ফিচার I মৃৎপাত্র
পরিবেশের অনুকূল ও স্বাস্থ্যবান্ধব এই দ্রব্যাদির ইতিহাস বহু পুরোনো। একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বিশেষ এক শ্রেণি। আজ তা প্রায় অপসৃত। লিখেছেন মনোজ দেব
মাটির তৈজসপত্রের ইতিহাস মানবসভ্যতার মতোই প্রাচীন। প্রত্নতত্ত্ববিদ জেমস্ মেলার্ট তুরস্কের আনাতোলিয়া উপত্যকা খনন করে ১৯৬০ সালের প্রথম দিকে নানান ধরনের মাটির পাত্র উদ্ধার করেন। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অনুমান করা হয়, পাত্রগুলো কমপক্ষে ৯ হাজার বছর আগের তৈরি। খ্রিস্টপূর্ব সাড়ে ছয় হাজার অব্দে আরও উন্নত মানের হাতে তৈরি, পোড়ানো এবং রং করা মৃৎপাত্রও একই জায়গা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার উর অঞ্চলে মাটি খুঁড়ে প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার লিওনার্দ উলে তিন হাজার বছর আগের তৈরি মাটির তৈজস আবিষ্কার করেন।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত বাঙালি ঐতিহাসিক, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও লেখক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ননীগোপাল মজুমদার সিন্ধু ও পাঞ্জাব প্রদেশে মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করেন মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা সভ্যতা। এর ধ্বংসাবশেষ থেকেও মৃৎশিল্পের অনেক নমুনা পাওয়া গেছে। সেগুলোর মধ্যে তৈজসপত্রও ছিল। বেলুচিস্তানের কোয়েটা, মাল ও কুল্লিতে পাওয়া গেছে মেটে রঙের নানা ধরনের মৃৎপাত্র।
মৌর্য, কুষাণ ও গুপ্ত যুগের বিভিন্ন মৃৎপাত্রের নমুনা পাওয়া গেছে মাটি খুঁড়ে। এসব মৃৎশিল্পের মাধ্যমে সে যুগের মানুষের জীবন-যাপনের ইতিহাস জানা সম্ভব হয়েছে। বৈদিক যুগে প্রতিমা পূজার প্রথা ছিল, এ কারণে তখনকার পোড়ামাটির অনেক প্রতিমা উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে মৃৎপাত্রের ধারাবাহিকতা ও বিকাশ ওই ঐতিহ্যেরই ফল বলে মনে করা হয়।
গঙ্গা-যমুনা উপত্যকা ও মধ্যভারতজুড়ে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে শুরু করে দ্বিতীয়-তৃতীয় খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পোড়ামাটির যে শিল্পধারা গড়ে উঠেছিল মহাস্থানগড়, ময়নামতি, পাহাড়পুর, পোখরান, তমলুক, মেদিনীপুর, বর্ধমান, হুগলি, বীরভূম প্রভৃতি এলাকায়; আবিষ্কৃত প্রাচীন পোড়ামাটির ফলকে তারই সুস্পষ্ট প্রতিফলন ধরা পড়ে। উত্তরবঙ্গের অন্যান্য জায়গার মধ্যে দিনাজপুর জেলার সীতাকোট বিহার, রংপুর জেলার বোগদহ, সিরাজগঞ্জ জেলার তারাস থানার নিমগাছি, রাজশাহীর বিজয়নগর, নওগাঁর ধামইরহাট, বগুড়ার ক্ষেতলাল, নীলফামারীর ধর্মপালগড়েও একই ধরনের শিল্পকর্ম পাওয়া গেছে। এসব মৃৎশিল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল তৈজসপত্র। ঢাকার অদূরে নরসিংদী জেলার উয়ারী ও বটেশ্বরে পোড়ামাটির শিল্পকর্মের মধ্যে মিলেছে মৃৎপাত্র। এগুলো বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে উত্তর অঞ্চলীয় কালো মসৃণ, রোলেটেড এবং নব্যুক্ত।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া মাটির তৈজসের নানান নমুনা দেখে ধারণা করা যায়, এ শিল্প প্রাচীনকাল থেকেই বিকশিত হয়ে আসছে। এর পেছনে রয়েছে এ দেশের পেশাজীবী মানুষের অবদান। বৈদিক কাল থেকে কুম্ভকার বা কুমার নামে পরিচিত এই পেশাজীবী শ্রেণির উপাধি ‘পাল’। তবে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার জোবরা গ্রামে, উখিয়া থানার রাজাপালে, নোয়াখালী অঞ্চলে অনেক মুসলমান মৃৎশিল্পী বাস করে। এদের উপাধি ‘কুলাল’। কিন্তু এসব মৃৎশিল্পী আধুনিক কালের উঠতি নব্য পুঁজিবাদী সমাজের বাজারব্যবস্থা ও পণ্য-মানসিকতার কারণে ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক কারখানায় প্লাস্টিক শিল্পের অতি দ্রুত বিকাশ লাভ করা এবং অর্থনীতির ধরন পাল্টে যাওয়ায় মৃৎপাত্র ওই গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি। তা ছাড়া বিদেশি শিল্পের আমদানি, দেশীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, কাঁচামালের স্বল্পতা ও মূল্যবৃদ্ধি, শিল্পীদের প্রশিক্ষণের অভাব এবং সর্বোপরি বাজারজাতকরণের সমস্যার কারণে এই শিল্পের নিজস্ব আঙ্গিকগুলোও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।
তবে আশার কথা, মৃৎশিল্পীদের একটি ছোট অংশ বেসরকারি সংস্থা বা এই শিল্পসামগ্রীর রপ্তানিকারক ও দেশীয় বিপণন কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন আঙ্গিকে এর বিকাশ ঘটাচ্ছে। ঢাকার রায়েরবাজার, সাভার, নবীনগর, রাজশাহী, পাবনা, রাজবাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, হাটহাজারী, নোয়াখালী প্রভৃতি অঞ্চলে অতি ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও মাটির তৈজস নির্মাণের পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন কিছু মানুষ।
নাগরিক জীবনের চাহিদা মনে রেখে তৈরি এসব মৃৎপাত্রের প্রায় সবটাই শৌখিন বস্তু হিসেবে তৈরি হচ্ছে। এসব মৃৎশিল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো থালা-বাটি, মগ, কলস, সানকি, হাঁড়ি, পটারি, টব, ফুলদানি ইত্যাদি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তৈরি এসব শৌখিন তৈজসপত্র স্থানীয়ভাবে কিছু বিপণন করা হলেও সাধারণত ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট এ রকম কয়েকটি প্রধান শহরে বিপণন এবং বিদেশে রপ্তানি করা হয়। ঢাকা শহরের শিশু একাডেমি-সংলগ্ন ফুটপাত, ধানমন্ডি, আসাদ গেট, মিরপুর, উত্তরা, গুলশান, মহাখালী এলাকায় বেশ কিছু মৃৎশিল্পের দোকান গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া কারুপণ্য, কারিকা, ব্র্যাকের বিপণন কেন্দ্র আড়ং- এ রকম কিছু আধুনিক বিক্রয় কেন্দ্রে বিভিন্ন মৃৎশিল্প-সম্ভার পাওয়া যায়।
তবে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার্য মাটির কিছু তৈজসপত্র এখনো বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই স্থানীয়ভাবে তৈরি করে। যদিও একথা সত্য যে, দিনে দিনে এই পেশায় নিয়োজিত শিল্পী-পরিবারের সংখ্যা কমছে। তাদের তৈরি তৈজসপত্রের মধ্যে রয়েছে কলস, হাঁড়ি, সানকি, সরা, পিঠার সাঁচ, ঢাকনা প্রভৃতি। বংশপরম্পরায় এই পেশায় নিযুক্ত আছে বেশ কিছু পরিবার। এবং এসব মৃৎশিল্পসামগ্রী ব্যবহারকারী মানুষও হচ্ছে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী। অন্যদিকে উচ্চবিত্তরাও এখন নকশা করা তৈজস ডাইনিংয়ে, ঘর সাজানোর কাজে, অফিসের ইন্টেরিয়র ডিজাইনে ব্যবহার করছে।
মাটির তৈজসপত্র তৈরির কারিগরি যন্ত্রটিকে বলা হয় চাক। এর ব্যবহার মানুষ কবে আয়ত্ত করেছিল, তা নির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। তবে পা-ুরাজার ঢিবির নিদর্শনগুলো থেকে ধারণা করা হয়, সে সময়ও মৃৎশিল্পীরা চাকের ব্যবহার শিখেছিল। প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের ফলে এটি এখন দুর্লভ হয়ে উঠেছে। চাকের ভূমিকা মৃৎপাত্র তৈরির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর সাহায্যেই মূলত মাটিকে নানান ধরনের পাত্রের আকৃতি দেওয়া হয়। এটি অত্যন্ত শৈল্পিক দক্ষতার বিষয়। বংশপরম্পরায় অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে কুমারেরা এই শৈল্পিক দক্ষতা অর্জন করে। পারিবারিক ও বংশপরম্পরাগত এই শিল্পে নারী-পুরুষ সবাইকে এই পেশায় শ্রম দিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীদের পরিশ্রম হয় বেশি। মাটি সংগ্রহ, কাঁকর বাছাই করা, ছানা, পাতিলে কষ দেওয়া, শুকানো, ঘরে সংরক্ষণ করাসহ প্রতিটি পর্যায়ে নারীকে যুক্ত থাকতে হয়।
ছবি: সংগ্রহ