ফিচার I রন্টজেন
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন। যার অবদানের সুফল মানুষ আজও পাচ্ছে। কিন্তু কেমন ছিল তার জীবন? কীভাবে তিনি আবিষ্কার করলেন চিকিৎসার জন্য জরুরি উদ্ভাবনটি? লিখেছেন মনোজ দেব
এক্স-রে বদলে দিয়েছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের ধারা। গত এক শ পঁচিশ বছরের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ দশটি আবিষ্কারের মধ্যে এটি একটি। জার্মানির বিজ্ঞানী উইলহেলম কনরাড রন্টজেন ১৮৯৫ সালের ৮ নভেম্বর এমন একটি রশ্মির অস্তিত্ব অনুভব করেন, যা মানুষের বোধগম্য নয়। এটি এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে সে বছরটিকে পদার্থবিজ্ঞানের সূচনাকাল হিসেবে ধরা হয়।
রন্টজেন অজানা এই রশ্মির নাম দিয়েছিলেন এক্স-রে। কিন্তু আবিষ্কারটি হঠাৎ করে হয়নি। বিজ্ঞানের যেকোনো গবেষণার মধ্যে ধারাবাহিকতা থাকে। অর্থাৎ কৃতিত্ব এক বা দুজনকে দেওয়া হলেও অনেকেই প্রতিটি আবিষ্কারের পেছনে কাজ করেন।
উইলহেলম কনরাডের জন্ম ১৮৪৫-এর ২৭ মার্চ। তবে বিষয়টি শুরু হয়েছিল ১৮৮৭ সাল থেকে। সে বছর ইংরেজ পদার্থবিজ্ঞানী স্যার উইলিয়াম ক্রুক্স কাচের বড় নল দিয়ে একটি যন্ত্র তৈরি করেন। উদ্দেশ্য, বিদ্যুৎ নিয়ে গবেষণা। নলটির ভেতরে দুটো ইলেকট্রোড স্থাপন করেন তিনি। এটি হলো ব্যাটারির সঙ্গে যুক্ত দুটো ধাতব পাত। এর ধনাত্মক প্রান্ত অ্যানোড এবং ঋণাত্মকটি ক্যাথোড। পাম্পের সাহায্যে টিউবটি প্রায় বায়ুশূন্য করা হলে দেখা গেল, এক প্রান্তে সবুজাভ আলোর সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু বাতাসের মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহিত হয় না, ক্রুক্স তাই ভাবলেন, তিনি পদার্থের চতুর্থ অবস্থা আবিষ্কার করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিজ্ঞানীরা এই গবেষণায় যোগ দিলেন। প্রায় সবাই ভাবলেন, আলোর মতোই এটা কোনো রশ্মি। ক্যাথোড থেকে উৎপন্ন বলে নাম দেওয়া হলো ক্যাথোড রশ্মি।
১৮৬৯ সালে একজন বিজ্ঞানী ক্যাথোড রশ্মির পথে একটি ধাতব বস্তু স্থাপন করে দেখলেন, অ্যানোড প্রান্তে কাচের দেয়ালে তার ছায়া পড়েছে। বোঝা গেল এই রশ্মি সরল পথে গমন করে। ক্রুক্স এই আলোর গতিপথে চুম্বক স্থাপন করে দেখলেন, এই রশ্মি চুম্বকক্ষেত্র দিয়ে বিচ্যুত হয়। বিজ্ঞানী পেরিন দেখালেন, ক্যাথোড রশ্মির পথে পরিবাহী পদার্থ স্থাপন করলে তা ঋণাত্মক আধান লাভ করে। বিজ্ঞানীরা দুটো দলে ভাগ হয়ে গেলেন। একদল বললেন, ক্যাথোড রশ্মি আলোর মতো কোনো তরঙ্গ। আরেক দলের মত, এটি ঋণাত্মক আধানযুক্ত ক্ষুদ্র কোনো কণিকা দিয়ে গঠিত।
অন্যদিকে ১৮৯৫ সালের অক্টোবরে অধ্যাপক রন্টজেন ওয়ারজবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি কাটিয়ে ক্যাথোড রশ্মির বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তার আগ্রহ ছিল এর প্রতিপ্রভা বিষয়ে। এটি শিখাহীন আলো। রোদ উৎপন্ন হয় সূর্যের শিখা থেকে। আগুন থেকেও তা নির্গত হয়। কিন্তু প্লাটিনোসায়ানাইডের মতো কিছু বস্তুর ওপর ক্যাথোড রশ্মি পড়লে অল্প আলো সৃষ্টি হয়। একে বলে প্রতিপ্রভা। এটি পর্যবেক্ষণের জন্য রন্টজেন প্রায় অন্ধকার ঘরে কাজ করতেন। সবাই তখন ভেবেছিল, তিনি পাগল হয়ে গেছেন।
কাজের সুবিধার জন্য উইলহেলম কাচের নলটি কার্ডবোর্ড দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন। প্রায় তিন সপ্তাহ গবেষণার পর ৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় তিনি দেখলেন, ঘরের কোণে রাখা প্রতিপ্রভা কাগজ থেকে আলো নির্গত হচ্ছে, যা ৬ ফুট দূরেও দেখা যাচ্ছে। ক্যাথোড রশ্মির কারণে এটা হওয়া সম্ভব নয়। কেননা, এর ভেদন ক্ষমতা এত কম যে তা বাইরে আসতে পারে না। রন্টজেন ভাবলেন, অজানা কোনো রশ্মি যা এই যন্ত্র থেকে উৎপন্ন হচ্ছে এবং প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করছে। তিনি এর নাম দিলেন এক্স-রে। পরবর্তী সাত সপ্তাহ তিনি এর বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করেন। এই রশ্মির ভেদন ক্ষমতা দেখে রন্টজেন বিস্মিত হলেন। অবাক হয়ে দেখলেন, এক হাজার পৃষ্ঠার মোটা বই স্বচ্ছন্দে ভেদ করে যেতে পারে এই রশ্মি। দেড় মিলিমিটার পুরু সিসার পাত একে ধরে রাখতে পারে। বিস্ময়ের আরও বাকি ছিল, তিনি দেখলেন, প্রতিপ্রভার পর্দায় তার হাতের হাড়ের ছায়া পড়েছে।
রন্টজেন যে ঘরে কাজ করতেন, সেখানে কাঠের একটি টেবিল ছিল। তার ড্রয়ারে রাখা একটি ফটোগ্রাফিক প্লেট আপনা-আপনি এক্সপোজড হয়ে গেছে। দেখা গেল, ড্রয়ারে রাখা ধাতব একটি চাবির ছবি উঠেছে তাতে। উইলহেলম বুঝলেন, এক্স-রে রশ্মি দিয়ে ছবি তোলা সম্ভব। তিনি রশ্মির সেই যাত্রাপথে তার স্ত্রী আনার হাত মেলে ধরলেন। দেখলেন, দেয়ালে একটি ভৌতিক হাতের ছবি ভেসে উঠেছে। মাংস স্বচ্ছ হয়ে গেছে, কিন্তু অস্থিগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আর তাদের বিয়ের আংটির জায়গায় গাঢ় কালো রঙের ছায়া ফুটে আছে। এটি ছিল পৃথিবীর প্রথম রন্টজেনোগ্রাম। আজও বিজ্ঞানের বইতে আংটি পরা সেই হাতের ছবি ছাপা হয়।
১৮৯৫ সালের ২২ ডিসেম্বর রন্টজেনের ‘অন আ নিউ কাইন্ড অব এক্স-রে’ শিরোনামে একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ছাপা হয়। স্কুল থেকে বহিষ্কৃত ছাত্রটি রাতারাতি পৃথিবীবিখ্যাত বিজ্ঞানী হয়ে ওঠেন। এক বছরের মধ্যে এক্স-রে রশ্মির ওপর হাজারখানেকের বেশি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই আবিষ্কারের দু-তিন মাসের মধ্যে চিকিৎসকেরা রোগনির্ণয়ে এর ব্যবহার শুরু করেন।
দুই
রন্টজেন জন্মেছিলেন জার্মানির নিম্ন রাইন প্রদেশের লেনেপ অঞ্চলে। কাপড় বিক্রেতা বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। শৈশব কেটেছিল এখনকার নেদারল্যান্ডসের আপ্লেডুর্ন শহরে। গ্রামের প্রকৃতির মধ্যে ঘুরে বেড়াতে তিনি ভালোবাসতেন। পড়াশোনায় মনোযোগী না হলেও যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করতেন। এ কারণে তাকে একটি কারিগরি স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল। শ্রেণিকক্ষের ব্ল্যাকবোর্ডে স্কুলের এক শিক্ষকের ব্যঙ্গচিত্র আঁকার মিথ্যে অপরাধে উইলহেলম রন্টজেনকে বহিষ্কার করা হয়। ক্লাসের আরেক দুষ্টু ছাত্রের আঁকা এই ছবির কারণে তাকে স্কুল ত্যাগ করতে হলেও কারও করুণা সৃষ্টি হয়নি সেদিন। কিন্তু এ ঘটনা তার লেখাপড়ায় ছেদ টানতে পারেনি।
উচ্চশিক্ষায় তিনি বিষয় হিসেবে বেছে নেন পদার্থবিদ্যা, যদিও তা কিছুদিন পর ছেড়ে দিয়ে জুরিখ পলিটেকনিকে যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হন। এখানেই রন্টজেন যন্ত্রপাতির প্রতি কৈশোরের আগ্রহ আবার খুঁজে পান। লেখাপড়া শেষে গবেষণায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ১৮৬৯ সালে স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবন শুরু হয় ওয়ারজবুর্গ ও স্ট্রাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে। পরে তিনি গিসেন ইউনিভার্সিটিতে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছালে, জার্মান সরকারের বিশেষ অনুরোধে তিনি মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় নিয়োজিত হন। তবে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয়েছিল ওয়ারজবুর্গ ইউনিভার্সিটিতে। এখানে থাকতেই তিনি আবিষ্কার করেন রঞ্জন রশ্মি। যেটি তাকে ১৯০১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম নোবেল পুরস্কার এনে দেয়।
তিন
উইলহেলম কনরাড রন্টজেন ছিলেন সত্যিকারের গবেষক, বিজ্ঞানী। ব্যবসায়ী নন। তাই অনেকে তাকে এক্স-রে মেশিন নিজের নামে পেটেন্ট করার পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। রন্টজেন মনে করতেন, বিজ্ঞানের আবিষ্কার সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। জার্মান প্রকৌশলী কোম্পানি সিমেন্স ও হ্যালস্কি ১৮৯৬ সালে এক্স-রে মেশিনের গুরুত্ব বুঝতে পেরে এর পেটেন্ট করে। আজও তারা এটি তৈরি করছে। পৃথিবীর ১৯০টি দেশে তাদের অফিস আছে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, রন্টজেন শেষ বয়সে, ত্রিশের দশকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সময় দারুণ দারিদ্র্যের মধ্যে ১৯২৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।
শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মৃত্যুর পর তার যাবতীয় ব্যক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক নথিপত্র ধ্বংস করা হয়। এই অদ্ভুত চিন্তার পরও পৃথিবী থেকে রন্টজেনের নাম মুছে দেওয়া সম্ভব হয়নি; বরং তার বিস্ময়কর আবিষ্কারের সুফল পাচ্ছে বিশ্বের মানুষ।
ছবি: সংগ্রহ