ছুটিরঘণ্টা I ডুয়ার্সের রহস্যে
নদী, পাহাড় আর রোদ-বৃষ্টির খেলায় ডুয়ার্সের চা-বাগান মনোরম এক স্থান। শান্ত, রহস্যময় এবং নির্জন। সবুজের স্নিগ্ধতায় মোড়ানো। সেখানে বেড়ানোর চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন ফাতিমা জাহান
মেঘের মতো একরাশ সবুজ ঘিরে আছে, যেন একটু পরেই একপশলা ঝরিয়ে পূর্ণ দেবে সব শূন্য জায়গা। স্থানটির নাম ডুয়ার্স। এর সবুজ ছড়িয়ে আছে পাহাড়ি এলাকার প্রতিটি ঢালে। মানে, চা-বাগান ডুয়ার্সের সৌন্দর্য।
কুমাই নামের একটা পাহাড়ে, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা বিজয় থাপার বাড়িতে উঠেছি। রাগী চেহারার এই ভদ্রলোক নিজ বাড়ির একাংশে হোম স্টে করেছেন। আসার পর একবারই হাই হ্যালো হয়েছে। ঘর, হোম স্টে সামলান তার স্ত্রী ও গৃহকর্মী। এরা জাতিতে নেপালি গোর্খা। খুব সহজেই মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত আমি। আর এদের বাড়িতে থাকা-খাওয়ার পুরোটাই ঘরোয়া পরিবেশে।
বারান্দা থেকে দেখা যায়, সামনের উপত্যকা ঢালু হয়ে নিচে নেমে গেছে, আর একটা সরু পথ এঁকেবেঁকে নেমেছে। বোশি হলে দিনে দু-তিনটি গাড়ির চলাচল এখানে। বাকি সময় বাঁধভাঙা নীরবতা।
চা-বাগানের ঘ্রাণ পাওয়া যায় এখান থেকে। কান পাতলে দূরের পাহাড়ের মেঘেদের সাদা থেকে ধূসর হওয়ার ধ্বনি। বর্ষাকালে বাংলার রূপ খোলে। বিচিত্র ফুলের স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পরে। তাজা রঙে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ভেজা প্রান্তর।
এ সময় ডুয়ার্সেরও রূপ ছলকে ছলকে পড়ে। ভ্রমণপিয়াসীদের কাছে চা-বাগানই মূল আকর্ষণ। আর বর্ষায় এটি হয়ে ওঠে পূর্ণযৌবনা।
পাহাড়ি পিচ্ছিল পথ আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি না থাকলে ডুয়ার্সের রূপ খোলে না। গতকাল আলিপুরদুয়ার থেকে এসেছি। ভারতের উত্তরবঙ্গ মানেই চা-বাগানের ছড়াছড়ি। কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গে আসতে, পথে পথেই মিলেছে চা-বাগানে দৃষ্টিনন্দন রূপ।
অনেকেই বলে, গাছেরা কথা বলতে পারে না, কিন্তু উত্তরবঙ্গে এলেই মনে হয়, চা-বাগান কথা বলতে শুরু করে আমার সঙ্গে। ঘন ঘোর বরষায় ভিজে, জলের তোড়ে হাতড়ে হাতড়ে বলে তার বুড়িয়ে যাওয়ার গল্প। আবার কখনো হালকা বরিষনে নেচে নেচে হাওয়াকে দেয় সুড়সুড়ি। কিছু কিছু চা-বাগান একেবারে সমতলে। মজার ব্যাপার হলো, সমতলে ধানক্ষেতের মতো চা-বাগানের সারি ভারতের উত্তরবঙ্গেই দেখা যায়। এ-ও এক বিস্ময়। ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকালে মনে হয়, অসীম সবুজের গালিচার ওপাড়ে পাহাড় দাঁড়িয়ে রোদ পোহাচ্ছে। একটু পথ পাড়ি দেবার পর আরও নির্জনতা নামে। চেখে পড়বে শ্রমিকদের চা-পাতা তোলার ব্যস্ততা। এদের কেউ বাঙালি, কেউ নেপালি, কেউ সাঁওতালি।
ডুয়ার্সের চা আর ভারতের অন্যান্য চায়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। এই বাগানের চা হালকা স্বাদের, মৃদু খয়েরি-সোনালি মিশেলে বেশ একটা মিষ্টি সুরভিতে ধোঁয়া উড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে। স্বাদ মোটেই তিতকুটে নয়, সতেজ। সামসিং চা-বাগান ডুয়ার্সে বেশ খানিকটা জায়গাজুড়ে এর রূপ মলিন হয় না কখনো।
সবে খানিকটা বৃষ্টি ঝরিয়ে ফরসা হলো আকাশ। এখন না বেরোলে ভিজে ভিজে চা-বাগানে ঘুরতে হবে। এমনও জায়গা হয়! পিচ ঢালা পথের দুপাশে ঘন চা-বাগান, ভেতরে এর গভীরতা আরও বেশি। সবুজ, উজ্জ্বল চা-পাতার সুগন্ধে বাগানটি নিবিড় হয়ে ওঠে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে শাল, সেগুন আর রেইনট্রি। মাঝখান দিয়ে পথ চলে গেছে আরও ভেতরে অন্য কোনো সবুজের জগতে। এখন ব্যস্ততা চা-শিল্পীদের। খুব সাবধানে তুলতে হয় চা-পাতা গাছের শরীর থেকে। এদের বেশির ভাগই নারী। মাথায় সিঁদুর, হাতে শাঁখা আর শাড়ি বা ম্যাক্সির ওপর একটা লম্বা শার্ট পরে, আপন মনে সযত্নে তুলে নিচ্ছে কুঁড়ি নয়তো পাতা। এখান থেকে চা যাবে কারখানায় শুকাতে, তারপর কয়েক হাত ঘুরে আসবে আমাদের ঘরের পেয়ালায়। এরই মাঝে মূল সড়কে এসে গেছে পিকআপ ভ্যান, চা-পাতা তুলে কারখানায় নিয়ে যাবে। আর দুপুরের খাবার সময়ও হয়ে এসেছে। এক এক করে সবাই চা-বাগান থেকে সামনের খানিকটা জায়গায় এসে জড়ো হলো। খুব জলদি খেয়ে তা আবার কাজে ফিরতে হবে তাদের। নারী-পুরুষ সবার সাইকেল এক পাশে রাখা, টিফিন বক্স নিয়ে সবাই বসে গেল। এদের সর্দার চন্দ্রদেব। যেমন সুন্দর নাম, তেমন মিষ্টি ব্যবহার। এ বাগানের দৈনিক মজুরি মাত্র ১৭৫ টাকা।
মাত্র ১৭৫ টাকা! কী হয় এ দিয়ে। ভারতে বিড়িশ্রমিকদের দৈনিক মজুরি এর দ্বিগুণ। অথচ কী শান্ত মুখে এরা দুপুরের খাবার খাচ্ছে। কাজ শেষে এই অল্প কটা টাকা নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে, সংসার করছে, সন্তানের ভরণপোষণ চালাচ্ছে। এদের চোখে-মুখে একটুও বিরক্তি নেই। খাওয়া শেষে দল বেঁধে আবার কাজে নেমে পড়ল। চা-পাতা তুলে একটা বড়সড় পোঁটলা বেঁধে জড়ো করে বাগানের রাস্তার ধারের ফাঁকা জায়গাটায়। চা-বাগানের আরও ভেতরের দিকে পাহাড়ের গা ঘেঁষে এদের ঘর।
আমাকে যে ট্যাক্সিচালক এখানে নিয়ে এসেছেন, তিনি ডানকানের বাগান ম্যানেজারকে চেনেন। আমিও খুব উৎফুল্লতায় বললাম, ‘তাহলে আমরা সেখানেও বাগানে যাচ্ছি।’ এই বাগান খুব দূরে নয়। ডুয়ার্সে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজরা যখন চা-বাগান করার উদ্যোগ নেয়, প্রথম দিকের বাগান এই ডানকান। এখন তো এই কোম্পানি সবারই চেনা।
এই চা-বাগানের ম্যানেজারের নাম সুব্রত। তিনি বাঙালি। বেশ উৎসাহ নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখালেন। এর মাঝে একপশলা বৃষ্টি এসে পথ রোধ করল। মৃদু ঠান্ডায়, টিপটিপ বৃষ্টিতে চা পানের চেয়ে বেশি উপভোগ্য কিছু নেই। আমার জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে আসা হলো এ এলাকার বিখ্যাত হোয়াইট টি। ব্ল্যাক টি, গ্রিন টি পান করেছি। চীন বা তুরস্কে বিভিন্ন ফুল, ফলের চাও; কিন্তু সাদা চা আবার কেমন পানীয়!
হোয়াইট টি-এর পাতা সাধারণ বা ব্ল্যাক টি কিংবা গ্রিন টি-এর মতো কালো নয়। কেমন একটু সাদাটে বাদামি রঙের। সাদা চা কাপে ঢাললে দেখতে হালকা ঘিয়ে রঙের, পুরোপুরি সাদা নয়। একেবারে লাইট ফ্লেভারের। লিকার আরও হালকা হলে অবশ্য পানি আর চায়ের রং আলাদা করা যাবে না। সামনে অবারিত উদার চা-বাগান, হাতে চায়ের কাপ নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে হেঁটে চা পান করার অভিজ্ঞতাই অসামান্য।
ডুয়ার্সের চা-বাগানকে বাঙালির কাছে পরিচিত করেছিলেন লেখক সমরেশ মজুমদার। সাতকাহন বা কালবেলা উপন্যাসে এই বাগানের বর্ণনা রয়েছে। তবে ভারতের চা-শিল্পীদের প্রায় সবার গল্প একই। তাদের জীবন বর্ষায় ভেজা সতেজ চা-পাতার মতোই স্নিগ্ধ ও সহজ।
ডুয়ার্সে সব পথ চা-বাগানের বুক চিরেই গন্তব্যের দিকে গেছে। কাছেই রকি আইল্যান্ড। সত্যিই কি সেটা দ্বীপ? বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালিম্পংয়ের বাড়িটি, সেখানে যাবার জন্যও সেই হালকা সবুজ থেকে গাঢ় হয়ে যাওয়া ঢালু পাহাড়ের ডাক আর বর্ষার রিমঝিম শুনতে শুনতে পথ পাড়ি দেওয়া।
রকি আইল্যান্ড আসলে কোনো দ্বীপ নয়। একটা নদীর একটুখানি অংশ। এ জায়গার নাম হতে পারত গ্রিন আইল্যান্ড বা সবুজ দ্বীপ। এক টুকরা রুপালি নদীকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে দুই পাশের সবুজ চা-বাগান। নদীর বুকে ব্যারিকেড দিয়ে এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে বড় বড় পাথার। সে কারণেই নাম হয়েছে রকি।
নদীর নাম মূর্তি। এই প্রথম এর দেখা পেলাম। এখানে নদী অপ্রতিরোধ্য। বড় বড় পাথর পেরিয়ে বয়ে চলেছে। সেকি ¯্রােত! এ সময় নদীতে নামলে আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। তীর ধরে খানিক এগোলে আবার মিলবে চা-বাগান। সবুজ এখানেও অবারিত। আর বড় বড় গাছ তো দাঁড়িয়েই আছে।
সমতলে নদী দেখার পর আমার মনে হলো, পাহাড়ের একদম চূড়ায় যাদের বসবাস, তাদের কাছে গেলে কেমন হয়। আমার হোম স্টে এই পথের মাঝে পড়ে। সেটি পার হয়ে আরও উঁচুতে চলে গেলাম ট্যাক্সি নিয়ে। জায়গাটার নাম আপার কুমাই। এখানে অল্প কয়েক ঘর নেপালি বসবাস করে। কাছেই একটা স্কুল আছে। তিনজন বাচ্চা পরিচ্ছন্ন পোশাকে স্কুল শেষে বাড়ি ফিরছে। পাহাড়ি এলাকার আবহাওয়ার কোনো ঠিক নেই। এই রোদ তো সেই বৃষ্টি।
পাহাড়ের এক কোণ থেকে দেখা যায় কুমাই চা-বাগান। আমার হোম স্টে থেকেও এটি দেখা যায়। কিন্তু যেভাবেই দেখি না কেন, চা-বাগানটি খুব রহস্যময় মনে হয়। একদম ওপর থেকে ঢালু হয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে নামতে কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। আবার এ-ও মনে হবে, অপর পাশ থেকে নদীতে পা ধুয়ে কেউ উঠে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
কুমাই পাহাড়ের একদম ওপরে গিয়ে দেখা হলো আরও কয়েকজন চা-শিল্পীর সঙ্গে। এরা সবে ঘরে ফিরলেন। গায়ে সাধারণ জামা, পায়ে গামবুট আর মুখে সেই হাসি। দেখলেই বোঝা যায়, অল্পতেই সুখী এরা। এদিকে ঘন জঙ্গল, পাহাড় আর চা-বাগান হাতছানি দিচ্ছে। সন্ধ্যা হতে আর দেরি নেই।
এরই মধ্যে চা আর আড্ডার জোগান দিয়ে যান মিসেস থাপা। কর্মসূত্রে ছেলেরা থাকে অন্য রাজ্যে। এখানে অতিথিরাই আত্মীয়।
এ জায়গা থেকে দূরের পাহাড় বা চা-বাগানকে এখন চাঁদোয়া করেছে থোকা থোকা মেঘ। কিন্তু হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না এটি। উড়ে আসে আমার মতো আরেক দল ধূসর মেঘ। এরাও চায় পাহাড়, বনভূমিকে জয় করতে, বড় বড় ফোঁটায় ভিজিয়ে দিতে। যাতে গাঢ় সবুজ রঙে জীবন্ত হয়ে ওঠে উছলে পড়া কয়েকটি ছুটির দিন।
ছবি: লেখক