ছুটিরঘণ্টা I তান ফুর নিসর্গে
পাহাড়শোভিত মেঘবৃষ্টির এক গ্রাম। মূল জনপদ থেকে দূরে। সেখানে প্রশান্তিকর প্রকৃতি ও মানুষ। আতিথেয়তার ঐশ্বর্য। লিখেছেন ফাতিমা জাহান
মেঘবৃষ্টির বেলায় কখন যে বেলা পড়ে এসেছে টের পাইনি। বিকেল হতে চলল। আরও ঘণ্টাখানেক হেঁটে পৌঁছালাম একটি আদিবাসী ঘরে। গ্রামের নাম ‘তান ফু’। আমাদের দেশে আগের দিনে গ্রামে যেমন মাটির মেঝে আর কাঠের ঘর দেখতে পাওয়া যেত, এখানেও তা-ই। ঘরের সামনে বাঁশের বেড়া।
ততক্ষণে প্রবল বেগে পাহাড়-পর্বত ছাপিয়ে বৃষ্টি জোরে জোরে মল্লার গাইতে শুরু করেছে। বিকেলে স্থানীয় বাজার দেখতে যাবার কথা ছিল, কিন্তু এই ঘন বরিষণে তার উপায় নেই। ঘরের দাওয়ায় তখন সারি বেঁধে আমার ট্রেকার বন্ধুরা বসে গেছে। যাদের বাড়ি, তারাও বেশ আয়োজন করে চা খাওয়াচ্ছে আমাদের। তখন খেয়াল হলো হাঁটুতে চোট পাওয়ার কারণে পা ভাঁজ করে বসতে পারছি না। এখানে কাঠের মেঝেতে সবার জন্য ঢালাও বিছানা। আমি সে কথা সাওকে জানালাম, এ-ও বললাম যে আমার ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন। এদের কারও কাছে ওষুধ নেই। এই গ্রামে একজনের কাছেই তা পাওয়া যায়। আর ডাক্তারের কথা ভুলে যেতে হবে; কারণ, সা পা শহর ছাড়া আশপাশে চিকিৎসকের নাম কখনো কেউ শোনেনি। তখন তল্পিতল্পা নিয়ে চললাম আরেকটি হোম স্টেতে থাকতে, যার কাছে ওষুধ আছে।
সাও আমাকে এখানে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। এই হোম স্টে যে মিষ্টি মেয়েটি চালায় তার নাম ভান। বয়স পঁচিশ। সব সময় হাসছে। বিশাল দোতলা পাকা বাড়িতে এই মুহূর্তে একা আছে, আজকে তার অন্য কোনো গেস্ট নেই। ভান নিজে কিন আদিবাসী গোষ্ঠীর। ওর বাবা-মা গাঁয়ের অন্য প্রান্তে থাকে। ভান জাপান থেকে পড়াশোনা করে এসে নিজের গ্রামে হোম স্টে খুলেছে। ভিয়েতনামীদের দেশপ্রেমের প্রতি আমার শ্রদ্ধা প্রতিদিনই একটু একটু বাড়ছে।
এই বাদল দিনে ভানের বাড়িতে সে আর আমি। সন্ধ্যা হতেই বৃষ্টির ধারা আরও জোরদার হলো। ট্রেকিংয়ের সময় কিছু বোঝা না গেলেও এখন তাপমাত্রা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের মতো এখানেও সন্ধ্যার পরপরই বিদ্যুৎ চলে গেল। আমি আর ভান মোমবাতির আলোয় জমিয়ে আড্ডা শুরু করলাম। মাঝে মাঝে তার হোম স্টেতে তিলধারণের জায়গা থাকে না। এমনিতে রোজ তার বড় বোন এসে তাকে রান্নাঘরের কাজে সাহায্য করে। কারণ, সব অতিথির জন্য রান্না ভান আর তার সহকর্মী করে। আজ সহকর্মীও নেই। আমি এতে খুবই আনন্দিত। এ রকম নির্জন পাহাড়ি এলাকায়, শান্ত একটা বাড়িতে কয়েক দিন মনের মতো করে কাটানো যাবে, এখানকার আদিবাসী জীবনকে আরও কাছ থেকে দেখা হবে। কিন্তু ততক্ষণে হাঁটুর ব্যথাও টাটিয়ে উঠেছে, ভানের দেয়া ওষুধে কাজ হয়নি। সে বলল, ‘পাশের গাঁয়ে একজন নার্স বাস করেন। যদি তিনি শহর থেকে ছুটিতে এসে থাকেন, তবে দেখে বলতে পারবেন পা ভেঙেছে কি না।’
ভান যত বিচলিত আমার পা নিয়ে, আমি তার একবিন্দুও নই। এই পাহাড়ে কয়েক দিন কাটিয়ে তবেই আমি ফিরছি।
রাতে সে নিজে রান্না করল ৫/৬ রকমের খাবার।
খুব সকালে ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। এত শীতেও বিহঙ্গ ডাকে নাকি। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি আকাশ হাসছে, মেঘ কোথায় যেন বেড়াতে গেছে আজ। এমন ঝকঝকে আকাশকে উপেক্ষা করা যায় না। উঠে পড়লাম। দেখলাম ভান কফি তৈরি করে বসে আছে।
গতকাল খেয়াল করিনি, আশপাশের প্রকৃতি আর ভানের হোম স্টে- সব মিলিয়ে এ জায়গাটা যেকোনো পাহাড়ি ফাইভ স্টার রিসোর্টকে হার মানাবে। পাহাড়ের ওপর বাড়িটা, সামনে ধানক্ষেতের সবুজ গন্ধ, এরপর একটু একটু করে ওপরে চোখ মেলে চাওয়া যায় পাহাড়ের ঘন বনভূমিতে। এরও ওপরে গাঢ়তর হচ্ছে নীল আকাশ। আর নিচে গভীর প্রেমে পাহাড়কে জড়িয়ে রেখেছে সবুজ ধানক্ষেত।
কাঠের তৈরি বারান্দা আর তাতে একফালি নরম রোদ গলে আঁকিবুঁকি করছে আমার পায়ের কাছে।
নাশতা শেষে নাছোড়বান্দা ভান আমাকে নিয়ে চলল সেই নার্সের বাড়িতে। হেঁটেই যেতে হয় সব জায়গায়। কিন্তু এই পথটা হাঁটতে গিয়ে গতি ধীর হয়ে গিয়েছিল। ভ্রমণে বিভিন্ন সময় ছোট-বড় দুর্ঘটনায় পড়তে হয়েছে কয়েকবার। এসব নতুন কিছু নয় আমার জন্য। নার্স বাড়িতেই ছিলেন। হাঁটু টিপেটুপে বললেন, ‘ভাঙেনি, মচকেছে। ওষুধ দিচ্ছি, ব্যথা কমে যাবে।’
এই সংবাদে ভান এমন খুশি হলো যেন ভিয়েতনাম বিশ্বকাপ ফুটবল ম্যাচ জিতেছে। ওষুধ নিয়ে হোম স্টেতে ফিরে শুরু হলো তার খবরদারি- এটা করা যাবে না, ওখানে যাওয়া যাবে না। ভালোই লাগছিল এমন আদর পেয়ে।
দুপুর অবধি বারান্দায় বসে বসে রোদ পোহালাম, শীত আর ঠান্ডা হাওয়ার গল্প শুনলাম। দুপুরে আবারও ভানের হাতের সুস্বাদু খাবার খেয়ে হাত-পা একেবারে চাঙা হয়ে উঠল আর আশ্চর্য যে আমার পায়ের ব্যথা একদম কমে গেল। এবার অবশ্যই বাইরে বের হওয়া যায়। এখানকার বাজারে যেতেই হবে। কী সুন্দর রঙিন জীবন এদের!
ভান শুনে রাগী অভিভাবকের মতো কটমট করে তাকিয়ে যাবার অনুমতি দিল আর দশ মিনিটের মধ্যে সাও এসে আমাকে নিয়ে বাজারের দিকে রওনা হলো। সেখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। সবুজ প্রকৃতি সব জায়গায় ছেয়ে আছে, তাই সারা দিন হেঁটে বেড়ানো যায়। অবশ্য তার অর্থও পাহাড়ের চড়াই-উতরাই পার হওয়া।
বাজারে রঙের মেলা বসেছে। যারা সবজি, ফল বা বিভিন্ন কারুশিল্প নিয়ে এসেছেন বিক্রি করতে, সবাই নারী। তারা একই ধরনের পোশাক পরেছেন। গোলাপি জ্যাকেট, গোলাপি স্কার্ট আর মাথায় একই রঙের স্কার্ফ। দূর থেকে রঙিন বনভূমি বলে মনে হচ্ছে। সবাই হাসিখুশি, বিশাল আকারের রুপোর গয়না পরে হেসে এর-ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ছে। পোশাকগুলো নিজেদের হাতে তৈরি। একধরনের ব্রোকেড কাপড় তাঁতে বুনে এতে এমব্রয়ডারি করা হয়েছে। একই ফ্যাব্রিক দিয়েই বানানো হয় নারী-পুরুষের পরিধেয়। পুরুষেরা অবশ্য বেশির ভাগই কালো পোশাক পরে। আর এই ঐতিহ্যবাহী কাপড় এরা পরে বাজারে এসেছে সম্ভবত বিদেশি ভ্রমণার্থীদের মনোরঞ্জনের জন্য। এর বাইরে গ্রামে সবাই সাধারণ পোশাক পরে থাকে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিসই এদের নিজেদের তৈরি। এই দুর্গম গ্রামে প্রয়োজনীয় উপকরণ নিজেরা তৈরি করা ছাড়া উপায়ও নেই। ফানসিপানে কোনো স্কুল, হাসপাতাল নেই। বাচ্চারা পড়তে সা পা-এর কাছাকাছি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায়।
বাজার ঘুরে, তাদের তাঁতশিল্প দেখে হোম স্টে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। গতকালের মতো আজও ঠান্ডা জাঁকিয়ে পড়েছে। আমিও জমিয়ে আড্ডা শুরু করলাম ভানের সঙ্গে। ফানসিপান নাকি ভিয়েতনামের একমাত্র জায়গা, যেখানে শীতকালে বরফ পড়ে।
আজ ভানের বোন আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। তাই রান্নার কাজ থেকে তার ছুটি। এই হোম স্টে বলতে গেলে আমার নিজের বাড়ির মতো হয়ে গেছে।
সন্ধ্যার আলাদা একটা রং আছে। আজ আকাশও উদার, কোনো রকম ঝগড়াঝাঁটি করেনি মেঘের সঙ্গে। তাই পরিষ্কার নীল আকাশে এক টুকরো সূর্য বেশ আমোদে ডুবে গেল।
পরদিন সারাটা সময় বারান্দায় বসে প্রকৃতি দেখার দিন। এরকম নিঃসংকোচ পাহাড়ি নির্জনতা আগে কোথাও দেখিনি। সবুজ আর হলুদে নেয়ে ধানক্ষেতের নেচে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যখন পাল্লা দিয়ে বাতাস ছুটে বেড়ায়, তখন মনে হয় এই নিষ্কলুষ, আনকোরা দৃশ্য দেখার জন্যই বেঁচে ছিলাম এত দিন। পাহাড়ি প্রকৃতি আপন মনে তার গান শোনানোর জন্যই ডেকে এনেছে আমাকে, এখানে। সবুজ আর নীলে মিলেমিশে যে তরঙ্গ বয়ে চলছে, তা যুগ যুগ ধরে আটকে রেখেছে কোনো এক পথিক দেখবে বলে, একেবারে অজানা, অচেনা জনপদকে আপন করে নেওয়ার জন্য।
ছবি: লেখক