ফিচার I আদিবাসীদের ধর্মোৎসব
বাংলাদেশের নৃগোষ্ঠীগুলোর উপাসনারীতি যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনি উৎসবও। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের জীবনধারা ও প্রকৃতির গভীর সম্পর্ক। লিখেছেন মনোজ দেব
বাংলাদেশের আদিবাসীদের জীবন যেমন বৈচিত্র্যপূর্ণ, তেমনি তাদের ধর্মীয় রীতি এবং উৎসবগুলোরও রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। পাহাড় ও অরণ্যেই এদের বেশির ভাগ গোষ্ঠী বাস করে। তবে সমতলেও রয়েছে কিছু। এসব ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তার ধর্মাচারও তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির মতোই আলাদা। বাংলাদেশের প্রধান কয়েকটি আদিবাসীর ধর্মীয় রীতিনীতির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হলো।
চাকমারা এ দেশের সবচেয়ে জনবহুল জাতিসত্তা। তারা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। এ কারণে এই নৃগোষ্ঠীর লোকেরা নিজেদের মহামুনি বুদ্ধের বংশধর বলে দাবি করে। কারও কারও মতে ‘সাক’ অর্থ শাক্যমুনি, অর্থাৎ মহামান্য বুদ্ধদেব। ‘মা’ মানে রাজা। এই সাকমা শব্দ থেকে চাকমা কথাটি এসেছে। এই অর্থে শাক্য রাজবংশের রাজা মহামুনি বুদ্ধের বংশধর তারা। সাংসারিক কাজে সফলতা, রোগমুক্তি, ফসল ভালো হওয়া, সন্তান লাভ, পরকালে স্বর্গলাভ, নরক যন্ত্রণা থেকে অব্যাহতি ইত্যাদি নানা কারণে চাকমারা পূজার আয়োজন করে। এগুলোর মধ্যে চুঙুলাং, চক্রব্যূহ, থামিংটন, টাঙন-উৎসর্গ, ধর্মকাম বা জাদি, হাজার বাতি, ধানফং, গাঙ পূজা উল্লেখযোগ্য। যিনি পূজা পরিচালনা করেন তাকে বলে রড়ি। প্রতিটি পূজার রয়েছে একাধিক দেবদেবী। পরমেশ্বর, পরমেশ্বরী, গঙ্গা, বিয়াত্রা, থান, চাল্লোয়াদে, লক্ষ্মী, কালী, থাম্মাং, চেক্কোং, মগনি, শিজি, কলীজান্দুর, আনেষা প্রধান দেবদেবী। এদের তুষ্ট করতে শূকর, ছাগল, মুরগি, কবুতর বলি দেওয়া এবং নাচগানের আয়োজন করা হয়। চাকমাদের ধর্মগ্রন্থ পালি ভাষায় লেখা। সেসব নীতিকথা ও উপদেশে ভরপুর। পূজা উপলক্ষে রড়ি ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে শোনান।
আবার প্রতিটি পূর্ণিমা বৌদ্ধ ধর্মমতে পবিত্র। এ জন্য মারমাদের বেশির ভাগ পূজা-পার্বণ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান হয় পূর্ণিমায়। মাঘের এই দিনটিকে বলা হয় তাবুং লাবরে। দিবসটি তাদের কাছে খুবই পবিত্র। এ সময় গৌতম বুদ্ধ ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। মারমাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব থিনজিয়ানা তখন অনুষ্ঠিত হয়। এই নৃগোষ্ঠীর ধর্মগ্রন্থ থাদুত্তয়াং।
অন্যদিকে মুরংদের কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই। এ সম্পর্কে রয়েছে একটি কাহিনি- একবার সৃষ্টিকর্তা তুরাই সবাইকে ডাকলেন ধর্র্মগ্রন্থ নেওয়ার জন্য। সব জাতির লোকেরা গেল তার দরবারে। কিন্তু মুরংদের প্রতিনিধি হিসেবে কেউ সেখানে উপস্থিত হলো না। তুরাই অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে শেষে একটি ষাঁড়ের মাধ্যমে কলাপাতায় লেখা ধর্মগ্রন্থ এই জাতির কাছে পাঠালেন। পশুটি রাস্তায় খুব ক্ষুধার্ত হয়ে ধর্মীয় বিধিনিষেধসংবলিত পুস্তকটি খেয়ে ফেলে। এভাবে মুরংদের ধর্মগ্রন্থ হারিয়ে যায়। অবশেষে তারা সৃষ্টিকর্তার দরবারে গিয়ে ঘটনাটি জানতে পারে। তুরাই আদেশ দিলেন, ষাঁড়ের শাস্তি হিসেবে তারা যেন পশুটিকে হত্যা করে। সেই থেকে মুরংরা নস্যাৎ পা-এ নামক এক বিশেষ অনুষ্ঠানে ষাঁড় বলি দেয়। ফসল তোলার সময় এই উৎসব পালিত হয়। নির্দিষ্ট দিনে একটি ষাঁড় তারা যূপকাষ্ঠে বাঁধে। তারপর নারী-পুরুষ সবাই নাচের তালে তালে বাঁশের চোখা শলাকা দিয়ে পশুটিকে আঘাত করে। এভাবে সেটি মারা গেলে তার মাংস সেদ্ধ করে সবাই খায়। ষাঁড়ের জিহ্বাকে অত্যন্ত পবিত্র মনে করা হয়। কেননা, এই প্রত্যঙ্গ দিয়েই সে ধর্মগ্রন্থ খেয়েছিল। এ ছাড়া কুমলাং ও চম্পুয়া নামের দুটি অনুষ্ঠান মুরং সমাজে প্রচলিত। চম্পুয়া পালিত হয় গহিন জঙ্গলে কলাপাতা কেটে। কারণ, এতেই লেখা হয়েছিল ধর্মগ্রন্থ। তাদের কেনো ধর্মযাজক নেই, পূজা-পার্বণ থেকে অন্যান্য অনুষ্ঠান- সব তারা নিজেরাই সম্পন্ন করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ছড়িয়ে থাকা টিপরা সমাজ হিন্দুধর্মাবলম্বী। কিন্তু বাংলাদেশের উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে পূজা-পার্বণে, আচার-অনুষ্ঠানে এদের পার্থক্য আছে। তাদের ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে তুইবুক মা, তুইমা, মাইলুং মা, হাকামা, খুলুমরু, বুড়াশা, মাতাই চাংগরামু, কালাইয়া গরয়া উল্লেখযোগ্য। প্রথম দুটি গঙ্গাদেবীর পূজা, মাইলুং মা শস্যদেবী, হাকামা বনদেবী, খুলুমরু কার্পাস দেবী, বুড়াশা জুম দেবতার পূজা। প্রতিটি উৎসবে এই জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা শূকর, মহিষ, মোরগ-মুরগি বলি দেয়। পূজা পরিচালনা করেন আজাই বা আচাই।
প্রকৃতি পূজারি বা জড়বাদী নৃগোষ্ঠী হলো কুকি। বান্দরবান জেলার মধু, থানচি, রোমা অঞ্চলে এদের বসবাস। কুকিদের সৃষ্টিকর্তা পাথিয়ান, প্রধান দেবতা। তার আদেশেই পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে বলে এদের বিশ্বাস। তিনি থাকেন আকাশে। পাথিয়ান ছাড়াও কুকিদের অনেক দেবদেবী আছে। তাদের বিশ্বাস চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, পাহাড়, পর্বত, নদী, বন জঙ্গল- সবই পরিচালনা করে কোনো না কোনো দেবদেবী। এ কারণে তারা প্রকৃতি পূজারি। জুলাইতে পাথিয়ানের উদ্দেশে এদের প্রধান পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এর নাম চা-পূই চোললাই। এই দিন প্রথমে একটি শূকর বলি দেওয়ার নিয়ম। তারপর সবার বাড়িতে মোরগ মুরগি মেরে ভোজের আয়োজন করা হয়। পূজার জায়গায় চলে নাচ-গান। তা ছাড়া ফসল বোনার সময় তারা পালন করে আরেম পূজা। এপ্রিলে অনুষ্ঠিত এই পার্বণের দিন গ্রামের পশ্চিম দিকের জঙ্গলে একটি কুকুর এবং উত্তর দিকের জঙ্গলে শূকর হত্যা করা হয়। অতঃপর যুবক-যুবতীরা নেচে-গেয়ে এই দুই এলাকা ভ্রমণ করে। পরে পশু দুটির মাংস রান্না করে গহিন অরণ্যে আরেম দেবতার নামে উৎসর্গ করার রীতি পালিত হয়। এই পূজায় মেয়েদের অংশগ্রহণ মানা।
ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলে গারোদের বাস। এদের দুটি শ্রেণি- আচ্ছিক ও লামদানি। আচ্ছিক গারোরা পাহাড়ের গহিন অরণ্যে থাকে এবং লামদানিরা বাস করে সমতল ভূমির জঙ্গলে। এদের অনেকেই এখন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছে। তবে তাদের বিশ্বাস, পূজা-পার্বণে এখনো জড়বাদ বা ‘অ্যানিমিজম’-এর লক্ষণ রয়ে গেছে। গারোদের প্রধান দেবতা তাতারা রাবুগা। তার আদেশেই পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। সিলেট জেলায় বাস করে মণিপুরিরা। এরা বৈষ্ণবপন্থী হিন্দু। তবে তাদের মধ্যে সাধারণ হিন্দুধর্মের বিশ্বাস কাজ করলেও তারা আদিকালের ধর্ম, দেবতাবাদ এবং নানা রকম আচার পালন করে। নাচ তাদের ধর্মের অংশ এবং পবিত্র বলেও গণ্য। মণিপুরি নৃত্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য লাই হারাউবা। লাই অর্থ দেবতা, হারাউবা মানে সন্তুষ্ট করা। অর্থাৎ দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য যে নাচ। রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুরে বাস করে সাঁওতালরা। তারা জড়বাদী। প্রকৃতির আড়ালের বিভিন্ন শক্তিকে তারা দেবদেবী রূপে পূজা করে। তাদের প্রধান দেবতা ঠাকুরজিয়ো। তাকে কেউ ডাকে সিং বোঙ্গা, কেউ বলে সূর্য দেবতা। সাঁওতালরা বৈচিত্র্যময় নাচের মাধ্যমে বিভিন্ন দেবদেবীকে তুষ্ট করে। সব কাজে সফলতা পাওয়ার জন্যই তারা এটা করে থাকে।
ছবি: ইন্টারনেট