skip to Main Content

ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I কৃতী চতুষ্টয়

ফ্যাশন দুনিয়ায় নারী সাংবাদিকদের গুরুত্ব উপেক্ষণীয় নয়। কিন্তু এমন কজন আছেন, যারা প্রভাবিত করেছেন পোশাকের বৈশ্বিক সংস্কৃতিকে। সে রকম চার প্রতিভাময়ীকে নিয়ে এই আয়োজন। লিখেছেন ফাহমিদা শিকদার

আনা উইন্টর (ভোগ ইউএস)

আনা উইন্টর (ভোগ ইউএস)

যদি ভোগ ম্যাগাজিনকে ফ্যাশনের বাইবেল বলা হয়, তাহলে আনা উইন্টর হচ্ছে ফ্যাশন দুনিয়ার হাই প্রিস্টেস। তাকে নিয়ে একটা গুজব বেশ প্রচলিত। ফ্যাশন দুনিয়াটা তিনিই চালান। হয়তো এ জন্য তার ডাকনাম ‘নিউক্লিয়ার উইন্টর’।
তার বাবা চার্লস উইন্টর ছিলেন লন্ডনের ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড নামের একটি সংবাদপত্রের এডিটর। ছোটবেলা থেকে আনা ছিলেন স্বাধীনচেতা। স্কুলে পড়ার সময় প্রায়ই তিনি সেখানের ড্রেস কোডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। কারণ, তিনি ইউনিফর্ম পরতে চাইতেন না। তিনি শর্ট স্কার্ট পরতে খুব পছন্দ করতেন। তাই স্কুলের স্কার্টগুলো কেটে পরতেন। এ জন্য অবশ্য তাকে শাস্তি পেতে হয়েছে অনেক।
সে সময় তার বাবা চার্লস উইন্টর বিখ্যাত বুটিক ‘বিবা’তেও চাকরি জোগাড় করে দিয়েছিলেন। এ ছাড়া সময় পেলেই মেয়েকে দিয়ে নিজের পত্রিকার এডিটিংয়ের কাজ করিয়ে নিতেন। এভাবেই সম্পাদনায় আনার হাতেখড়ি হয়েছিল। নর্থ লন্ডন কলেজিয়েট স্কুল থেকে ড্রপ আউট হওয়ার পর তিনি লন্ডনে অবস্থিত বিশ্বে বিখ্যাত লাক্সারি ডিপার্টমেন্ট স্টোর হ্যারডসে, ট্রেনিং প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে যখন হারপার’স বাজার, হারপার’স অ্যান্ড কুইন হলো, তখন আনাকে নিয়োগ দেওয়া হয় এর প্রথম এডিটোরিয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টস হিসেবে। ফ্যাশন সাংবাদিকতায় তার শুরুটা এভাবেই। এর কয়েক বছর পরে আনা পাড়ি জমান নিউইয়র্কে। সেখানে গিয়ে জুনিয়র ফ্যাশন এডিটর হিসেবে যোগ দিলেন হারপার’স বাজার ইউএস-এ। কিন্তু তার ঠিক নয় মাস পর তাকে, তার অদ্ভুত ফটোশুট আইডিয়ার জন্য সেখান থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর আট বছর তিনি ফ্যাশন এডিটর হিসেবে কাজ করেন ‘ভিভা’ এবং ‘নিউইয়র্ক’ ম্যাগাজিনে। ১৯৮৩ সালে তিনি হন ভোগ ইউএস-এর প্রথম ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর। সেখানে তিনি নিজের ইচ্ছেমতো অনেক কিছুরই পরিবর্তন করতেন। এর জন্য মাঝেমধে তখনকার এডিটর-ইন-চিফ গ্রেস মিরাবেলা এবং অন্যান্য কর্মীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব বেধে যেত। ১৯৮৫ সালে তিনি ফিরে আসেন নিজ জন্ম শহর লন্ডনে। ভোগ ম্যাগাজিনের ইউকে এডিশনের এডিটর-ইন-চিফ হিসেবে। সেখানে তিন বছর যেতে না যেতে আবার ডাক আসে নিউইয়র্ক থেকে। গ্রেস মিরাবেলার পর আনা উইন্টর হলেন ভোগ ইউএস এডিটর-ইন-চিফ। শুরু হলো ফ্যাশনে নতুন ‘উইন্টর যুগ’, যা এখনো চলছে। তার সময়ে আমেরিকান ভোগের প্রিন্ট এডিশনের পাঠকসংখ্যা পৌঁছেছে ১২ মিলিয়নে এবং অনলাইন পাঠক মাসে গড়ে ১ দশমিক ২ মিলিয়ন। আনা উইন্টর ফ্যাশন ম্যাগাজিনের গতানুগতিক ধারা একেবারে বদলে দেন। তিনিই প্রথম ম্যাগাজিনের কভারে সেলিব্রিটিদের নিয়ে আসেন। ফটোশুটের লোকেশন স্টুডিও থেকে রাস্তায় নিয়ে আসেন। ফ্যাশনের উন্নয়নের জন্য গড়ে তোলেন ফ্যাশন নাইট আউটের মতো ফান্ড। নতুন আমেরিকান ফ্যাশন ডিজাইনারদের সহায়তা করতে তিনি। সিএফডিএ/ভোগ ফ্যাশন ফান্ড চালুর উদ্যোগ নেন। এত কিছুর পরও বিতর্ক তার পিছু ছাড়েনি। ফারের কোট তার খুব প্রিয়। ভোগের অনেক ফটোশুটে ফার লেদার দিয়ে তৈরি পোশাক প্রায়ই দেখা যায়। এ জন্য অসংখ্যবার প্রাণী অধিকার সংরক্ষণ কর্মীদের, তোপের মুখে পড়তে হয়েছে তাকে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে নারীত্ব এবং সৌন্দর্যে কেবল অভিজাতদের রুচি প্রচারের জন্য ম্যাগাজিন ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু এসব বিতর্কের জন্য আনার জনপ্রিয়তায় কখনো ভাটা পড়েনি। এত বছর পরও গ্লোবাল ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে আনা উইন্টর সবচেয়ে বড় প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে আছেন।
নিনা গারসিয়া (এল)

নিনা গারসিয়া (এল)

একজন স্বনামধন্য ফ্যাশন সাংবাদিক এবং লেখক। বর্তমানে লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন ‘এল’-এর আমেরিকান এডিশনের এডিটর-ইন-চিফ। তিনিই প্রথম লাতিন নারী, যিনি আমেরিকার ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে কোনো বড় পদে নিয়োজিত। নিনার জন্ম কলম্বিয়ার বারানকুইয়ায়, ৩ মে, ১৯৬৫ সালে। তার বাবা ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। মা সিসিলিয়া ডি গারসিয়া ছিলেন অভিনেত্রী। ছোটবেলায় নিনাকে তিনি ফ্যাশন এবং গ্ল্যামার জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সিসিলিয়া ডি গারসিয়া, নানা রকমের ড্রেস পরতে পছন্দ করতেন। এবং তার ছিল নান্দনিকতা সম্পর্কে গভীর ধারণা। নিনা তার কাছ থেকে বিউটি, ফ্যাশন, স্টাইল নিয়ে অনেক কিছু শিখেছিলেন। এ ছাড়া শৈশবে মা-বাবার সঙ্গে বিভিন্ন শহর, বিশেষ করে প্যারিস, লন্ডন, নিউইয়র্ক ঘুরে দেখেছেন। ফলে সেসব স্থানের সংস্কৃতি ও ফ্যাশন সম্পর্কে দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার।
১৫ বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান নিনা। সেখানে স্কুলের পাঠ চুকিয়ে লিবারেল আর্টস নিয়ে পড়াশোনা করেন, বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে। এরপর বিখ্যাত ফরাসি ফ্যাশন প্রাইভেট স্কুল ‘এসমোদ’ এ বিশেষ কোর্স সম্পন্ন করেন। এরপর ফ্যাশন মার্চেন্ডাইজিংয়ের ওপর ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন, ফ্যাশন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি নিউইয়র্ক থেকে। নিনার ফ্যাশন ক্যারিয়ার শুরু হয় ফ্যাশন হাউস পেরি এলিসের জনসংযোগ বিভাগে, ইন্টার্নশিপ দিয়ে। তখন এর প্রধান ডিজাইনার ছিলেন মার্ক জ্যাকব। নিনার প্রথমে ইচ্ছা ছিল ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার। কিন্তু ইন্টার্নশিপ চলাকালীন তিনি ফ্যাশন জগৎ সম্পর্কে অনেক কিছু আবিষ্কার করেন। এবং বুঝতে পারেন, তিনি আসলে ফ্যাশন সাংবাদিক হতে চান। এরপরই অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টাইলিশ এবং মার্কেটিং এডিটর হিসেবে যোগ দেন, সাবেক ভোগ ইউএসের এডিটর-ইন-চিফ গ্রেস মিরাবেলার প্রতিষ্ঠিত মহিলাদের ম্যাগাজিন ‘মিরাবেলা’তে। ১৯৯৫ সালে ‘এল’ ম্যাগাজিনে ঢোকেন। ২০০০ সালে তিনি সেখানে ফ্যাশন ডিরেক্টর হিসেবে প্রমোশন পান।
ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে তিনি পর্দার আড়ালে কাজ করতে পছন্দ করতেন। কিন্তু ২০০৪ সালে নতুন ফ্যাশন ডিজাইনার বাছাইয়ের প্রতিযোগিতায়, আমেরিকান টিভি রিয়েলিটি শো ‘প্রজেক্ট রানওয়ে’র বিচারক নির্বাচিত হলে তিনি স্পটলাইটে আসেন। গঠনমূলক সমালোচনা, পক্ষপাতহীন মূল্যায়ন এবং প্রতিযোগীদের উদ্দেশে দেওয়া পরামর্শ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এর বদৌলতে ‘দ্য ভিউ’ এবং ‘টুডে’র মতো বিখ্যাত অনুষ্ঠানে ফ্যাশন বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি ২০০৭ সালে মেক্সিকো সিটিতে আয়োজিত মিস ইউনিভার্সেও বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে ‘মেরি ক্লেয়ার’-এর ফ্যাশন ডিরেক্টর হন। ২০১৩ সালে হন এর ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে নিনা ‘এল’ ম্যাগাজিনের এডিটর-ইন-চিফ নিযুক্ত হন।
স্টাইরের ওপরে নিনা গারসিয়ার লেখা চারটি বই নিউইয়র্ক টাইমসে বেস্টসেলিংয়ের স্বীকৃতি লাভ করেন। সেগুলো হলো—দ্য লিটল ব্ল্যাক বুক অব স্টাইল (২০০৭)। দ্য ওয়ান হান্ড্রেড: আ গাইড টু দ্য পিসেস, এভরি স্টাইলিশ উমেন মাস্ট ঔন (২০০৮), ‘দ্য স্টাইল স্ট্র্যাটেজি (২০০৯) এবং নিনা গারসিয়া’স লুক বুক (২০১০)। ফ্যাশনে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ফ্যাশন গ্রুপ ইন্টারন্যাশনালের মর্যাদাপূর্ণ ওরাকল অ্যাওয়ার্ড, হিস্পানিক ফেডারেশনের ইনডিভিজুয়াল অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন।

সামিরা নাসরি (হারপার’স বাজার)

সামিরা নাসরি (হারপার’স বাজার)

গত বছরের জুলাইয়ে সামিরা নাসরি হারপার’স, বাজারের আমেরিকা এডিশনের এডিটর-ইন-চিফ নিযুক্ত হন। এই ম্যাগাজিনের ১৫৩ বছর ইতিহাসে তিনিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ এবং মুসলিম এডিটর-ইন-চিফ। এর আগে আমেরিকার কোনো ফ্যাশন ম্যাগাজিনের শীর্ষ পদে কোনো মুসলিম নারীকে দেখা যায়নি। কানাডার মন্ট্রিয়লে বেড়ে ওঠা সামিরার বাবা লেবানিজ এবং মা ত্রিনিদাদের বাসিন্দা। তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি স্কুল অব জার্নালিজম থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তার ফ্যাশন ক্যারিয়ারের শুরুটা হয় ‘মিরাবেলা’ ম্যাগাজিনে ইন্টার্নশিপের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সেখানে দ্রুত আবিষ্কার করলেন যে লেখক হিসেবে তিনি খুব একটা ভালো নন। এরপর তিনি ভোগ ম্যাগাজিনের মার্কেট অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিছুদিন পর সামিরা এই ডিপার্টমেন্ট থেকে ইস্তফা দিয়ে কিংবদন্তি স্টাইলিশ এবং ভোগ ম্যাগাজিনের সাবেক ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর গ্রেস কোডিংটনের অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে অনেক বছর কাজ করেন। এ সময়ে গ্রেসের কাছ থেকে ফ্যাশন এবং স্টাইলিংয়ের খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে জানতে পারেন। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একজন প্রতিভাবান স্টাইলিশ হিসেবে সামিরা দীর্ঘদিন ফ্রিল্যান্সিং করেন। এরপর তিনি ‘ইনস্টাইল’-এর স্টাইল ডিরেক্টর এবং ‘এল’-এর ফ্যাশন ডিরেক্টর হন। হারপার’স বাজারে যোগ দেওয়ার আগে তিনি বিখ্যাত ভ্যানিটি ফেয়ার ম্যাগাজিনের ফ্যাশন ডিরেক্টর ছিলেন।

জেসিকা পেলস (কসমোপলিটন)

জেসিকা পেলস (কসমোপলিটন)

আমেরিকার অন্যতম বিখ্যাত এন্টারটেইনমেন্ট, উমেন’স ফ্যাশন ম্যাগাজিন কসমোপলিটনের এডিটর-ইন-চিফ। তিনিই ম্যাগাজিন ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ এডিটর-ইন-চিফ। তার জন্ম আমেরিকার আটলান্টা জর্জিয়ায়, ১৯৮৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। তার পড়াশোনার বিষয় ছিল ফিল্ম প্রডাকশন। এ নিয়ে জেসিকা ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি টিশ স্কুল অব আর্টস থেকে। এরপর তিনি ইন্টার্নশিপ করেন ‘দ্য নিউইয়র্কার’ এবং ‘ভোগ’ ম্যাগাজিনে। এরপর জেসিকা কাজ করেন ‘গ্ল্যামার’ এবং ‘টিন ভোগ’-এ। ২০১৪ সালে ‘ম্যারি ক্লেয়ার’-এ যোগ দেন ডিজিটাল ডিরেক্টর হিসেবে। এখানে তিনি নারীসম্পর্কিত বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ফিচার তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এগুলোর মধ্যে বেশি প্রশংসিত হয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র রক্ষাকারী নারীদের প্রোফাইল এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর নারীবাদ নিয়ে লেখা প্রবন্ধ। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে জেসিকা ‘কসমোপলিটন’ ম্যাগাজিনের ডিজিটাল ডিরেক্টর হিসেবে নিযুক্ত হন। সে বছরের মে মাসের মধ্যেই ম্যাগাজিনের ডিজিটাল প্রোফাইল পুনর্নির্মাণ করেন। তার উপস্থিতিতে মাত্র কয়েক মাসে কসমোপলিটন ম্যাগাজিনের ডিজিটাল সাবস্ক্রিপশন ১৮৫ শতাংশ বেড়ে যায়। এ জন্য ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে জেসিকাকে এ ম্যাগাজিনের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। ফ্যাশন ম্যাগাজিনে তার সাফল্যের জন্য ২০১৯ সালে অ্যাডউইক তাকে ‘এডিটর অব দ্য ইয়ার’ মর্যাদায় ভূষিত করে।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top