ছুটিরঘণ্টা I এলিফেন্টিনের পথে
নীল নদের তীরে গড়ে ওঠা ছোট্ট জনপদ। এখানকার সোনালি বেলাভূমি মৃদুমন্দ হাওয়া আর মানুষের সারল্য মনে সুখকর আবেশ তৈরি করে দেয়। রোমাঞ্চকর এক ভ্রমণের পর লিখেছেন ফাতিমা জাহান
একটা নদ ঐশ্বর্যের সম্ভার বুকে নিয়ে বয়ে চলছে।
তার নীলের ঝলকে বিদ্যুৎ চমকায় না, বৃষ্টিও নামে না। জীবনে অনেক নদ-নদী দেখেছি, কিন্তু কোনোটি এমন সুন্দর নয়। এর রূপের কাছে শহর, গ্রাম বন্দরের সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়। এ নদের শান্ত ঠান্ডা জলের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।
নীল নদ মিসরের প্রাণ। আসওয়ান শহরজুড়ে বয়ে চলা এই নদ অনেকের মতো আমারও মন রাঙিয়ে দিয়েছে। এলিফেন্টিন আইল্যান্ডের একটা রঙিন বাড়িতে অতিথি হিসেবে পাঁচ দিন ছিলাম। তবে এই অল্প সময়ের মধ্যে পুরো শহরকে ভালোবেসে ফেলেছি। সেখানের মানুষও কি কম ভালোবেসেছে আমাকে! পুরো দ্বীপবাসীর আদর-আপ্যায়ন পেয়েছি প্রাণভরে।
কায়রো থেকে প্লেনে চড়ে আসওয়ান শহরে এসেছি। এয়ারপোর্টে পৌঁছে, নির্ধারিত গেটের সামনে বসে ছিলাম অনেকক্ষণ। কোনো যাত্রী নেই। শুধু আমি আর চায়নিজ একটা ছেলে। ওর চীনা নাম উচ্চারণ করা কঠিন, তাই আমি দিলাম চ্যাং। একই প্লেনে যাচ্ছি দুজন। টেকঅফের আধঘণ্টা আগেও দেখি, ওয়েটিং এরিয়ায় আমি আর চ্যাং ছাড়া অন্য কোনো যাত্রী নেই। চ্যাং তার দীঘল কালো লম্বা চুলের ঝুঁটি দুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আমরা কি ঠিক গেটে অপেক্ষা করছি?’ আমি বললাম, ‘গেট ঠিক আছে, যাত্রীও আসবে।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই সব যাত্রী এসে গেল। প্লেনে চড়ার আগে চ্যাং জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি অনুমান করলে কীভাবে?’
আমি বললাম, ‘এক সপ্তাহে কায়রো আর মিসরীয়দের অনেক জেনেছি। চিনেও ফেলেছি।’
যেহেতু দুজনের হোম স্টে একই আইল্যান্ডে, আসওয়ান পৌঁছে আমি আর চ্যাং ঠিক করলাম, ট্যাক্সি শেয়ার করে শহরের এলিফেন্টিন আইল্যান্ডে যাব। এ শহরে ট্যাক্সি ভাড়া খুব বেশি। যাবার জন্য কোনো বাস নেই, ট্যাক্সিই ভরসা।
ট্যাক্সিচালক সদ্য তরুণ। বলেই দিল, ওর বয়স সবে কুড়ি। তবে আমার মনে হলো আরও কম।
চ্যাং দুবাইয়ে কাজ করে। দু-একটা আরবি শব্দও জানে। তাতেই তার স্বর উঁচু হয়ে উঠছে। আমি মিটিমিটি হেসে বললাম, ‘চ্যাং, তোমার দুবাইয়ের আরবি এখানে চলে না। এদের আরবি আলাদা ধরনের।’ হলোও তাই। ট্যাক্সিচালক ছেলেটি চ্যাং-এর একটি শব্দেরও মর্মোদ্ধার করতে পারল না।
এলিফেন্টিন আইল্যান্ডে যেতে হলে, ফেরি বা মোটর বোট করে নীল নদ পার হতে হয়। আমরা সেভাবেই যাব। ঘাটে আমাদের নামিয়ে দিল ট্যাক্সিচালক। নীল নদ পার হতে হবে নৌকা বেয়ে। কায়রোতে এই নদের তীরে অনেক বসে থেকেছি, এর বাতাস গায়ে মেখেছি কিন্তু পার হওয়া হয়নি।
নৌকাটা বেশ বড়। সাদা রঙের ছাউনি দেওয়া। এক পাশে গোটানো সাদা পাল। পাল তোলা নৌকা খুব ছোটবেলায় দেশে দেখেছিলাম, এখন আর দেখা যায় না। এটা সেইল বোটের মতো। দুভাগ করা। এক পাশে পুরুষ, আরেক পাশে নারীর বসার ব্যবস্থা। জীবনে এই প্রথম আমি কোনো নুবিয়ানের মুখ দর্শন করলাম। যাদের দেখা পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম মিসরে আসার আগেই।
অনেকেরই ধারণা, মিসরের মানুষ আফ্রিকার অন্যান্য দেশের মানুষের মতো কৃষ্ণকায়। আসলে সাধারণ মিসরীয়, দেখতে উত্তর আরবের অধিবাসীদের মতো মতো ফরসা, লম্বা। তবে আদিবাসী কয়েকটি গোষ্ঠীর লোকজন দেখতে অন্য আফ্রিকানদের মতো কালো। কোঁকড়া চুল, বোঁচা নাক আর মোটা ঠোঁট। এদের ভাষাও আলাদা ছিল একসময়। এখন মিসরীয়দের মতো আরবি ভাষায় কথা বলে। মিসরে শুধু নুবিয়ান আর বেজা নৃগোষ্ঠীর বাস। অন্যরা আরব বা তুর্কি।
ইঞ্জিন বোটের এক পাশে নুবিয়ান নারীরা, সর্বাঙ্গ কালো বোরকায় ঢেকে, নিজেদের মাঝে কথা বলে যাচ্ছে। অন্য পাশে সাদা ট্র্যাডিশনাল পোশাক ‘গালিবায়া’ পরিহিত পুরুষেরা নিশ্চুপ। সব দেশেই বোধ হয় নারীরা প্রাণোচ্ছল ও সরব।
সন্ধ্যে বেলায় নীলের বুকে একটুও গরম নেই। নৌকা চলছে, শান্ত নদের বুকে আলো-আঁধারিতে আমাদের নিয়ে।
কুড়ি মিনিট নদের বুকে আনন্দের ঘোরে কাটিয়ে ঘাটে পৌঁছালাম। এই দ্বীপে অনেক ঘাট। একজন নুবিয়ান দ্বীপবাসী আমার হোম স্টে, যার নাম ‘বাকার হাউস’ চেনেন। তিনিও আমাদের প্রাণোচ্ছ্বাসের সঙ্গী হলেন। পৃথিবীর প্রতি কোণে পথপ্রদর্শক রয়েছে। চলতে কোথাও তেমন কোনো অসুবিধে হয় না।
এলিফেন্টিন আইল্যান্ডে যখন পৌঁছালাম, তখন দিনের আলো নিভে গেছে। ছোট্ট একটা গ্রাম এটি। গ্রামের বাসিন্দাদের সবাই নুবিয়ান। অন্ধকার পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম বাকারের সঙ্গে, তিনি আমাকে গন্তব্যে পৌঁছিয়ে দেবেন। মেঠো পথে মরুভূমির বালিতে পা চালিয়ে, সারি সারি খেজুরগাছের আইল ধরে, ঘোড়া-ভেড়ার বিষ্ঠা মাড়িয়ে, বিভিন্ন আদলের কাঁচা-পাকা বাড়ি দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। চারপাশে অন্ধকার ঘিরে আছে, বাতিও দেখা যাচ্ছে না তেমন একটা। আমাদের দেশে কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে এমন গ্রাম দেখা যেত; মাটির ঘর, মাটির পথ আর মাটির প্রাচীর। মাঝে মাঝে গাছের পাতার শনশন আওয়াজ আর ভেড়ার ডাক। কে বলবে এটা মরুর দেশ! মাটির ঘর, গৃহপালিত পশু, নদী, বৃক্ষ—সবই আছে বাংলাদেশের মতো, সঙ্গে গরমও।
বাকার হাউস বা বকর হাউস বাড়িটা মোটামুটি আধুনিক দালান। গ্রাম হলেও সেখানকার সচ্ছলেরা কিছুটা শহুরে জীবন যাপন করে। নুবিয়ান নৃগোষ্ঠী ৯০০০ বছরের পুরোনো। কিছু নুবিয়ান বাস করেন সিরিয়ায়, বাকিরা মিসরের আসওয়ানে। বর্তমানে এরা মুসলমান।
আমাকে দোতলার রুম দেখিয়ে দিল বাড়ির বড় ছেলে আবদেল, সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে সবেমাত্র। একে একে বাড়ির অন্য সদস্যদের সঙ্গে পরিচিত হলাম। আবদেলের মা দেখতে খুব মিষ্টি নারী, নাম ফাতিমা। ‘আফওয়ান’ বা ধন্যবাদ এত সুন্দরভাবে দেওয়া যায়, তার কাছ থেকেই প্রথম জানলাম। আবদেলের বাবা বাকার অত্যন্ত বিনয়ী। হোম স্টে ভাড়া দেওয়া ছাড়া তাদের একটা মুদিদোকান আছে সংসার চালানোর জন্য।
আড্ডা জমে উঠল রাতে। ওদের বাড়িতে অতিথি হয়ে এর আগে ভারতবর্ষের কেউ থাকেনি। ছেলেমেয়েদের কৌতূহলের শেষ নেই—শাড়ি কেমন করে পরে, রোজ ভাত খাই কী দিয়ে, সবাই আমার মতো দেখতে কি না (আমি নাকি মিসরীয় লোকের মতো দেখতে), শাহরুখ খানকে পছন্দ করি কি না…আরও কত কথা! সঙ্গে মিলল নুবিয়ান ঐতিহ্যবাহী ডিনার। রুটি, অল্প তেলে রান্না করা সবজি, চানা ডাল আর স্যালাড।
পরদিন সকালে চ্যাং এল। জানতে চাইল আমার সময় কেমন কেটেছে? আমি তো খুশিতে সব গুড রেটিং করলাম। চ্যাং বেজার মুখে বলল, ‘আমার হোম স্টে টা খুব বোরিং, কেউ নেই আশপাশে, একা ছিলাম। ওদের একটা গেস্ট রুম খালি ছিল। বাকারকে বলে চ্যাং এখানে এসে পড়ল।
রাতে এসেছি বলে এদের বাড়িটা এখনো ভালোভাবে দেখার সুযোগ হয়নি। সামনের উঠোনে খোলামেলা বৈঠকখানা খুব সুন্দর করে রাঙানো, দেয়ালে ছবি আঁকা, আসবাব বলতে একটা সাধারণ সোফা আর সেন্টার টেবিল, পাশে হুঁকো রাখা। মিসরে নারী-পুরুষনির্বিশেষে হুঁকো বা সিসায় টান দেওয়াকে আভিজাত্য হিসেবে গণ্য করে।
দোতলার রুমগুলো অত্যাধুনিক। শুধু নিচের বৈঠকখানায় সাবেকি ভাব বজায় রাখা হয়েেেছ। আমার রুমের জানালাজুড়ে দেখা যাচ্ছে নীল নদ। ঘরের বাইরে বেরোলেই ঘাট। গতকাল আমরা একটু দূরের ঘাটে নেমেছিলাম, তাই গ্রামটার কিছুটা হলেও দেখতে পেরেছি। আজ আমি যাব আসওয়ান শহরে নুবিয়ান মিউজিয়াম দেখতে আর শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়াতে।
(চলবে)
ছবি : লেখক