skip to Main Content

ফিচার I মিষ্টান্নের ফিরিস্তি

বাঙালির মিষ্টিপদের তালিকা দীর্ঘ। কিছু এসেছে ভিনদেশ থেকে, আবার কোনোটি এই অঞ্চলের। এর উদ্ভবে জড়িয়ে আছে লোকশ্রুতিও

শেষ পাতে যেমন মিষ্টান্নের চল, তেমনি উৎসব-পার্বণেও। বাঙালি রসনায় অতিথি আপ্যায়নে এর উপস্থিতি। কোথাও বেড়াতে গেলে এ জাতি মিষ্টি নিয়েই যেত। এখন সেই রেওয়াজ কেবল উৎসবে এসে ঠেকেছে। বিশেষ আয়োজন ছাড়া বৈচিত্র্যপূর্ণ মিষ্টিগুলো আর চোখে পড়ে না। সেগুলোর কিছু অবশ্য এখনো টিকে আছে। আবার পুরোই হারিয়ে গেছে কিছু। অনেক মিষ্টান্নের রেসিপি উপেক্ষিত। তবে এ জাতির মিষ্টিপ্রীতিতে এখনো কমতি নেই।
শুরুতে বলতে হয় ফিরনি ও ক্ষীরের কথা। পিনাকী ভট্টাচার্য ‘খানা তল্লাশি’ বইয়ের ক্ষীর-পায়েস অনুচ্ছেদে ‘শির বিরিঞ্জ’ নামের এক প্রকার খাবারের কথা লিখেছেন। ফারসি ভাষায় ‘বিরিঞ্জ’ অর্থ চাল বা ভাত। বইটি থেকেই জানা যায়, পারস্যে দুধকে ‘শির’ বলা হয়। সেই অঞ্চলে চালের গুঁড়া, গোলাপজল ও পেস্তাবাদাম যোগে ফিরনি তৈরি হয়। এই রন্ধনপ্রণালি হাজার বছরের পুরোনো। ধারণা করা হয়, পারস্য থেকেই ফিরনি ও ক্ষীর রান্নার কৌশল সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে। তবে দুধ ও চালের সঙ্গে অন্যান্য অনুষঙ্গ মিশিয়ে শেষ পাতে পরিবেশনের এই পদ ভারতবর্ষে বৈদিক আমল থেকেই আছে। কালপর্বটি খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৫০০ অব্দ পর্যন্ত। চাল ও দুধের তৈরি খাবারটি ঘন করে রেঁধে পরিবেশন করলে বলা হয় ক্ষীর। পাতলা হলে ফিরনি। ক্ষীর বিষয়ে একটি লোককথা মিশে আছে দক্ষিণ ভারতের আম্বালাপ্পুজা মন্দিরের সঙ্গে। অনেক দিন আগে অঞ্চলটিতে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। সেখানকার রাজা ছিলেন প্রজাদের দুর্দশার ব্যাপারে উদাসীন। বেশির ভাগ সময় তিনি থাকতেন দাবা খেলায় মত্ত। তাই ভগবান কৃষ্ণ গরিব ব্রাহ্মণের বেশে মর্তে নেমে এসেছিলেন। তিনি রাজাকে দাবা খেলায় চ্যালেঞ্জ জানালেন। শর্ত দিলেন, পরাজিত হলে তাকে চাল দিতে হবে। দেওয়ার নিয়ম হলো- দাবার এক ঘরে যে পরিমাণ চাল দেওয়া হবে, পরের ঘরে তা দিতে হবে দ্বিগুণ। রাজা এই প্রস্তাবে রাজি হলেন এবং হেরে গেলেন। তারপর শর্তমতে ব্রাহ্মণকে চাল প্রদান করতে লাগলেন। কিন্তু দাবি মেটাতে গিয়ে দাবার ৪০ ঘর পূর্ণ করার পর রাজগোলা গেল খালি হয়ে! শেষ বর্গে পৌঁছাতে ব্রাহ্মণকে এখনকার হিসাবে দিতে হতো ১ কোটি ৮৪ লাখ ৪৭ হাজার ৭৪৪ ট্রিলিয়ন টন চাল! রাজা বুঝতে পারলেন, এই ব্রাহ্মণ সাধারণ কেউ নন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। ভগবান কৃষ্ণ তাকে এক শর্তে মাফ করেছিলেন। বলেছিলেন, আম্বালাপ্পুজা মন্দিরে ক্ষুধার্ত কেউ এলে তাকে যেন এক বাটি ক্ষীর দেওয়া হয়। এই হলো ক্ষীরের ফিরিস্তি; যা বাঙালির বেশ কিছু মিষ্টি তৈরির প্রধান অনুষঙ্গ। আরেকটি হচ্ছে ছানা। এটি মূলত টক বা অম্ল দিয়ে কেটে ফেলা দুধ। প্রণালিটিকে ভালো চোখে দেখত না আর্যরা। তাই ছানাকে দেবসেবা থেকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল প্রাচীনকালে। এমনকি আর্যবর্তে টক প্রয়োগে দুধ থেকে ছানা তৈরি করা পাপ হিসেবে গণ্য হতো। তবে সেটি মিষ্টি তৈরিতে ছানা ব্যবহারের পথে বাধা হতে পারেনি। যেমন ছানা দিয়ে তৈরি ঘিয়ে ভাজা মিষ্টি পানতোয়া। অনেকের মতে পানি তাওয়া তথা পাতলা রসে ডোবানো হয় বলে এমন নাম। রসগোল্লার পরেই এর ঠাঁই। প্রাচীন গ্রন্থ ‘ভাবপ্রকাশ’-এ দুগ্ধকূপিকা নামে একধরনের মিষ্টান্নের উল্লেখ আছে। এই পানতোয়া পরিবারের মিষ্টিই কালোজাম। এটির জন্য ছানা বেটে তা গোল করে পাকিয়ে ভেতরে ক্ষীরের পুর দিয়ে ঘিয়ে ভাজতে হয়। সে সময় ঘিয়ের মধ্যে অল্প অল্প চিনি দিলে স্বাদ আরও খোলে, পাশাপাশি রংটাও কালো হয়।
বলা হচ্ছে ক্ষীরের কথা। বেশ কিছু মিষ্টি তৈরিতে তা লাগে। তবে এর থেকে বানানো কিছু পদ বিলুপ্তপ্রায়। যেমন ক্ষীর থেকে ক্ষীরেলা। দুধ ক্রমাগত জ্বাল দিয়ে নরম ক্ষীর তৈরি করে নিতে হয়। এরপর এলাচির পুর দিয়ে ঘিয়ে ভাজতে হয় লালচে করে। দুই দশক আগে বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে এটি মিললেও এখন খুব কমই চোখে পড়ে। বাংলার আরেকটি বিলুপ্ত মিষ্টান্ন গঙ্গাজলী। এটি একপ্রকার নাড়ু। প্রণালি বেশ জটিল। নারকেল কোরিয়ে দুধ ঝরিয়ে নিতে হয়। তারপর চিনির গুঁড়ায় মিশিয়ে জ্বালাতে হবে। সঙ্গে লাগে কর্পূর। কিছুকাল আগেও বাংলায় এ ধরনের নাড়ু তৈরির চল ছিল। কিন্তু বানাতে অনেক পরিশ্রম বলে তা এখন আর কেউ তৈরি করে না।
এই অঞ্চলের আরেকটি বিখ্যাত মিষ্টি রসকদম্ব। কদম ফুলের মতো দেখতে এই মিষ্টির ভেতরে থাকে ছোট একটি রসগোল্লা। তার ওপর ক্ষীরের মোটা প্রলেপ। সারা গায়ে চিনি মাখানো পোস্তদানা। সুলতান হুসেন শাহের আমলে গৌড়ে গিয়েছিলেন চৈতন্যদেব। সেখানকার তেলিকদম্ব গাছের তলায় তিনি রূপ সনাতনকে দীক্ষা দেন। সেই কদম্ব গাছ থেকেই রসকদম্ব মিষ্টির সৃষ্টি বলে ধারণা করা হয়।
মিষ্টান্ন পদে রসের নাম এলেই মনে আসে রসগোল্লার কথা। এটি একান্তই বাঙালির মিষ্টি। এর উদ্ভব খুব বেশি দিনের পুরোনো নয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি, কলকাতায়। ১৮৬৬ সালে এই মিষ্টি বানানো শুরু হয় বলে জানা যায়। অবশ্য এ নিয়ে মতভেদ আছে। অনেকের ধারণা, এই মিষ্টির উদ্ভব নদীয়াতে, ১৮৪৬-৪৭ সালে।
আকারে বড়সড় একটি মিষ্টি হলো রাজভোগ। এটি মূলত বড় আকারের রসগোল্লা। তবে কিছু পার্থক্য আছে। রসগোল্লা জনসাধারণের পছন্দের মিষ্টি হয়ে যাওয়ায় সম্ভ্রান্তদের জন্য বড় করে সেটি তৈরি হতে থাকে। তা ছাড়া রাজভোগের ভেতরে ছোট একটি ক্ষীরের দানা দেওয়া থাকে।
জিলাপির মতো প্যাঁচানো দেখতে এক প্রকার মিষ্টি হলো আমৃতি। কলাইয়ের ডালের খোসা ছাড়িয়ে সেটির সঙ্গে ময়দা যোগে তৈরি হয় পদটি। পরে তেলে ভাজা হয়। এটিকে অঞ্চলভেদে আমিত্তিও বলে। বাংলার একধরনের মুচমুচে মিষ্টির নাম খাজা। অনেক প্রাচীন একটি পদ। এটি বানাতে ময়দায় বেশি ঘি দিয়ে ময়ান তৈরি করতে হয়। এরপর ভেজে চিনির শিরায় দেওয়ার নিয়ম। লম্বাটে রসাল মিষ্টির নাম চমচম। ছানার তৈরি এই খাদ্যের গায়ে শুকনা ক্ষীর মেশানো থাকে।
কিছু কিছু মিষ্টান্ন মুসলমানদের হাত ধরে এই অঞ্চলে এসেছে। যেমন ফালুদা। এটি হলো ঘন মিষ্টি পানীয়। পারস্য থেকে এ খাবার আসে বাংলায়। এ ছাড়া আছে বাতাসা। এটি মূলত সাদা। তবে গুড়ের বাতাসা লালচে। বাতাস থেকে বাতাসা। ফার্সি শব্দ। তবে মুসলমানরা এই অঞ্চলে আসার আগেও বাতাসা ছিল। তখন এটির নাম ছিল ফেনিকা। এখন ‘ফেনি বাতাসা’ নামে একধরনের বাতাসা মেলে। দেখতে সাধারণ মনে হলেও এর প্রণালি মোটেও সহজ নয়। প্রচুর খাটুনি আছে। তা ছাড়া যে কেউ এটি তৈরি করতে পারে না। অভিজ্ঞ হতে হয়।
ফল দিয়েও মিষ্টি পদ তৈরির রেওয়াজ আছে বাঙালি রসনায়, যাকে বলে মোরব্বা। এসেছে আরবি শব্দ ‘মুরব্বা’ থেকে, যার বাংলা মানে সংরক্ষণ করা। এই তাজা ফল মিষ্টির বিকল্প হিসেবে খাওয়া হয়। মোরব্বার উল্লেখ আছে আইন-ই-আকবরী-তেও। ধারণা করা হয়, সেটি চালকুমড়ার মোরব্বা। তা ছাড়া আছে মোহন ভাগ, যা এক প্রকার হালুয়া। মুসলমানরা আরব থেকে এ দেশে এনেছিল এই ‘হালওয়া’। তবে তার আগে থেকেই বাংলায় মোহনভোগ আছে বলে দাবি অনেকের।

 শিবলী আহমেদ
ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top