skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I রোমাঞ্চকর ঝাংজিয়াজিই

খাড়া পাহাড় আর বনভূমির যুগলবন্দি। সেখানে বিচিত্র পাখির কলতান। সবুজের মায়াবী হাতছানি। লিখেছেন ফাতিমা জাহান

কাচের ব্রিজের ওপর টলমল করে হাঁটছি। সবচেয়ে কাছের সবুজে ঘেরা সমতল হাজার ফুট নিচে। আমার আশপাশে কয়েকজন ইতিমধ্যে চিৎকার শুরু করেছে ভয়ে। সাধারণত এ ধরনের ব্রিজের মেঝে হয় শক্ত ইস্পাতের। এটি করা হয়েছে কাচের, যাতে নিচের জগৎ পরিষ্কার দেখা যায়, আর খানিকটা অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদও নেওয়া সম্ভব হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ গ্লাস ব্রিজের ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। চীন দেশে আসার আগে এ ব্রিজ সম্পর্কে জানতাম না। বেইজিং থেকে জেনে এসেছি। অবশ্য হুনান প্রদেশের ঝাংজিয়াজিই শহরে আসার প্ল্যান ছিল আগে থেকেই। এমন মায়াবী সারি সারি খাড়া পাহাড় চীন দেশ কেন, পৃথিবীতে খুব কমই আছে।
একসময় মনে হলো, পায়ের নিচে কাচ নেই, আছে স্বচ্ছ বরফখন্ড, রোদের আঁচে এক্ষুনি মাঝখানে চির ধরবে আর ব্রিজে দাঁড়িয়ে থাকা শ তিনেক দর্শনার্থী নিয়ে সবুজে শ্যামলে মাখামাখি করতে নিচে ঝুপঝাপ পতিত হবে। এই ধারণার পেছনে অবশ্যই দায়ী আমার সহযাত্রীরা। এ রকম রুদ্ধশ্বাস সেতু দেখে একটু-আধটু ভয় না পেলে সফরের রোমাঞ্চ কি আসে! ওদের দেখাদেখি হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম কাচ ভেদ করে নিচের বনভূমির চাক্ষুষ স্বাদ আস্বাদনের জন্য। আশপাশে কয়েকজন হামাগুড়ি দিয়ে সামনের দিকে যাচ্ছে। এদের দেখলে আর চীন দেশের বিখ্যাত সার্কাস দেখার প্রয়োজন পড়বে না। এ রকম স্বচ্ছন্দে স্বচ্ছ চরাচরে মুফতে ভেসে ভেসে নিচে পতিত হবার ভয় মিস করা উচিত নয় বলেই এরা সব জড়ো হয়েছে। আমার অবশ্য ভয় করছে না। অ্যাক্রোফোবিয়া নেই আমার। মজা করার জন্য পাশের আধবসা অবস্থায় থাকা একটা চীনা মেয়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমিও চিৎকার দিতে থাকলাম।
অবশ্য বেশি দূর সে এগোল না। দেড় হাজার ফুট লম্বা সেতু পদব্রজে ভ্রমণ করে আবার ফিরে এলাম।
এ বনভূমির সৌন্দর্য অনাদিকাল থেকে ভেসে আসা এক সবুজের সুগন্ধ যেন। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ের মাথা অবধি বিস্তৃত এ সেতু দেখলে অবশ্যই থ্রিলার মুভি ছাড়া আর কিছু মনে আসবে না। সাঁই সাঁই করে স্বচ্ছ চকচকে ব্রিজ পার হওয়া যায় এই ভেবে যে নিচে সেন্সর বসানো আছে ব্রিজ পার হবার জন্য। আহা, এমন যদি হতো!
ঝাংজিয়াজিই শহরে আসার সময় চীনের পাহাড়, নদী, গ্রাম, শহর দেখার জন্য বেইজিং থেকে রেল পথকেই সবচেয়ে আপন বলে মনে হয়েছিল। যখন এখানে পৌঁছালাম তখন ভরদুপুর, তবে চারপাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি ঝরছে গুঁড়ি গুঁড়ি। ঠান্ডাও পড়েছে জাঁকিয়ে। হোটেল অনলাইনে বুক করা ছিল, তাই খোঁজ করতে হয়নি। রিসেপশনে যে মেয়েটি বসে ছিল, তার নাম আন, বয়স আমার মতোই হবে। খুব হাসিখুশি আর বন্ধুত্বপূর্ণ স্বভাবের, হোটেলটা তার নিজের। সাক্ষাতেই ঝাংজিয়াজিই ন্যাশনাল পার্ক কীভাবে ঘুরে দেখতে হবে, তার খুঁটিনাটি সব তথ্য দিয়ে দিল।
বেরোলাম শহরটা দেখার জন্য। এখনো টুপটাপ ঝরে পড়ছে বৃষ্টি। আশপাশে সবাই রেইনকোট পরে, ছাতা মাথায়, পায়ে গামবুট গলিয়ে বেশ চলাফেরা করছে। পাহাড়ি এলাকা, যখন-তখন বৃষ্টি পড়া যেন হাওয়া বয়ে চলার মতোই স্বাভাবিক।
চীন দেশের অন্যান্য ঝাঁ-চকচকে শহরের মতো বিশাল ও আধুনিক নয় এলাকাটা। পাহাড়ি, মফস্বল শহরের গন্ধ লেগে আছে এর গায়ে ষোলো আনা। অল্প এগোলে বাজার। ছাউনি দেওয়া। এখানে প্রায় সবকিছুই পাওয়া যায়- শাকসবজি, মাছ, মাংস, কেক, বিস্কুট, ফল। দোকানিদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী। ভাবা যায়, মাংসের দোকানে ইয়া বড় চাপাতি হাতে একজন সুন্দরী নারী অবলীলায় মাংস খন্ডন করে চলেছে! অথবা কাচের বাক্স ভরতি কাঁকড়া-বিছে বিক্রি করছে অত্যন্ত রুচিশীল পোশাক পরিহিত আরেক নারী।
আরেকজন বিক্রি করছেন তাজা সবজি, তাকে খুব পছন্দ হলো। দেখে মনে হলো, আমার দাদিমার বয়সী হবেন, খুব স্মার্ট। সবজি বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে পাতায় মোড়ানো ডেলা বাঁধা ভাতজাতীয় খাবার গুটগুট করে খেয়ে যাচ্ছেন। আমি ছবি তুলতে চাইলে বেশ খুশি হলেন। আবার দেখাতেও হলো কেমন এসেছে ছবি। মফস্বলি আদবকায়দায় ভরপুর। কিন্তু এক বর্ণও ইংরেজি জানেন না। এতে আমার কোথাও কোনো অসুবিধে হয়নি। মন ভরে এদের সঙ্গে সময় কাটালাম। আরেকটু হলে সবজি বা মাংস বেচতেও বসে যেতাম।
কিন্তু শুধু আনন্দ করলে হবে না। কিছু খেতেও হবে। বাজারের পাশেই সারি সারি রেস্তোরাঁ।
এখানকার রেস্তোরাঁর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো বাইরের খোলা জায়গায় কাচের বাক্সে ভরা শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া, বিছে, ব্যাঙ ইত্যাদি রাখা আছে। যার যেটা পছন্দ বললেই সেটা অন্দরমহলে রাঁধুনি রেঁধে দেবেন। আজকে রিস্ক নেব না ভেবে রাইস নুডলস অর্ডার করলাম। আর বসে বসে বাইরের পাহাড়ি বৃষ্টি দেখে মন ভালো করলাম। চীন দেশে যেকোনো রেস্তোরাঁয় চা পরিবেশন করা হয় যে কাউকে। আমিও এক পেয়ালা গ্রিন টি পান করতে করতে সামনের বাক্সে রাখা ব্যাঙের ডাক শোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
খাবার এলো, পরিবেশনের পর প্লেটে রাখা বস্তুটিকে মোটেও নুডলস বলে মনে হচ্ছিল না। দেখতে আঙুলের মতো মোটা কিলবিলে সাদা হুকওয়ার্মের আরেক সংস্করণ লাগছিল। খাবার ভেবে খাব, তা-ও মনে হচ্ছিল মুখের ভেতরে মোটকা একটা কেঁচো নড়াচড়া করছে।
একটু হাঁটাহাঁটি করে ফিরে গেলাম হোটেলে। আন বলল, ‘ঝাংজিয়াজিই হলো বিশাল একটা বনভূমি, একা তোমার পক্ষে এক্সপ্লোর করা সম্ভব নয়; কারণ, কোথাও বাসে যেতে হয়, কোথাও রোপওয়ে বা কোথাও টয় ট্রেনে।’
হাতে মোটে তিন দিন সময় নিয়ে এসেছি। এত বড় পাহাড়ি বনভূমি কীভাবে দেখে শেষ করব! রাতে সেখানে থাকবার নিয়ম নেই। ফিরে আসতে হয়। ঢোঁক গিলে বললাম, ‘এখন উপায়?’
‘একজন গাইড সঙ্গে নাও। তোমার বেড়ানো খুব সহজ হয়ে যাবে।’
গাইডের তিন দিনের চার্জ শুনে মাথায় হাত, আমি বাজেট ট্রাভেলার, এতগুলো টাকা দিয়ে আস্ত একটা শহর দেখে ফেলতে পারি। ঠিক করলাম, এক দিনের জন্য গাইড সঙ্গে নেব। বাকি দিনগুলো নিজের মতো ঘুরে দেখব।
পরদিন ঠিক সকাল আটটায় গাইড লি এসে হাজির। রেইনকোট, ছাতা নিয়ে একেবারে প্রস্তুত।
আমরা চললাম ঝাংজিয়াজিই ন্যাশনাল ফরেস্ট পার্কের প্রবেশদ্বারের দিকে। হোটেল থেকে হেঁটেই যাওয়া যায়।
টিকিট কেটে ঢোকার পর লি বলল, ‘আমরা প্রথমে বাসে চেপে বনের মাঝখানে যাব। সেখানে লিফট আছে। লিফটে চড়ে পাহাড়ের মাথায় উঠব।’
লিফটে করে অনেক উঁচু ভবনে উঠেছি কিন্তু গহিন জঙ্গলে পাহাড়ের চূড়ায় চড়ে বসার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। বেশ থ্রিলিং মনে হচ্ছে।
বাস যত গভীরে যাচ্ছে, অরণ্য ততই সবুজ, আর মাথায় সাদা পাথরের মুকুট। কোথাও চুনাপাথরের সাদারঙা পাহাড় অথবা কোথাও হিম হিম ঝরে পড়া বাদল বেলা।
আধঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম পৃথিবীর সর্বোচ্চ এবং সর্ববৃহৎ এলিভেটরের কাছে। উচ্চতায় প্রায় এগারো শ ফুট। এ যেন ফিনিক্সের ডানায় চড়ে খোলা আকাশে উড়ে যাওয়া।
বায়লাং নাম এলিভেটরের, মানে ড্রাগন। চীন দেশে এসে জায়গায় জায়গায় ড্রাগন পাব না, সেকি হয়! ড্রাগন আমাকে নিয়ে হাওয়ার গতিতে ছুটল আকাশ পানে। চারদিকের সবুজ বন ধীরে ধীরে নিচের দিকে চলে যেতে লাগল। আর অন্যদিকে খুব যত্নে পাহাড় সাজিয়ে রেখেছে সামনে চলার পথ।
এলিভেটর থেকে নেমে খানিক হাঁটা পথ। লি চলতে চলতে বলল, ‘বিখ্যাত বলিউড মুভি অ্যাভাটারের শুটিং এখানে করা হয়েছিল।’ তাকিয়ে সামনে দেখি- আকাশ এখানে নিজের আরেকটি গোপন জানালা খুলে দিয়েছে আলগোছে। খাড়া খাড়া পাথরের স্তম্ভের মতোন আধা সবুজে ঢাকা পাহাড় মেঘের গভীরে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ এখানে আকুল হয়ে শোনে পাহাড়ের গল্প।
পাহাড়ের একদম ধারে রেলিং দেওয়া, যাতে দেখতে দেখতে, পথ চলতে চলতে কেউ পা পিছলে পড়ে না যায়। একেকটা পাহাড় যেন একেকটা স্তম্ভ, যেখানে পা দিয়ে কেবল ড্রাগন পার হতে পারবে, আমার মতো চার ফুট মানুষ নয়।
লি বলে চলেছে, ‘এই ভয়ানক খাড়া পাথরের পাহাড় দেখে অনেকেই মাথা ঘুরে পড়ে যায়।’
একেকটা পাহাড়কে ছোটবেলায় বইয়ে পড়া চীনা রূপকথা বলে মনে হয়। কোনোটা দেখতে গাছপালায় ঢাকা প্রাসাদের মতো, কোনোটা-বা অপ্সরীর জন্য বিছিয়ে রাখা বাগানের মতো।
এরপর আরও কিছুদূর যেতে হবে হেঁটে আর ট্রেক করে। ট্রেকিং আমার জীবনের সবচেয়ে পছন্দের অ্যাকটিভিটি। লি আছে বলে পথ খুঁজে নেওয়ার জন্য দিশেহারা হয়ে যেতে হয়নি।
আরও এগোই, পাহাড় খুলে দেয় তার বন্ধ দরজা। যেন আরও সামনে এগিয়ে ‘খুল যা সিম সিম’ বললেই রহস্যময় পাহাড় মাঝখান দিয়ে চিরে পথ তৈরি করে দেবে। অবশ্য সে জন্য আমাকে বারো শ ফুট নিচে নেমে যেতে হবে। এখন পাহাড়ের এক চূড়া থেকে অন্য চূড়ায় ট্রেকিং চলছে। প্রায় পুরোটা পথই পাকা করা। ন্যাশনাল পার্ক ঘোষণা করার পরপরই সরকার ভ্রমণার্থীদের সুবিধার জন্য পাকা পথ করে দিয়েছে। পা পিছলে পড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয় এই কঞ্চির ধারের মতো ধারালো খাড়া পাহাড় থেকে।
দুই ঘণ্টা ট্রেকিং করার পর লি বলল, এখন আমরা রোপওয়ে করে অন্য পাহাড়ে যাব। শুনে আমার বাচ্চাদের মতো হাততালি দিতে ইচ্ছে করল। লি বলল, ‘কিছু খেয়ে নাও, সামনে রেস্তোরাঁ।
তখন বেলা একটা, আমি এতই এক্সাইটেড যে খিদেতৃষ্ণা বোধ আর নেই। তবে ঘন জঙ্গলে নাগরিক সুবিধা সবই আছে দেখে একটু মিইয়ে গেলাম। এসব অবশ্য দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্যই করা। আমি হার্ড কোর ট্রাভেলার, যেখানেই যাই শুধু প্রকৃতির পায়ে নৈবেদ্য সাজাই।
কথায় কথায় রোপওয়ে চলে এসেছে।
অনেক দেশেই পাহাড়ি এলাকায় ভ্রমণার্থীদের মনোরঞ্জনের জন্য রোপওয়ে থাকে। কিন্তু ঝাংজিয়াজিই আমার জন্য এক অনন্যসাধারণ সীমানা, এক অজানা রোমাঞ্চ। কোনো এক অদ্ভুত কারণে এখন আশপাশের গাছগুলোকে আরও বেশি সবুজ লাগছে। চারপাশে মেঘের ছড়াছড়ি। হাত বাড়ালে মেঘ, পায়ে আটকে যাচ্ছে মেঘ!
রোপওয়েতে চড়ে এবার মনে হলো, আমি প্রাগৈতিহাসিক যুগের চীন দেশে চলে এসেছি, আশপাশে ধোঁয়াশা। মেঘের রাজ্যে, চেরি ফুলের দেশে নিয়ে যাচ্ছে যেন এক পঙ্খিরাজ। ধীরে ধীরে চলছে, কোনো তাড়া নেই। সমতলে দেখা মেলে জলাধার আর পাখির জগৎ।
রোপওয়ে নামিয়ে দিল ন্যাশনাল পার্কের মূল প্রবেশদ্বারের কাছাকাছি। এখান থেকে বাসে করে প্রবেশদ্বারে যেতে হবে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে। লি কে বিদায় জানাতে হবে সেখানে। লি বলল, কাছেই তার এক আন্টির বাড়ি আছে। আমি চাইলে ওর সঙ্গে যেতে পারি। লির কথা শুনে ঘাড় নেড়ে যেতে রাজি হলাম।
হেঁটে হেঁটে যাওয়ার পথে আবারও বৃষ্টি ধাওয়া করল। দুজন দৌড়ের প্রতিযোগিতা লাগালাম ছোটবেলার মতো। লি বলল, ‘রোজ কত ট্যুরিস্ট দেখি কিন্তু কেউ তোমার মতো নয়।’
আমি বলি, ‘জীবন একটাই লি। তাই ফুরিয়ে যাবার আগে যতটা পারা যায় নিজের ইচ্ছেমতো যাপন করতে হয়।’
আন্টির বাসায় তখন খাওয়াদাওয়ার পাট চুকেছে। সাধারণ গৃহস্থ ঘর। আসবাবের আড়ম্বর নেই। গৃহকর্মী টেবিল গোছাচ্ছেন খাবারের পর। আমাদের জন্য আরেক দফা খাবার দেওয়া হলো টেবিলে। কয়েক রকমের সবজি, ডিম, মাংস আর ভাত। খুবই স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে রান্না করা আর সুস্বাদু। আমাদের পাশে বসে গৃহকর্মীও ফল কেটে খাচ্ছেন। বেশ লাগল ব্যাপারটা, আমাদের দেশে এমনটা দেখা যায় না।
সন্ধ্যে অবধি ওদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে ঘনঘোর বারিধারায় ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে হোটেলে ফিরলাম। রাতে খেলাম আরেক রকমের ফ্ল্যাট রাইস নুডলস। খেতে সুস্বাদু। পেটেও সইল।
ঝাংজিয়াজিইতে তৃতীয় দিন। চলে গেলাম গ্লাস ব্রিজ দেখতে। মূল শহর থেকে বাসে করে যেতে হয় উলিনগিয়ান, সেখান থেকে পদযাত্রা।
বাসযাত্রা যেমন হবে ভেবেছিলাম মোটেও তেমন নয়, পথ পিচঢালা ঠিকই তবে সরু আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথের প্রতি মোড়ে একেকটা রহস্যের জট খুলে যাওয়ার মতো অ্যাডভেঞ্চার লুকিয়ে আছে। কখনো মনে হয় পথটা সবুজ কার্পেটের ওপর বিছানো, আবার কখনো সাদা মুক্তোর বেশে পথ রোধ করে দেয় মেঘ। তখন এক হাত সামনের কিছুই আর দেখা যায় না।
পাহাড়ের চূড়ায় গেলে নিচের পথ দেখতে হয়ে গেল একটা নদী, এঁকেবেঁকে বেশ মনের আনন্দে রোদে আর ছায়ায় ডুব দিচ্ছে যেন।
গ্লাস ব্রিজের গল্প তো প্রথমেই বলেছি। সামনে থেকে দেখে মনে হচ্ছিল, গড়িয়ে গড়িয়ে ব্রিজ পার হওয়া যাবে, নিচে দেখা মিলবে ভেজা মেঘের রাজ্য।
কাচের সেতু দেখার খুশিতে আটখানা হয়ে চললাম আরেক পাহাড়ে, যার গায়ে প্রকৃতি চাঁদ এঁকে দিয়েছে, মানে সে রকমই শুনে এসেছি। তিয়ানমিন নাম তার, গেলেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা কী। সেখানে যেতে হলেও বাসে করে হেলেদুলে পাড়ি দিতে হবে পাহাড়ি পথ।
চাঁদ পাহাড়ে গিয়ে দেখি, কথা নেহাতই মিথ্যে নয়। দুটো ত্রিভুজাকার পাহাড়ের মাঝখানে চাঁদের টিপ, মানে পাহাড়ের একেবারে কোলে গোল আয়নার মতো খোলা জানালা, যেটি দিয়ে সামনের জগৎ দেখতে পাওয়া যায়। পাহাড়েরও নিজস্ব, ব্যক্তিগত জানালা আছে! পাহাড়ও তবে উদাস হয় জানালা পেয়ে! আকাশের সঙ্গেও বুঝি খানিক মান-অভিমান হয়। এই মুখ ভার করা মেঘ, আবার ছাপিয়ে যাওয়া ঝলমলে রোদ।
পাহাড়ের জানালায় যাবার জন্য সিঁড়ি করে দেওয়া আছে। যে কেউ চাইলেই সেখানে গিয়ে নিজের অভিমানের কথা বলে আসতে পারে পাহাড়ের কানে কানে।
এই সব অদ্ভুত পাহাড় আর বনভূমিকে বিদায় জানিয়ে চললাম আবার শহরে, দুপুরে এখানকার বিখ্যাত আলু ভাজা খাওয়ার জন্য।
রেস্তোরাঁয় যখন আলু ভাজা সামনে এল তখন সত্যিই বলতে হয়, এত সুস্বাদু খাবার এবারের চীনযাত্রায় খাইনি। আলু মাংসের কিমা দিয়ে সঁতে করা। আর খুশবুতে মিশে আছে রাজকীয় ঘ্রাণ।
বাকি সময়টা ঝাংজিয়াজিই ন্যাশনাল পার্কের সমতলে ঘুরে কাটানোর জন্য উত্তম। তখনো টয় ট্রেনে চড়া হয়নি। ছোটবেলায় শিশুপার্কে, এরপর দার্জিলিং, শিমলার টয় ট্রেন- এই হলো আমার অভিজ্ঞতা।
এদের টয় ট্রেনটা আকারে শিশুপার্কের ট্রেনের চেয়ে সামান্য বড়। চলছেও বেশ ধীরেসুস্থে। আমারও তাড়া নেই। সন্ধ্যের আগে ফিরে গেলেই হলো পার্ক বন্ধ হওয়ার সময়, রাতে এখানে থাকার নিয়ম নেই।
ওপর থেকে বনভূমি যেমন শ্যামলিম শ্বাসরুদ্ধকর, সমতল থেকে এ বন যেন একটা মায়া। সবজে-নীল জলাধার, ঘন বা হালকা সবুজ গাছপালা, একটু মেঠো পথ আর কোথাও পাহাড়ি ঝর্নার মাতাল করা ঘ্রাণ নিয়ে চলে জঙ্গলের আরও গভীরে। একেকটা পাখির ডাক শুনলে মনে হয় যেন আমাকেই ডাকছে, ঠিকই পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে পরের কোনো ভুবনে। সবুজের যে এত রকম বৈচিত্র্য, তার ছিটেফোঁটাও বাইরের জগৎ জানে না। এই জঙ্গলে একটা জীবন পার করে দেওয়া যায় শুধু সবুজের একেকটা চাদর আর চাঁদোয়া দেখে দেখে।
এই রূপ কখনো বিলীন হয় না। প্রতিদিন নতুন ঐশ্বর্যে সামনে চলে আসে এক মোহময় হয়ে, মমতা মিশিয়ে বলে চলে লক্ষ কোটি বছরের পুরোনো বনভূমির গল্প।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top