আড্ডা I প্রয়োজন বিপণনের বিকল্প প্ল্যাটফর্ম
করোনাকালের নয়া বাস্তবতায় বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিও নানা সমীকরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এথনিক ওয়্যার নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের অবস্থা মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। তবে পরিস্থিতি সামলে কীভাবে এগোবেন তারা, তা নিয়েই সম্প্রতি গতায়ু ফাগুনের এক সকালে কথা বলেন এই খাতের শীর্ষস্থানীয় তিন উদ্যোক্তা- কে ক্র্যাফটের পরিচালক খালিদ মাহমুদ খান, সাদাকালোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজহারুল হক আজাদ এবং রঙ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী সৌমিক দাস। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলোর উপসম্পাদক শেখ সাইফুর রহমান
ক্যানভাস: করোনা মহামারি আমাদের মাঝে নানা ধরনের দ্বিধা বা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে মিডিয়াসংক্রান্ত- প্রিন্ট মিডিয়া এবং অনলাইন বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নিয়ে। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রচারের ক্ষেত্রে কোনটিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া উচিত বলে আপনারা মনে করেন?
সৌমিক দাস: করোনার কারণে বাজার পরিস্থিতি আশঙ্কাজনকভাবে খারাপের দিকে যায়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, প্রায় সব ফ্যাশন হাউসের বিক্রি ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কমে গেছে। কিন্তু আমাদের প্রডাকশনও চালিয়ে যেতে হয়েছে। আবার আমরা কোনো ধরনের সরকারি প্রণোদনাও পাইনি। সুতরাং একটি বিরূপ পরিবেশে আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। যার প্রভাব আমাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরও রয়েছে। প্রিন্ট এবং অনলাইন মিডিয়ার কথায় যদি আসি। করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরুতে দেখা গেছে, সবার বাড়িতে প্রিন্টেড পত্রিকা নেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা যায়নি। তা ছাড়া এখন সবার হাতেই স্মার্ট গ্যাজেট। সেলফোনের এই সময়ে সবাই সবকিছু ফোনের স্ক্রিনেই দেখতে চান। আমার মনে হয়, পাঠকও এখন প্রিন্টেড পত্রিকা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। যেহেতু মানুষ অনলাইনেই বেশি সময় কাটাচ্ছেন এবং এর মাধ্যমে সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। তাই আমরাও এদিকে একটু বেশি আগ্রহী।
খালিদ মাহমুদ খান: বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি প্রিন্ট মিডিয়াকে একটি টেকসই অবস্থান তৈরি করতে হয়, তবে আমার মনে হয়, তাদের নিজস্ব কিছু আয়োজনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে, যার মাধ্যমে পাঠকের উপস্থিতি বাড়বে। তা না হলে মানুষ যেভাবে ডিজিটাল মিডিয়ার দিকে ঝুঁকছে, তাতে প্রিন্ট মিডিয়া ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। কারণ, প্রিন্ট মিডিয়া ধীরে ধীরে কেবল একটি ইমেজে পরিণত হচ্ছে। এমতাবস্থায় এটিকে অর্থনৈতিকভাবে সচল রাখাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। এ জন্য নতুন ইভেন্ট আয়োজনের কথা ভাবা দরকার। এবার যেমন বৈশাখ এবং ঈদ কাছাকাছি সময়ে, তাই আয়োজন করে সামার কালেকশন নিয়ে কাজ করা যেতে পারে। শুরুতে বেশি সাড়া কম হলেও ধীরে ধীরে মানুষের আগ্রহ বাড়বে। আরেকটি বিষয়, অতীতে কে কী করেছি, এই চিন্তা থেকে বের হয়ে অন্তত দুই বছরের জন্য আমাদের সারভাইভাল প্ল্যান তৈরি করতে হবে। কারণ, টিকে থাকলে নতুন কিছু করা সম্ভব।
আজহারুল হক আজাদ: সময়টা আসলে অনেক জটিল। করোনা পরিস্থিতির আগে থেকেই মানুষ ডিজিটালের প্রতি বেশি ঝুঁকেছে। কিন্তু তারপরও সকালে প্রিন্টেড পত্রিকা হাতে না পেলে একধরনের খারাপ লাগা কাজ করত। করোনাজনিত বাস্তবতায় এই খারাপ লাগা অনেকটাই কমে গেছে। এমনটি শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বজুড়েই। এই ডিজিটাল যুগে আরও কয়েকটি বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে যে কেউ ডিজাইনার হয়ে উঠতে পারছে। আক্ষেপের সুরে বলতে চাই, সাংবাদিকেরাও তাদের কভারেজ দিয়ে যাচ্ছে। কেউ দু-চারটা পোশাক তৈরি করে যখন একটি প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন হাউসের সঙ্গে পত্রিকার পাতায় বা অনলাইনে জায়গা পেয়ে যায়, তখন প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন হাউস সংশ্লিষ্টরা কেন মনে করবে, মিডিয়া এখনো তাদের সঙ্গে আছে বা তাদের সাহায্য করবে। একথা বলতে হয় যে, একসময় ফ্যাশন হাউসগুলোকে মিডিয়া বেশ ভালোভাবেই সাহায্য করেছে।
ক্যানভাস: আমরা কয়েক বছর ধরেই আলোচনা করে আসছি যে বৈশাখ এবং ঈদ কাছাকাছি সময়ে চলে আসছে। সুতরাং আগামী পাঁচ বছর একটি ইভেন্টকে বাদ দিতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর এ নিয়ে কি কোনো প্ল্যান ছিল, তারা এই সময়ে কী করতে পারেন?
খালিদ মাহমুদ: ঈদ কিংবা বৈশাখের বিকল্প হিসেবে ফাল্গুন এবং ভ্যালেন্টাইনের আয়োজন আরও বড় পরিসরে করার একটি পরিকল্পনা আমাদের ছিল। কিন্তু সে ভাবনায় বাধা হয়ে দাঁড়াল করোনা। ফলে আমাদের সব চিন্তাই অনেকটা এলোমেলো হয়ে গেল। আমরা সব থেকে বড় ধাক্কা খেলাম অর্থনৈতিকভাবে। বলা যায় ব্যবসায়িক মুনাফা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল, কিন্তু খরচ সেই একই। করোনার সময়ে আমার আরও একটি ধারণা সুস্পষ্ট হয়েছে। তা হচ্ছে, দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর অনেকেরই অর্থনৈতিক বাস্তবতার চেয়ে, বাজার বিনিয়োগ বেশি। কারণ, অনলাইনে পোশাক বিক্রেতাদের সঙ্গে ফ্যাশন হাউসগুলোর পার্থক্য হচ্ছে উৎপাদন ব্যবস্থাপনায়। তারা ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড থেকে আসা পণ্য কিনে বিক্রি করে। আর ফ্যাশন হাউসগুলো ডিজাইন তৈরি করে, প্রডিউসারদের দিয়ে প্রস্তুত করিয়ে, যাচাই-বাছাই ও প্যাকেজিংয়ের পর পণ্য বাজারে ছাড়ে। এই প্রক্রিয়ায় অনেক মানুষ জড়িত। করোনার কারণে তারাও একটি বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। আমরা এবং আমাদের সঙ্গে সরাসরি জড়িতরা কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সরকারি প্রণোদনা পায়নি। সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার কথা থাকলেও সেখান থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। তার ওপর অনলাইন বিক্রেতাদের বৈধ-অবৈধ পণ্যে বাজার সয়লাব। সব মিলিয়ে বাজার খুবই এলোমেলো। আমাদের আরও একটি পরিকল্পনা ছিল গ্রীষ্মকেন্দ্রিক। যেহেতু বৈশাখ ও ঈদ একই সময়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাই গ্রীষ্ম প্রাধান্য পাবে মানুষের কাছে। এবং এতে প্রতিদিনের ব্যবহারের পোশাক বেশি গুরুত্ব পাবে। কিন্তু করোনার প্রভাবে এসব চিন্তা এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে বলা যায়। সংকট এখন সব সেক্টরেই। ফ্যাশন হাউসগুলোকে যেমন ঘুরে দাঁড়াতে হবে, মিডিয়াকেও এ বিষয়ে ভাবতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সমন্বিত চেষ্টা এবং উদ্যোগ। কারণ, মিডিয়াকে নতুন পাঠক সৃষ্টি করতে হবে, যার মাধ্যমে ফ্যাশন হাউসগুলো নতুন ক্রেতা তৈরি করতে পারবে। এখন শুধু বিজ্ঞাপন দিয়ে পাঠক বা ক্রেতা তৈরি করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন সৃজনশীল আয়োজন।
ক্যানভাস: আমাদের দেশের ফ্যাশন হাউসগুলো অনেকটাই উৎসব এবং দিবসভিত্তিক। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যা দেখা যায় না। প্রশ্ন হলো, গত দশ বছরে উৎসব এবং দিবসভিত্তিক ফ্যাশনের চাহিদা কী বেড়েছে, না কমেছে? এবং নতুন প্রজন্ম রেডি টু ওয়্যারের দিকে বেশি ঝুঁকছে কি না।
আজহারুল হক আজাদ: বিভিন্ন ধরনের পার্বণ উদ্যাপনই আমাদের সংস্কৃতি। প্রাচীনকাল থেকে এ দেশের মানুষ নানান সামাজিক এবং ধর্মীয় উৎসব আয়োজন ও পালন করে। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। শুধু সময়ের সঙ্গে এর প্রেক্ষাপট এবং উদ্যাপনের ধরন পাল্টেছে। বৈশাখ আগে যেভাবে পালন করা হতো, এখন সেখানে নানা নতুন চিন্তা যোগ হয়েছে। কারণ, এতে নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ বেড়েছে। আমার মনে হয়, ধারাবাহিকভাবে তরুণ-তরুণীদের অংশগ্রহণ বাড়বে। আরও একটি বিষয় লক্ষ করেছি, আগের চেয়েও তরুণেরা এখন পাঞ্জাবি বেশি পরে।
দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো মূলত উৎসব এবং দিবসভিত্তিক পোশাক তৈরি করে। এটি তাদের স্বকীয়তা। এই শক্তিতেই উৎসব এবং দিবসভিত্তিক পোশাকের আধুনিকতা দিয়ে তারা জনপ্রিয় হতে পেরেছে। পরবর্তীকালে মিডিয়া সাধারণ মানুষের কাছে সেসব ব্যাপকভাবে তুলে ধরেছে। এখন আসি রেডি টু ওয়্যারের বিষয়ে। প্রতিদিনের পোশাক হিসেবে রেডি টু ওয়্যার সবার পছন্দের। এর বিক্রিও বেশি। তাই বলে দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোকেও রেডি টু ওয়্যার তৈরি করতে হবে তা নয়। আরেকটি বাস্তবতা হচ্ছে, সম্পূর্ণ দেশীয় উপাদানে রেডি টু ওয়্যার তৈরি করা সম্ভব নয়। আমার কথা হচ্ছে, স্বকীয়তা নিয়েই চলা ভালো।
ক্যানভাস: নতুন বাস্তবতায় মানুষের চাহিদার পরিবর্তন ঘটেছে। অন্যদিকে একটা দীর্ঘ সময় মানুষ উৎসব ও দিবস পালন থেকে দূরে ছিল। সবাইকে আবার ট্রেন্ডে ফেরাতে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
সৌমিক দাস: করোনার সময় মানুষের কেটেছে অনেকেটাই গৃহবন্দি অবস্থায়। এ কারণে তাদের অভ্যাসেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সুতরাং সবকিছু আগের অবস্থায় ফিরতে কিছুটা সময় লাগবে। এখানে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এমনকি মানুষ যখন গৃহবন্দি ছিল, তখনো মিডিয়া ঘরে বসেই কীভাবে উৎসব উদ্যাপন করা যায়, এ বিষয়ে আরও বেশি কাজ করতে পারত। আমরা ফাল্গুন নিয়ে বেশ ভালোভাবেই কাজ করেছি, কিন্তু এর ফল খুব একটা ভালো হয়নি। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের আরও ভাবতে হবে। প্রয়োজনে বার্ষিক ক্যালেন্ডার তৈরি করতে হবে। বৈশাখ এবং ঈদের বাইরেও যে উৎসব বা দিবসগুলো রয়েছে, তা আরও কতটা নতুনভাবে পালন করা যায়, সেই পরিকল্পনা করা দরকার।
ক্যানভাস: ই-কমার্সের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বেশ কয়েক বছর ধরেই সবাই সচেতন। কিন্তু করোনার সময় তা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। অনেকে মহামারিকালে ই-কমার্স থেকে বেশ লাভবানও হয়েছে। আপনাদের অবস্থা কী?
আজহারুল হক আজাদ: এখানে বলতে হয়, ই-কমার্স প্রয়োজন এটি যেমন সত্য, আবার এর জন্য আমরা তৈরি না, এটাও সত্য। আমার মনে হয় যারা আগে থেকেই ই-কমার্স নিয়ে কাজ করছিল, তারা মহামারির সময় কিছুটা সুফল পেয়েছে। কিন্তু যারা হঠাৎ করে শুরু করেছে, তাদের খুব একটা লাভ হয়নি। আমাদের দেশে ই-কমার্স বলতে সবাই ফেসবুককেই বোঝে। আর আলোচনা যত বেশি হয়েছে, ব্যবসা ততটা হয়েছে কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। তবে একথা সত্যি যে ই-কমার্সই ভবিষ্যৎ।
খালিদ মাহমুদ: ই-কমার্স এখনো একটা আনহেলদি মার্কেট। এখানে অনেক ধরনের সচেতনতা প্রয়োজন। বিশেষ করে বিক্রয়োত্তর সেবার ক্ষেত্রে। ই-কমার্সের ক্রেতা ও বিক্রেতা- উভয়েরই শেখার বিষয় রয়েছে। সবচেয়ে বড় যেটি, তা হচ্ছে ই-কমার্সের ক্ষেত্রে বিক্রেতাকে দায়বদ্ধ হতে হবে। বিশেষ করে ফেসবুকে যারা পোশাক বিক্রি করে। কত টাকায় কোন কোয়ালিটির পোশাক দিচ্ছে, সেই জায়গায় সে কতটা দায়বদ্ধ- এটা ভাবতে হবে। দায়বদ্ধতা না থাকার জন্য ক্রেতা ভালো মানের পণ্য পাচ্ছে না। এটি হচ্ছে আনস্টেবল মার্কেটের ধরন। কিন্তু এই জায়গাটি যখন স্টেবল হয়ে যাবে, এ ধরনের সমস্যা আর থাকবে না বলেই মনে হয়।
ছবি: মাল্টিপ্লাই
লোকেশন: জমজমাট ক্যাফে