রসনাবিলাস I সন্ধ্যার মায়াবী স্বাদে
কন্টিনেন্টাল, মেডিটেরেনিয়ান ও প্যান এশিয়ান খাবারের সমাহার সেখানে। মনোমুগ্ধকর অন্দরসজ্জায় উপভোগ্য মুহূর্তযাপনের স্থান। লিখেছেন সামীউর রহমান
ভেজা কাচের ওপাশে সাঁঝবাতিতে জ্বলে ওঠা জাদুর শহর। কানে আসছে পিয়ানোর টুংটাং, সামনে পানীয়র গেলাস আর নাকে সঙ্গীর গা থেকে ভেসে আসা মন পাগল করা সুগন্ধি। রেনেসাঁ হোটেলের ফাইন ডাইন রেস্তোরাঁ সিয়ার এভাবেই পারে একটা বর্ষণমুখর সন্ধ্যাকে উপভোগ্য করে তুলতে। প্রকৃতিতে চলছে বর্ষা। এই শহরে বৃষ্টি যেন ভোগান্তির অন্য নাম। জলজট, যানজট। এমনি এক বৃষ্টিমুখর দিনে মেঘের খুব কাছাকাছি যেতে পারলে কেমন হয়? ১৮ তলার ওপর অবস্থিত রেনেসাঁ হোটেলের সিয়ার রেস্তোরাঁ এনে দিতে পারে দুর্লভ সেই সুযোগ। গুলশান ১ ও ২ নম্বর গোলচত্বরের মাঝামাঝি অবস্থিত পাঁচতারকা হোটেল রেঁনেসা। ম্যারিয়ট হসপিটালিটি গ্রুপের এই হোটেল যাত্রা শুরু করেছে এক বছরের কিছু বেশি সময় ধরে। তাদের বুফে রেস্তোরাঁ বাহার এরই মধ্যে রাজধানীর খাদ্যপিয়াসীদের কাছে প্রিয় স্থান হয়ে উঠেছে। তবে মনে রাখার মতো একটা সন্ধ্যা কাটাতে চাইলে একই হোটেলের ইন্টারঅ্যাকটিভ ফাইন ডাইন রেস্তোরাঁ ‘সিয়ার’ হতে পারে নতুন গন্তব্য।
দিনের বেলায় সিয়ার দেখতে একদমই সাদামাটা। তবে সন্ধ্যে ঘনালেই এই রেস্তোরাঁ অতিথিদের কাছে ধরা দেয় স¤পূর্ণ অন্য রূপে। ঠিক যেন সিনডারেলা! সূর্য পাটে বসতেই সিয়ারে জ্বলে ওঠে বাহারি সব আলো। স্ফটিকের ঝাড়বাতির মোহনীয় রূপ আর কাচের দেয়ালে সেই আলোর প্রতিফলনে চোখ ধাঁধায়। অন্দরসজ্জায় খানিকটা ভিক্টোরিয়ান ছাপ। পুরু চামড়ায় বাঁধানো কাঁধ উঁচু চেয়ার, পলিশ করা মসৃণ টেবিলে প্রতিফলিত হচ্ছে ছাদজুড়ে বসানো ঝাড়বাতির আলো। তাতে সোনালি ছুরি কাঁটা আর স্বচ্ছ গবলেট, সব মিলিয়ে মনে হতে পারে ইউরোপের কোনো রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলেই বুঝি চলে আসা!
তবে পাথরের দুর্গ নয়, এই প্রাসাদের দেয়াল কাচের। শ্রাবণের বৃষ্টিতে আবছায়া জানালার কাচের পাশের একটা টেবিলে বসে পড়–ন দুজনে মিলে। কিছু কথা হোক, কিছু নিস্তব্ধতা। শুনতে থাকুন স্বয়ংক্রিয় পিয়ানোর সিম্ফনি। এর ফাঁকে খানিকটা গলা ভেজানো। সিয়ারের নন-অ্যালকোহলিক বারের পানীয় তালিকায় আছে স্ট্রবেরি জুস, ক্যানবেরি জুসসহ অনেক রকমের মকটেল। পানীয়তে চুমুক দিতে দিতেই চোখ চলে যাবে কাচের দেয়াল ভেদ করে অনেক দূরে। ঢাকা শহরের ছোট-বড় সব দালানে জ্বলে উঠেছে বাতি, চার শ বছরের পুরোনো নগরী হয়ে উঠেছে জাদুর শহর। সেই আলোর নিচের অন্ধকারে ঢাকা পড়েছে শহরের যত বঞ্চনা আর যন্ত্রণার আখ্যান। একটা সন্ধ্যার জন্য নাহয় থাক সে কথা! আলো-আঁধারির খেলা উপভোগ করতে করতেই সেরে নিতে পারেন খাবারের অর্ডারটা। ‘ইন্টারঅ্যাকটিভ ফাইন ডাইন’ এমন গাল ভারী নাম আদতে ইচ্ছেপূরণের খেলা। খাবারে লবণ কম না বেশি হবে, মিষ্টিটা কতখানি হবে, এমন ছোটখাটো অনেক ‘ফাইন টিউন’ করতে পারবেন এখানে। বুফের মতো শ খানেক পদ নয়, বরং সিয়ারের মেনু অনেক ছিমছাম। কন্টিনেন্টাল, মেডিটেরেনিয়ান, প্যান এশিয়ান- সব শীর্ষ ধাঁচের খাবারেরই আছে প্ল্যাটার, যা প্রায়শই বদল হয় অতিথিদের অভিরুচির ওপর নির্ভর করে। স্টেক, স্যালাড, প্রন টে¤পুরা, চিকেন আ-লা-কিভসহ বেশ কিছু জনপ্রিয় পদই আছে সিয়ারে, তবে সবেতেই আছে জার্মান শেফ রোমানো ক্রাটজের জাদুকরি ছোঁয়া।
প্রন টেম্পুরার বাইরের দিকের আস্তরটা পুরু নয়, মচমচে। ভেতরটা নরম, চিংড়ির শাঁসটা মোলায়েম। টে¤পুরা পরিবেশনের সময় শেফ ওপরে ছিটিয়ে দিয়েছেন খানিকটা সর্ষের তেল মাখানো মুড়ি। মুচমুচে চিংড়ির সঙ্গে মুড়ি মাখার এই ফিউশন চেখে দেখার জন্যই আসলে ‘সিয়ার’, যেখানে চেনা সবকিছুই আসবে একটু অন্য রূপে।
যেমন ধরা যাক ব্ল্যাক ফরেস্ট কেকের কথাই। সিয়ারের ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক যেটাকে তারা বলছেন ব্ল্যাক ফরেস্ট ২.০ আসলেই ভিন্ন রকম। চেরি, হোয়াইট চকলেট আর গলানো ডার্ক চকলেটের রসায়নে অন্য রকম এক স্বাদই পাবেন চেনা ব্ল্যাক ফরেস্ট কেকের।
জাদুকাঠির ছোঁয়ায় সিনডারেলা যেমন হয়ে উঠেছিল সাধারণ থেকে অপরূপা, সিয়ার তেমনি দিনের বেলায় সাদামাটা দেখালেও সন্ধ্যের পর মায়াবী আলোর বিভ্রমে হয়ে ওঠে মোহনীয়। এখানকার খাবারগুলোতেই সেই প্রচেষ্টা। চেনা কিছু স্বাদকে একটু অন্য রকমভাবে পরিবেশনে করার জন্যই এই ফিউশন ফাইন ডাইনিং রেস্তোরাঁ। স¤পর্কের চেনা গ-িকে একটু অন্য রকম ‘মেকওভার’ দিতে এই বর্ষায় তাই একদিন যাওয়া যেতেই পারে আঠারো তলার ওপর রেনেসাঁ হোটেলের সিয়ার রেস্তোরাঁয়। বৃষ্টিভেজা শহরটাকে দেখা যায় অন্য চোখে, সেই সঙ্গে পাশের মানুষটিকেও। আর চেখে দেখা যায় চেনা খাবারের অচেনা পরিবেশনা।
ছবি: শাহরিয়ার আহমেদ সোহান