ফিচার I বদলে যাওয়া আবহাওয়ায়
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে খাদ্যে। দ্রুত পচে যাচ্ছে খাবার। বাড়ছে বিচিত্র ও বিপজ্জনক অণুজীবের উপদ্রব
খাবারকে পচিয়ে দেয় অণুজীব। আর পচনপ্রক্রিয়া সক্রিয় হয়ে ওঠে উপযোগী আবহাওয়ায়। সব ঋতুতেই কম বেশি রয়েছে খাদ্য নষ্টের ঝুঁকি। তা ছাড়া জলবায়ুর কারণে কমে যাচ্ছে আবাদ…
খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে ঋতুবৈচিত্র্য খুব সুখকর কিছু নয়। তাপমাত্রার ওঠানামা, জলীয় বাষ্পের হ্রাস-বৃদ্ধি, বাতাসের আর্দ্রতা ও শুষ্কতা ইত্যাদি খাদ্যের ওপর প্রভাব পড়ে। তাতে খাবারের রং বদলায়, পাল্টে যেতে পারে স্বাদও। তাজা ফলটিও দ্রুত পচে যেতে পারে কেবল আবহাওয়ার প্রভাবে। তা ছাড়া জলবায়ুর কারণে একটি অঞ্চলের ফসলের বৈশিষ্ট্যে স্থায়ী পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রেই জীবাণুর টিকে থাকা এবং বিস্তার জলবায়ুর ওপর নির্ভর করে। বিশেষ পরিবেশে এগুলো খাদ্যশৃঙ্খলাকেও প্রভাবিত করে। খাবারের পুষ্টি উপাদানগুলো ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করে এসব অণুজীবই। পরে সেই ক্ষুদ্র খাদ্যকণা নিজেদের কোষপ্রাচীরের মাধ্যমে গ্রহণ করে জীবাণুগুলো। এতে আক্রান্ত খাদ্যগুলোর গঠনপ্রক্রিয়া স্বাভাবিক থাকে না। বদল ঘটে বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদে।
সাধারণত ৪০ থেকে ১৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপ অণুজীবগুলোর বেঁচে থাকার জন্য অনুকূল। তবে এ তাপমাত্রায় কিছু সবজি জীবাণু আক্রান্ত হয় না। কারণ, সবজির গাত্র ভেদ করে অণুজীবগুলো অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু সক্রিয় ব্যাকটেরিয়া বাইরের অংশে লেগেই থাকে। সবজিতে বেশি পানির উপস্থিতি ওসব জীবাণুর ভেতরে প্রবেশের পথ সুগম করে।
পরিবেশে অতিরিক্ত অক্সিজেনের উপস্থিতিও খাবারে পচন ধরাতে পারে। যেমন কেটে রাখা কলা বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে মেলালিন তৈরি করে, যা ফলটিকে পচিয়ে দিতে পারে। একই ঘটনা ঘটে কেটে রাখা আপেলে। সেটি অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়ায় কালচে বাদামি বর্ণ ধারণ করে।
বাড়ছে বিশ্বের তাপমাত্রা। বাংলাদেশেও গরমের দাবদাহে মানুষ অতিষ্ঠ। আবার করোনা মহামারির কারণে রেস্তোরাঁ থেকে হোম ডেলিভারি করা খাবারের দিকে ঝুঁকছে গৃহবন্দিরা। কিন্তু গরম আবহাওয়ায় রেস্তোরাঁ থেকে আগত এসব খাবারের পচনের হার বেশি বলে দাবি করেছে ‘ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচার (ইউএসডিএ)’। প্রতিষ্ঠানটির মতে, তাপমাত্রা ৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে খাবার নষ্ট হতে পারে। মুরগি, রেডমিট, সস, স্যালাড, কাটা ফল ও সবজি এক ঘণ্টার বেশি বাইরে ফেলে রাখা উচিত নয়। কেননা, প্রচন্ড গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় ওসব খাবারে জীবাণু খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করে। গত বছর ইউএসডির জরিপ বলছে, বাইরের তাপমাত্রা যদি ৩২ ডিগ্রি ফারেনহাইটের নিচে হয়, তাহলে রান্না করা খাবার এক ঘণ্টার মধ্যে ফ্রিজে রাখা উচিত।
খাদ্যে বর্ষা ঋতুর প্রভাবও ব্যাপক। আমাদের দেশে এ ঋতুতে আচারে কিংবা পাউরুটিতে ফাঙ্গাস পড়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। বর্ষায় বাতাসে বাড়তি আর্দ্রতা থাকে। এ ঋতুতে কড়া ভাজা খাবার সহজে হজম হতে চায় না। এ জন্য বর্ষার আর্দ্রতাকেই দায়ী করেন বিশেষজ্ঞরা। এই মৌসুমে শরীরও আর্দ্র থাকে। ফলে অতিরিক্ত তৈলাক্ত ভোজনে বদহজমের আশঙ্কা থাকে। এ ঋতুতে শাক খেতেও নিষেধ করেন অনেকে। কারণ, এটি খোলা জায়গায় জন্মে। বর্ষায় শাকের পাতা, লতা, কান্ড ইত্যাদি স্থানে পোকা ঠাঁই নেয়। সেসব পতঙ্গ জীবাণুর বাহক, যা ধীরে ধীরে শাক পচিয়ে দিতে পারে।
শীতকালও সব খাবারের জন্য উপযোগী ঋতু নয়। এ সময়ে মানুষের শরীরে স্যাচুরেটেড ফ্যাট খুবই ধীরগতিতে হজম হয়। ফলে দেহে চর্বি জমতে থাকে। তা ছাড়া এ ঋতুতে শারীরিক পরিশ্রম তুলনামূলকভাবে কম হয়। ফলে বেক করা খাবার হজম হতে সময় লাগে। তাই শীতে এ ধরনের খাবার এড়িয়ে চলা ভালো।
পরিবর্তিত জলবায়ুতে বাংলাদেশের কৃষি ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বীজের গজানো, পরাগায়ন, ফুল-ফল ধরা ও পরিপক্ব হতে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত ও সূর্যালোক। জলবায়ু পরিবর্তিত হলেও বীজ বপন ও চারা রোপণের সময়ে বদল আসেনি। ফলে মৌসুমের সঙ্গে চাষাবাদের খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না। গড় তাপমাত্রা বাড়ায় গম, ছোলা, মসুর, মুগ ডাল ও কিছু কিছু ধানের উৎপাদন কমে গেছে। গমের বীজ সাধারণত ১৫-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপে গজায়। এর কমবেশি হলে গজাবে না। গম পাকার কালে আবহাওয়া বেশি আর্দ্র কিংবা ঘন কুয়াশা থাকলে ফসলে ব্ল্যাক পয়েন্ট রোগ হয়। এতে ফলন কমে। এই প্রভাবে পাট ও বোরো ফসলের ফলনও কমে। টাস্কফোর্স রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০৫০ সাল পর্যন্ত ১ মিটার বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে দেশের ৩ হাজার মিলিয়ন হেক্টর উর্বর জমি স্থায়ীভাবে বিলুপ্ত হবে। ফলে ২ মিলিয়ন টন ধান, গম, আখ, পাট, মটরসহ রবিশস্য উৎপাদন কমবে।
তা ছাড়া বাংলাদেশ বন্যাপ্রবণ। অতিবৃষ্টি ও ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল প্লাবিত হয়ে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। তবে এসব প্লাবন থেকে জমে যাচ্ছে পলি। এই পলিই আবার আশীর্বাদ হয়ে উঠছে বন্যাকবলিত অঞ্চলের চাষিদের জন্য। নিচু অঞ্চল বন্যার পর পলি জমে চাষবাসের যোগ্য হচ্ছে। আবহাওয়া যেমন খাবারে সরাসরি প্রভাব ফেলছে, তেমনি ফসলকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে পরিবর্তিত জলবায়ু। এই দুর্যোগ বাড়তে দিলে খুব শিগগির খাদ্যসংকটে পড়তে পারে পুরো জাতি।
ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট