ফিচার I গ্রিসের রঙ্গালয়
সে দেশের রঙ্গালয় সংস্কৃতি প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরোনো। কেমন ছিল প্রাচীন সে নাট্যধারা? কারাই-বা সেখানে সুখ্যাতি পেয়েছিলেন। লিখেছেন কনক বিশ্বাস
ধারণা করা হয়, রঙ্গালয়ের উৎপত্তি গ্রিসে। প্রায় তিন হাজার বছর আগে সেই দেশে ডায়োনিসাস দেবতার সম্মানে উৎসব অনুষ্ঠিত হতো। তাতে লোকেরা রংবেরঙের পোশাকে সেজে, নাচগান এবং অভিনয় করত। সেসব হাসি ও নৃত্যগীত সবই ছিল আনন্দ বিনোদনের অংশ। ইংরেজিতে যাকে বলে কমেডি। ধীরে ধীরে দেবতার উদ্দেশে গাওয়া এসব গানে যোগ করা হয় সংলাপ। তার আগে গ্রিসে একধরনের সমস্বর বা কোরাস হিসেবে নাটকের উন্মোচন ঘটেছিল। ডায়োনিসাসের অনুগতরাই এই স্বর নির্মাণ করত। কোরাসের আনন্দঘন পরিবেশনার সঙ্গে ক্রমে যোগ হয় বিয়োগান্ত ঘটনা। গ্রিকরা যাকে বলে ট্র্যাজেডি। এর অর্থ ছাগ সংগীত বা ছাগলের গান। এ রকম নামের ইতিহাস আছে। তা হলো, বিয়োগান্ত ঘটনায় যারা অভিনয় করত, তাদের পরনে থাকত ছাগলের চামড়ায় তৈরি পোশাক। সেগুলো নাটক নয়, ছিল ছন্দোবদ্ধ স্তব। যেগুলো ছিল মূলত ডিথির্যাম্ব বা অর্চনাসংগীত।
তবে কোরাসের এই গীতেই তো নাটক হয় না। এর সঙ্গে সংলাপ জুড়ে দেওয়ার দরকার হয়েছিল। গ্রিসের কোনো কোনো অঞ্চলে এসবের প্রচলন হতে দেখা গেছে। ইতিহাস বলে, খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৪ অব্দে প্রথম নাটক অভিনীত হয়। এই স্বীকৃতির কারণ হিসেবে বলা হয়, কোরাসের নেতা সমস্বরের সঙ্গে অন্য একজনের সঙ্গে সংলাপ বিনিময় করে।
কিন্তু তা অভিনয়ের জন্য রঙ্গালয় কেমন ছিল তৎকালীন গ্রিসে? তখন দেবতার উদ্দেশে নিবেদিত এসব উৎসব অনুষ্ঠিত হতো কোনো পাহাড়ের পাদদেশে বা বড় কোনো গাছের গোড়ায় বাঁধানো বেদিতে। যেন দর্শকসারি থেকে উৎসব-মঞ্চে উপস্থিত শিল্পীদের সহজে দেখা যায়। পাহাড়ের গায়ে পাথর কেটে আসন তৈরি করা হতো। সেই সারি সারি প্রস্তরের আসনে বসে দর্শক উপভোগ করত দলবদ্ধ স্তবগান বা নাটকের অভিনয়। পরে রঙ্গালয় তৈরি হলে সেখানে এমন ব্যবস্থাই রাখা হয়েছিল।
গ্রিসে প্রথম রঙ্গমঞ্চ গড়ে ওঠে আনুমানিক ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এথেন্সের অ্যাক্রোপলিস দুর্গের পাশে। নাম দেওয়া হয় ডায়োনিসাসের রঙ্গালয়। তাতে ত্রিশ হাজার দর্শক বসার স্থান ছিল। সেখানে কোনো আচ্ছাদনের ব্যবস্থা ছিল না। রঙ্গমঞ্চ হতো খোলা জায়গায়। বেদির ধারের গোলাকার স্থান থেকে গায়ক দল গান গাইত এবং অন্য কলাকুশলীরা অভিনয় করত। এই বৃত্ত থেকে একটু দূরে থাকত সাজঘর। গ্রিক মঞ্চে সাধারণভাবে আঁকা দৃশ্য পশ্চাৎপদ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দেব-দেবীদের ওঠানো-নামানো হতো কপিকলের সাহায্যে। কেননা, তারা অলিম্পাস থেকে জনগণের মধ্যে নেমে আসতেন এবং আবার সেখানে ফিরে যেতেন—এটা বোঝানোর জন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
পার্থেনন পাহাড় থেকে নামবার সময় দেখা যায় ডায়োনিসাসের রঙ্গালয়। এখানে রয়েছে আরও একটি থিয়েটার—হেরোডিয়ন। প্রায় তিন হাজার বছরের পুরোনো ডায়োনিসাস থিয়েটারের ধ্বংসাবশেষ দেখলে অবাক হতে হয়। এখানে এখনো ১৬ হাজার দর্শকের আসন আছে। হেরোডিয়ান থিয়েটারে রয়েছে বারো শ আসন। এ দুটো রঙ্গালয় মেরামত করে প্রতিবছরের গ্রীষ্মকালে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠান ও উৎসবের।
প্রাচীন গ্রিসে নাটকই ছিল শেষ কথা। এ নিয়ে প্রতিযোগিতারও প্রচলন ছিল। কে কতবার জিতলেন সেই লড়াইয়ে, তার ওপর অনেকটা নির্ভর করত নাট্যকার হিসেবে তার পরিচিতি। শোনা যায়, সোফোক্লিস একাই ১৮ বার জয়ী হয়েছিলেন। অন্যদিকে সম্ভ্রান্ত পরিবারের ভাবুক ছেলে ইউরিপিডিস ছিলেন সব বিদ্যায় পারদর্শী। খ্রিস্টপূর্ব ৪১১ সালে প্রথম জয়ী হন তিনি। নাটকের ইতিহাসে সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ঠিক তার আগের বছরই মৃত্যু হয়েছিল ট্র্যাজেডির আরেক বিখ্যাত নাট্যকার ইস্কাইলাসের। চারবার জিতেছিলেন ইউরিপিডিস।
গ্রিসের সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট অলিম্পাসের ওপরে বসত আসর। ডায়োনিসিয়া ছিল সংস্কৃতি, মদ ও প্রজননের দেবতা ডায়োনিসাকে ঘিরে আরাধনার উৎসব। এখানে পনেরো হাজার দর্শকের সমাগম হতো। যুদ্ধপ্রিয় এথেন্সবাসীর বিনোদনের উৎস ছিল লড়াই। প্রতিবছর এই নাট্য-উৎসব ঘিরে মেতে উঠত রাজধানীর লোকেরা। কে কত বড় নাট্যকার, তার বিচার হতো ডায়োনিসিয়ায় হারজিতের ওপর। কোনো কোনো বছর এ উপলক্ষে রচিত হয়েছে বারো শ থেকে পনেরো শ নাটক। সঙ্গে লেখা হতো আরও শ পাঁচেক কমেডি ও স্যাটায়ার।
প্রতিযোগিতা হতো কেবল ট্র্যাজেডি নিয়ে। তবে তাতে শুধু বিয়োগান্ত নাটক লিখেই জয়ী হওয়া যেত না। দুঃখের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে থাকত হাসি। তিন দিন ধরে চলা সেই প্রতিযোগিতায় একেকজন নাট্যকার উপস্থাপন করতেন তিনটি ট্র্যাজেডির সঙ্গে একটি স্যাটায়ার। ছয় মাস আগে শেষ হতো বাছাই পর্ব। নাম লেখাতে আসতেন কয়েক শ নাট্যকার। জনা দশেক বিচারক তিন দিন শেষে বারোটি নাটক দেখে এবং দর্শকের অভিমত বুঝে ঘোষণা করতেন সে বছরের শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের নাম। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৪ সালে প্রথমবারের প্রতিযোগিতায় এই সম্মান পেয়েছিলেন থিসপিস। তারই গানে গানে জন্ম নেয় ট্র্যাজেডির ধারা। সেখান থেকেই উঠে আসেন ইস্কাইলাস, সোফোক্লিস, ইউরিপিডিসের মতো বিশিষ্ট নাম। জনপ্রিয়তার বিচারে প্রাচীন গ্রিসের ‘অ্যাথলেটিকসে’র পরেই ছিল এই নাট্যধারার প্রতিযোগিতা।
পরবর্তীকালে কমেডিও সেখানে খানিকটা সম্মান অর্জন করে নাটক হিসেবে। এ জন্য সেখানে শুরু হয় আলাদা একটি প্রতিযোগিতাও।
যুদ্ধে জর্জরিত প্রাচীন গ্রিসে সংস্কৃতিচর্চা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা বোঝা যায় এই নাট্য প্রতিযোগিতা ঘিরে তাদের ভাবনার টুকরা টুকরা নিদর্শন থেকে। যে সময় গ্রিকরা পারসিকদের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়, ধ্বংস হয়ে যায় তাদের স্বপ্নের এথেন্স শহরের নানা চত্বর, ঠিক সেই বছরই আরও নতুন উদ্যমে শুরু হয় নাটকের প্রতিযোগিতা। সালটা ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০। ধ্বংসের পর নতুন করে গড়া হয় এথেন্সের—ঘরবাড়ি, রঙ্গালয়, অ্যাম্ফিথিয়েটার। কিন্তু একবার অভিনীত হয়ে গেলে সেই ট্র্যাজেডি বা কমেডি অন্য কোথাও আর মঞ্চস্থ করার নিয়ম ছিল না সেখানে। ফলে কয়েক শ বছর ধরে ডায়োনিসিয়া উৎসবে কয়েক হাজার নাট্যকারের পান্ডুলিপি হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। এগুলোর কয়েকটি পাওয়া গেছে মূলত এথেনীয় সমাজের চরম শত্রু স্পার্টার কারণে। পেলোপোনেশিয়া যুদ্ধে পরাজয়ের পরে যখন এথেনীয় রীতিরেওয়াজ ভগ্নপ্রায়, তখন অভিনয় শুরু হয় পুরোনো কিছু নাটকের। স্পার্টার প্রভাবে আচ্ছন্ন গ্রিসের ‘হেলেনিস্টিক’ সমাজই সেগুলো সংরক্ষণের কাজ করে। এভাবেই বেঁচে যায় গ্রিক নাটকের কয়েকটি কালজয়ী সৃষ্টি।
অ্যাক্রোপলিস পাহাড়ের পাদদেশে নবনির্মিত মিউজিয়ামের বিভিন্ন তলায় রাখা হয়েছে গ্রিক সভ্যতার বিভিন্ন সময়ের মূর্তি, ভাস্কর্য, দেয়ালে খোদাই করা শিল্প। এই জাদুঘর ছাড়াও সেসব স্থান পেয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়াম এবং ফ্রান্সের লুভরে। সেখানেও স্থান পেয়েছে গ্রিক রঙ্গালয়ের অনেক প্লাস্টার প্রতিলিপি।
ছবি: ইন্টারনেট