রূপরসদ I মাশরুম ম্যাজিক
ত্বকের সৌন্দর্যে মাশরুমও এক অব্যর্থ দাওয়াই। জানা দরকার প্রয়োগের বিভিন্ন কৌশল। লিখেছেন সিফাত বিনতে ওয়াহিদ
ত্বককে সুস্থ ও সতেজ রাখার জন্য যে প্রাকৃতিক উপাদানগুলো প্রায়শই ব্যবহৃত হয়, এদের মধ্যে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্য। বহু আগে থেকেই একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে, আমরা যা খাই, তা-ই ত্বকে প্রতিফলিত হয়। ফলে রূপচর্চার প্রসাধনীর সঙ্গে রান্নাঘরের উপাদানগুলোর একটি মেলবন্ধন রয়েছে। অ্যাভোকাডো, ব্লুবেরি, হলুদ, নারকেলের পানি অথবা গরুর দুধের মতো আরও অসংখ্য উপাদান ত্বকেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে এসবের মধ্যে মাশরুম অন্যতম।
কয়েক প্রজন্ম ধরেই চীনের প্রথাগত ওষুধ এবং ভারতীয় আয়ুর্বেদ—মাশরুমের ওপর নির্ভরশীল। এটি ফল বা সবজি নয়, এমনকি গাছের শ্রেণিতেও ফেলা যায় না; কারণ, তাদের পাতা ও শিকড় নেই। মাশরুমগুলো প্যারাসিটিক ছত্রাকের ধরনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়; যা মানুষ, উদ্ভিদসহ অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে বাড়তে পারে। কিন্তু সব ছত্রাক ক্ষতিকর নয়, কিছু আছে পুষ্টিসমৃদ্ধ এবং শরীরের জন্যও উপকারী। মাশরুমের মতো বহুমুখী আর কোনো প্রাকৃতিক উপাদান সম্ভবত নেই। এটি ব্যবহারের সুবিধাটি হলো, এই ছত্রাক পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত, দোষহীন এবং সূক্ষ্ম ত্বক উপহার দেবে। মাশরুমের এই অত্যাশ্চর্য গুণাবলি সাম্প্রতিক আবিষ্কার নয়, কমপক্ষে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর আগে থেকেই এই গুণগুলো সৌন্দর্যের মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রায় ১৫ হাজার জাতের মধ্যে কোনো কোনোটা ত্বকের জন্য প্রয়োজনীয়। যেমন শিতাকে মাশরুম ত্বক উজ্জ্বল করায় পারদর্শী।
সম্ভবত এই ব্যাঙের ছাতা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বেশি চাষযোগ্য ভোজ্য মাশরুম। পাস্তাসহ বিভিন্ন ধরনের ধোঁয়াজাতীয় খাবারে এর আধিক্য দেখা যায়। শিতাকে মাশরুম কোজিক অ্যাসিডের অন্যতম উৎস। ব্রণ থেকে শুরু করে সূর্যের দাগ—সব ধরনের হাইপারপিগমেন্টেশন হালকা করার জন্য কোজিক অ্যাসিড হাইড্রোকুইনোনর একটি প্রাকৃতিক বিকল্প। ব্রণ, একজিমা এবং রোসেসিয়ার মতো পরিস্থিতিতে এর অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরিস এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে ত্বককে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে। জাপানে এটিকে ত্বকের প্রাণশক্তির ওপর ভিত্তি করে অ্যান্টিএজিং মাশরুম হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এই মাশরুমগুলো সহজলভ্য এবং এটার উপাদান দুর্দান্ত শিতাকে ডিআইওয়াই ফেস মাস্ক তৈরি করে, যা দীর্ঘ অলস রাতে ব্যবহারের জন্য উপযোগী। এর উপাদান পাওয়া গেছে, ওয়ান লাভ অর্গানিকসের ভিটামিন ডি মিস্ট, মুরাদ এজ রিফর্ম ইনভিজিব্লার পারফেক্টিং শিল্ড ব্রড স্পেকট্রাম এসপিএফ ৩০, অ্যাভিনো ডেইলি এক্সফোলিয়েটিং ক্লিনজার, কেট সামারভিল ডেইলি ডিফ্লেক্টর ময়শ্চারাইজার ব্রড স্পেকট্রাম এসপিএফ ৫০সহ নানা পণ্যে।
ট্রিমেলা ময়শ্চারাইজিং মাশরুম, তুষার মাশরুম, তুষার ছত্রাক, সাদা জেলি মাশরুম, রুপার কান বা জাদুকরি মাখন হিসেবেও পরিচিত। চীনের সৌন্দর্যের প্রতীক সেরা চার নারীর উল্লেখযোগ্য প্রিন্সেস ইয়াং গুয়াইফি তার রূপচর্চায় ট্রিমেলা ব্যবহার করতেন। তিনি এত সুন্দরী ছিলেন যে তাংয়ের স¤্রাট জুয়ানজং তার রাজত্বকে গুয়াইফির জন্য বিলীন করতে প্রস্তুত ছিলেন। কথিত আছে, ইয়াং গুয়াইফি তার এই চকচকে বর্ণ এবং চিরন্তন যৌবনের জন্য ট্রিমেলাকে কৃতিত্ব দিতেন। ফলে নিঃসন্দেহেই একে একটি শক্তিশালী মাশরুম হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
ওষুধ হিসেবেও চীনে ট্রিমেলা খুবই জনপ্রিয়। তবে এই ছত্রাকের বেশি দেখা মেলে মূলত দক্ষিণ আমেরিকা এবং ক্যারিবীয় অঞ্চলের মতো ক্রান্তীয় এলাকায়। এটা দেখতে লুফার বা জেলির মতো এবং গাছের আশপাশে বেড়ে ওঠে। অনেকগুলো গবেষণায় দেখা গেছে যে ট্রিমেলা মাশরুম পানিতে নিজের ওজন ৫০০ গুণ ধরে রাখতে পারে। এটি হাইড্রেশনের জন্য বহুল প্রশংসিত এবং ত্বককে হায়ালুরনিক অ্যাসিডের সঙ্গে তুলনীয় করে তোলে। ট্রিমেলার কণাগুলো হায়ালুরনিক অ্যাসিডের চেয়ে ছোট, তাই এই মাশরুম আরও সহজে ত্বকে প্রবেশ করে।
এটি ত্বকে ডার্ক সার্কেল উৎপাদন রোধ করে এবং হাইপারপিগমেন্টেশন, বয়সের দাগ ও পুরোনো ব্রণের দাগছোপ হালকা করতে সহায়ক। কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ত্বকের দাগ হালকা করার জন্য এই মাশরুম ভিটামিন সি এবং কোজিক অ্যাসিডের চেয়েও বেশি কার্যকর। রূপচর্চার ক্ষেত্রে ট্রিমেলা খুব একটা প্রচলিত মাশরুম নয়। তবে চীনসহ বেশ কিছু দেশের সৌন্দর্যপণ্যে এই মাশরুমের উপাদান পাওয়া যায়, যেমন জোয়ানা ভার্গাস ইউফোরিয়া মাস্ক, গ্লসিয়ার প্রাইমিং ময়শ্চারাইজার, ওলে অ্যাকটিভ বোটানিক্যালস, কাইপরিস গ্লো ফিল্ট্রে, শিসেলডো ওয়াসো ফ্রেশ জেলি লোশন, জুর্লিক নুত্রি ডিফাইন আই কনটুর বাম, মুন জুস বিউটি শ্রুম প্লাম্পিং জেলি সেরাম।
রিশি হলো অ্যান্টিস্ট্রেস, অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি এবং ডিটক্স মাশরুম। একসময় এটা কেবল সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞীদের জন্য সংরক্ষণ করা হতো। সবচেয়ে প্রাচীনতম ভেষজ মাশরুম এবং এটা দুই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে পূর্ব প্রাচ্যে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর চায়নিজ নাম ‘লিং ঝি’, যার অর্থ অমরত্বের মাশরুম। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে জাপানে ক্যানসারের চিকিৎসাতেও ব্যবহৃত হয়।
এই শক্ত এবং তিক্ত মাশরুমটি বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে, যেগুলোর মধ্যে লালটিকে সবচেয়ে ঔষধি হিসেবে ধরা হয়। রিশি ক্ষয়ে যাওয়া কাঠের পাতলা গাছগুলোতে বেড়ে ওঠে। বনেবাদাড়ে এটি এখন আর তেমন সহজলভ্য নয়। বেশির ভাগ রিশি মাশরুম এখন ঘরের মধ্যে চাষ করা হয়। এগুলো বিটা-গ্লুকানসে পরিপূর্ণ, যা প্রাকৃতিক শর্করা। এটি ত্বকের শুষ্কতা এবং চুলকানির সমস্যা রোধ করতে ত্বকের একাধিক স্তর দিয়ে প্রবেশে সক্ষম। এগুলোতে রয়েছে পলিস্যাকারাইড, যা ত্বককে পানি ধরে রাখতে প্রাকৃতিক ক্ষমতা বাড়ায়। টপিক্যাল স্কিনকেয়ার পণ্যগুলোতে ব্যবহারের ফলে এই মাশরুম ত্বককে ময়শ্চারাইজার করে তোলে।
শুধু তা-ই নয়; রিশি মাশরুম প্রদাহবিরোধী। এটা ব্রণ, ঘর্ষণ, লালভাব, রোদে পোড়া, র্যাশ এবং চাপযুক্ত ত্বকের সঙ্গে মোকাবিলা করে ত্বক সতেজ রাখে। এই মাশরুমে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা ত্বকের বলিরেখা দূর করে। একসঙ্গে এর বৈশিষ্ট্যগুলো এমন একটি উপাদান তৈরি করে, যা স্ট্রেসযুক্ত বা সংবেদনশীল ত্বকের জন্য খুবই শক্তিশালী। ফলে তা ত্বককে মসৃণ এবং জ্বালামুক্ত রাখে।
রিশি হলো কঠিন মাশরুম। এটি ব্যবহার করার জন্য এর টুকরাগুলো ১০-১৫ মিনিটের জন্য গরম পানিতে খাড়া করে সেদ্ধ করতে হয়। তারপরে টুকরো টুকরো করে কেটে নিয়ে এর তরলটি মুখে মাখাতে হবে। এতে পাওয়া গেছে ড. অ্যান্ড্রু ওয়েল ফর অরিজিনস মেগা মাশরুম লাইন, মুন জুস বিউটি শোরুম, এক্সফোলিয়েটিং অ্যাসিড পশন, ওয়াইএসএল টেম্পস মাজিউর ক্রিম, মিশা মিসা জিউম সুল রিভিটালাইজিং আই ক্রিমে।
কর্ডিসেপস হলো ত্বক মসৃণকারী মাশরুম। এর উৎসগুলো ঠিক সহজ এবং সুন্দর নয়। এগুলো এমন পরজীবী, যা একটি শুঁয়োপোকা থেকে নিজেকে সংযুক্ত করে এবং এর মৃতদেহ খায়। ফলে এদের শুঁয়োপোকা ছত্রাক, শুঁয়োপোকা মাশরুম, উদ্ভিজ্জ শুঁয়োপোকা, সোনার কৃমি, তিব্বতি মাশরুমসহ একাধিক বিকল্প নামে ডাকা হয়।
তিব্বতি চাষিদের কাছে (সাধারণত হিমালয় ও তিব্বত মালভূমির উচ্চতর স্থান যারা বাস করেন), এই ছত্রাক বহু মূল্যবান। এখন সেখানে ধানের চেয়েও বেশি কর্ডিসেপস চাষ হয়। এতে অ্যান্টিএজিং যৌগগুলোর শক্তিশালী ঘনত্ব রয়েছে, যা ত্বককে পুনরুজ্জীবিত করে। ত্বকের মৃত বা মৃত কোষগুলোকে নির্মূল করতে, কালো দাগ এবং বয়সের বলিরেখাগুলো দূর করতে এই মাশরুম কার্যকর। চায়ের মাধ্যমে অথবা কাঁচা চিবিয়ে এটি খাওয়া যায়। এর উপাদান ড. অ্যান্ড্রু ওয়েল ফর অরিজিনস মেগা মাশরুম লাইন, পেরিকোন এমডি ট্রাভেল বুস্টার, মুন জুস ভ্যানিলা মাশরুম প্রোটিন পাউডারসহ বিভিন্ন রূপচর্চাকারী পণ্যে পাওয়া গেছে।
চাগা প্রতিরক্ষামূলক মাশরুম। এটি জাপান, চীন, কোরিয়া, উত্তর আমেরিকাসহ বিশ্বের কয়েকটি শীতল জলবায়ু সমৃদ্ধ অঞ্চলে বার্চ গাছের ওপরে বেড়ে ওঠে। চাগা মাশরুমগুলো দেখতে সুন্দর নয়। এগুলো কয়লার দন্ডের মতো। তবে কুৎসিত এই মাশরুমগুলোই ত্বককে চমৎকারভাবে সুন্দর ও মসৃণ করে তোলে। চাগা সাধারণত চায়ের সঙ্গে খাওয়া হয়। চায়ের পানিতে এক ঘণ্টার জন্য টুকরো টুকরো করে এই মাশরুম জ্বাল দিতে হবে। চাগাগুঁড়াও কিনতে পাওয়া যায়, তা গরম পানিতে নাড়াচাড়া করে অনেকটা কফির মতো পান করা যায়। এই মাশরুমের উপাদান পাওয়া যায় প্ল্যান্টিঅক্সিডেন্টস চাগা এবং জিনসেং সেরাম, টুন্ড্রা চাগা প্রেস সেরাম, মুন জুস চাগা, ইউফোরিয়া ওয়াইল্ড চাগা ফেসওয়াশ, সান পশন চাগাসহ আরও নানা পণ্যে।
মডেল: আনসা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: জিয়া উদ্দীন