ফিচার I নাসিরুদ্দিন হোজ্জা
নিছক হাস্যরসই তার গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য নয়। তাতে সমাজবাস্তবতাও প্রতিফলিত। কিংবদন্তি এই ব্যক্তি জীবনের নানা প্রশ্নে আজও প্রাসঙ্গিক
হাস্যরসাত্মক, বুদ্ধিদীপ্ত অথবা বোকামির নানান গল্পের ঝাঁপি খুলে সবার মন জয় করেছেন নাসিরুদ্দিন হোজ্জা। তার নাম শোনেনি এমন মানুষ বিরল। পৃথিবীর সব প্রান্তেই তার মজার কাহিনিগুলো ছড়িয়ে রয়েছে। বেশ আগে থেকেই তিনি কিংবদন্তির মর্যাদা পেয়ে আসছেন। তার জীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানা না গেলেও ধারণা করা হয়, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুরস্কের এসকিসেহির প্রদেশে সিভ্রিহিসার শহরে জন্মগ্রহণ করেন। আবার কারও কারও মতে, তিনি জন্মেছিলেন পশ্চিম আজারবাইজান অঞ্চলের খোয় বা খোর্তো গ্রামে। আফগানরা মনে করে, হোজ্জা তাদের এলাকার লোক। দেশভেদে নাসিরুদ্দিন ভিন্ন ভিন্ন নামেও পরিচিত। যেমন উজবেকিস্তান ও চীনে তাকে ডাকা হয় আফেন্দি বা এফেন্দি। মোল্লা নামেও তাকে অভিহিত করা হয়। কেউ কেউ আবার তাকে লোককথার চরিত্র রূপে উল্লেখ করেছেন। তবে হোজ্জা-গবেষক অধ্যাপক মিকাইল বায়ারাম জানিয়েছেন, এই মানুষটির পুরো নাম নাসির উদ্দীন মাহমুদ আল খায়ি এবং তিনি তুরস্কের লোক। সেখানকার এসকিসেহির শহরে প্রতিবছরের ৫-১০ জুলাই উদ্যাপন করা হয় ‘আন্তর্জাতিক নাসিরুদ্দিন হোজ্জা উৎসব’।
এই নামে কোনো ব্যক্তি বাস্তবে ছিলেন কি না, এ নিয়ে নানান তর্ক রয়েছে। ভারতবর্ষে যেমন গোপল ভাঁড়ের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন মত প্রচলিত, নাসিরুদ্দিন হোজ্জারও স্ত্রীকে দেখা যায় গল্পের চরিত্র হিসেবে। কিন্তু তাদের কোনো সন্তানের কথা কোথাও শোনা যায় না।
তবে কোনো স্থানিক পরিচয়ে হোজ্জাকে আটকে রাখা যায়নি। তার নির্মল রসবোধ ও একই সঙ্গে শিক্ষণীয় গল্পে আকৃষ্ট হয়েছে শিশু-কিশোর থেকে বয়স্করাও। এসব কাহিনিতে তিনি হাজির হয়েছেন বিভিন্ন চরিত্রে ও পেশায়- কখনো বিচারক বা কাজি, কখনো ইসলামের নানা নিগূঢ় বিষয়ে প-িত হিসেবে। তার উপস্থিত বুদ্ধি ও বিজ্ঞতার খ্যাতি দেশকালের সীমা ছাড়িয়েছে। এ কারণে ইউনেসকো হোজ্জার গল্পগুলোকে বিশ্বসাহিত্যিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে। যদিও কোনো কোনো গল্পে তাকে দেখা গেছে অত্যন্ত বোকা ও সাদাসিধে মানুষ হিসেবে। কখনো ব্যঙ্গ করেছেন নিজেকেই। কিন্তু সেসব কাহিনিও আনন্দ দিয়েছে শ্রোতা এবং পাঠককে।
পোশাক ও অন্যান্য অনুষঙ্গেও নাসিরুদ্দিন হোজ্জা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ছোটখাটো, বেঁটে মানুষটি মাথায় পরতেন পাগড়ি, যেটি ছিল বেশ বড়সড়। ফলে দেখতে দশাসই মনে হতো। গায়ে দিতেন জোব্বা। আর তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল একটা গাধা। এই প্রাণীটিও অনেক সময় হোজ্জার গল্পের চরিত্র হয়ে উঠেছে। যেমন এমনই একটি গল্প :
‘বিবির পীড়াপীড়িতে হোজ্জা একটা গরু কিনল। কিন্তু গরু ও গাধার জন্য গোয়ালঘরে জায়গা না থাকায়, একটা ঘুমালে আরেকটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। প্রিয় গাধার এই দুরবস্থা দেখে হোজ্জা একদিন খোদার কাছে প্রার্থনা করল- হে আল্লাহ, দয়া করে গরুটাকে মেরে ফেলো, যাতে আমার গাধাটা একটু আরাম করে ঘুমাতে পারে।
পরদিন সকালে সে গোয়ালঘরে গিয়ে দেখে, গাধাটা মরে পড়ে আছে। প্রাণপ্রিয় গাধার মৃত্যুতে হতাশ হয়ে হোজ্জা মন খারাপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল- কোনো অভিযোগ করব না, খোদা। কিন্তু তুমি সারা দুনিয়ার মালিক হয়েও কোনটা গাধা আর কোনটা গরু- এইটা চিনলে না!’
হোজ্জার এসব কিংবদন্তি এবং গল্প তুরস্কের বাইরে বাংলাদেশ, ভারতসহ মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে ব্যাপক প্রচলিত। অন্যদিকে ইউরোপের গ্রিস, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, জার্মানিতেও সমাদৃত। চীনেও তার কিংবদন্তি বেশ জনপ্রিয়। সেখানকার উইঘুর মুসলমানদের দাবি, নাসিরুদ্দিনের জন্ম ও কাজের ক্ষেত্র তাদের অঞ্চলেই ছিল। আগেই বলা হয়েছে, এখানে তার পদবি এফেন্দি, অর্থাৎ সম্মানিত ব্যক্তি। মধ্য এশিয়ায় জ্ঞানীদের এই নামে অভিহিত করার রেওয়াজ রয়েছে।
নাসিরুদ্দিন যে জ্ঞানী ছিলেন, তার নামে প্রচলিত গল্পেই তা প্রতিফলিত। এ কারণে অনেকেই তার কাছে আসত পরামর্শ নেওয়ার জন্য। কেবল তা-ই নয়, হাতেকলমে শিক্ষাও দিতেন। বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতেন উপস্থিত বুদ্ধির জোরে। আবার অন্যকে বিব্রত করতেও তার জুড়ি ছিল না। এমন একটি কাহিনি :
‘একবার হোজ্জার এক বন্ধু বেড়াতে এলো তার বাড়িতে। বিকেলে দুজনে মিলে ঘুরতে বের হবে, কিন্তু বন্ধুর ভালো জোব্বা ছিল না। হোজ্জা তাকে নিজের একটি জোব্বা পরতে দিল।
প্রথমে তারা এক বন্ধুর বাড়িতে গেল। খাওয়াদাওয়ার পর হোজ্জা বলল, আমার বন্ধুর গায়ে যে জোব্বা, সেটা ওর না, আমার। সেই বাড়ি থেকে বের হয়ে বন্ধুটি হোজ্জাকে বলল, জোব্বাটা তোমার এটা বলার দরকার ছিল? হোজ্জা বলল, আচ্ছা, এ কথা আমি আর বলব না।
দ্বিতীয় বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ফেরার সময় হোজ্জা বলল, আমার বন্ধুর গায়ে যে জোব্বা সেটা আমার না, ওটা ওর। গৃহকর্তা এ কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। বাড়িতে থেকে বেরিয়ে বন্ধুটি বলল, জোব্বাটা আমার না তোমার- এ কথা বলার দরকার ছিল? হোজ্জা বলল, আচ্ছা, জোব্বাটা আমার না তোমার; এ কথা আমি আর বলব না।
তারপর তৃতীয় বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে হোজ্জা বলল, আমার বন্ধুর গায়ে যে জোব্বা, সেটা আমার না ওর; এ নিয়ে আমি কোনো কথা বলব না। হোজ্জার কথা শুনে গৃহকর্তা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
প্রায়শই হোজ্জা এমন অদ্ভুত আচরণ প্রকাশ করে বা কথা বলে অন্যকে বিব্রতই করতেন না, স্ত্রীকে বোকা বানিয়ে অথবা কথার ফাঁদে ফেলে বেশ মজাও নিতেন। কিন্তু এ সবকিছুর পেছনে ছিল তার গভীর জীবনবোধ। অনেকের ধারণা, এসব গল্পের কোনো কোনো বক্তব্যে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে সুফিবাদের অনুপ্রেরণা। অন্যদিকে সেসবে আছে সমাজে প্রচলিত সত্যের প্রতি তীব্র কটাক্ষ। যেগুলো সাধারণভাবে হাস্যরসাত্মক বলে মনে হলেও এর মধ্যে নিহিত আছে গভীর অর্থ।
বৈশিষ্ট্য বিচারে হোজ্জার গল্পগুলো তিন ধরনের। প্রথমত, তিনি উপস্থিত বুদ্ধি ও চতুরতা দিয়ে অন্যকে বোকা বানাচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, সাধারণ কোনো প্রশ্ন বা সমস্যার অদ্ভুত সমাধান দিয়ে প্রতিপক্ষকে নিরস্ত করছেন। তৃতীয়ত, তিনি নিজেই বোকা সেজে বসেছেন। এসব গল্প এতই জনপ্রিয় যে ১৯৬৮ সালে ‘দ্য প্লেজানটারিজ অব দ্য ইনক্রেডিবল মোল্লা নাসিরুদ্দিন’ নামে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন ভাষায় সেটি অনূদিত হয়েছে। সত্যজিৎ রায়ও ‘মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প’ নামে একটি সংগ্রহ বের করেছিলেন। বাংলাদেশে একসময় রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের কচি-কাঁচার আসরে সেসব গল্প ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতো। পরবর্তীকালে ‘ভিনদেশি এক বীরবল’ নামে একটি সংকলনে মুদ্রিত হয় নির্মল ও হাস্যরসাত্মক সেই গল্পগুলো।
লাইফস্টাইল ডেস্ক
ছবি : সংগ্রহ