিত্রের পরিচয় মেলে, তার মূল্য অপরিসীম।’ লৌকিক ধর্ম, আচার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কালে কালে এই বাংলাতেই টেরাকোটা শিল্পের কয়েকটি ধরন তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেন আমলে প্রচুর মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার আস্তর পড়েছে, ইট হয়েছে কারুকার্যময়।
এরপর মধ্যযুগ, ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজি বাংলার দখল নেওয়ার পর টেরাকোটা শিল্প খানিকটা ম্রিয়মাণ হয়ে পড়লেও ঘুরে দাঁড়াতে খুব বেশি সময় লাগেনি। কারণ, একদম শুরুতে সাদামাটা গড়নের মসজিদ গড়লেও পরে মিহরাব ও বাইরের দেয়ালে এবং কবরের আচ্ছাদনে প্রথমে টেরাকোটার নকশার আদলে পাথরে খোদাই করা হতো। ঘণ্টা আর শিকলের মোটিফ, প্রস্ফুটিত পদ্ম সেই প্রমাণই বহন করে। তবে পাথরের অপর্যাপ্ততার কারণে আবারও পোড়ামাটিতেই হতে থাকে সেসব মোটিফ। ইসলামে জীবজন্তু আঁকা মানা, তাই গাছ, লতাপাতা, ঘণ্টা, শিকল, পদ্ম, গোলাপের নকশা হতে থাকে মসজিদের মিহরাবে ও দেয়ালে। স্বাধীন সুলতানি আমলের (১৩৩৮-১৫৭৬) বেশির ভাগ মসজিদেই দেখা যায় পোড়ামাটির কারুকাজ, নকশা করা ইট। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, সোনারগাঁসহ আরও নানা এলাকার সুলতানি স্থাপত্যের মসজিদ, বাগেরহাটের খলিফতাবাদের ও ঝিনাইদহের বারোবাজার বা মুহাম্মদাবাদের খানজাহানি স্থাপত্যের মসজিদগুলোতে এই নিদর্শন দেখা গেছে। কিন্তু মোগল আমলে লাইম-প্লাস্টারের আগমন টেরাকোটার শিল্পকে আবারও দুর্দশায় ফেলে দেয়।
তবে তখনো যে অল্প-বিস্তর টেরাকোটার কাজ হয়নি, এমন নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আবারও এর আবির্ভাব ঘটে মন্দিরে। বাংলার ইতিহাসের মধ্যযুগে এসে টেরাকোটাকে জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করলেও মন্দ হয় না। স্বাধীন সুলতানেরা দিল্লি থেকে বাংলা মুক্ত করে মসজিদে টেরাকোটার অসাধারণ সব শিল্পকর্ম করিয়েছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতেও ঠিক তাই, নবাবি আমলে বাংলা কাগজে-কলমে দিল্লির অধীন হলেও মূল শাসনভার নবাবদের হাতেই ছিল, অনেকটা আগেকার দিনের করদ রাজ্যের মতো। মুর্শিদ কুলি খাঁর সময় থেকেই বাংলায় নবাবি কার্যক্রম পরিচালনায় সনাতনধর্মাবলম্বীদের নিয়োগ করা হয়েছিল। ফলে তাদের আভিজাত্য, পুরোনো জৌলুশ আবারও ফিরে আসতে শুরু করে। তাই টেরাকোটার চমৎকার সব কাজ দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা- মোদ্দা কথা উত্তরবঙ্গজুড়ে দেখা যেতে থাকে। এই সময়কার উল্লেখযোগ্য সেরা কাজ দেখা যায় দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দিরে, কিছু রয়েছে রাজশাহীর পুঠিয়ায়। ১৭৫২ সাল নাগাদ তৈরি দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দিরের মতো এত সূক্ষ্ম ও জটিল কাজ সে সময়ের আর কোনো মন্দিরে দেখা যায় না। রামায়ণ, মহাভারত এবং বিভিন্ন পুরাণের উল্লেখযোগ্য কাহিনি এখানে ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। মন্দিরের নিচ থেকে শুরু করে ছাদ পর্যন্ত টেরাকোটার ফলকে মোড়া। একই রকম দেখতে কোনো টেরাকোটাই দ্বিতীয়বার বসানো হয়নি।
ঔপনিবেশিক আমলে জমিদার আর অভিজাতদের ভেতর ইউরোপীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ এবং ইউরোপীয়-বঙ্গ সংস্কৃতির মিশেলে ‘বাবু কালচারের’ ফলে দেশে পাশ্চাত্য ঘরানার ঘরবাড়ি, ইমারত তৈরি হতে থাকে। ফলে হারিয়ে যায় পোড়ামাটির ফলকের ব্যবহার। তবে টেরাকোটা পদ্ধতিতে গড়া তৈজসপত্র এখনো গ্রামে ব্যবহৃত হলেও ইট ছাড়া আধুনিক ইমারতের কথা ভাবা যায় না। কিন্তু মাটির টেপা পুতুল কয়েক হাজার বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে। আশার কথা, এখন অনেকেই টেরাকোটার ফলক তৈরি করিয়ে বাড়ির বাইরের দিকে টাইলস হিসেবে ব্যবহার করছেন, করপোরেট হাউসগুলো বিভিন্ন ফলক তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানের জন্য, এমনকি ২০১৪ সালে বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ শাহ সুফী মোস্তাফিজুর রহমান প্রান্তিক কিছু কুমারকে আদিকালের টেরাকোটা তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, যেন বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসের ঘ্রাণ পাওয়া যায় এ যুগে এসেও।
ছবি: সংগ্রহ