ফিচার I চা পরিবেশনের শিল্প
আপ্যায়নরীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে চা পরিবেশনের সৌন্দর্য। পরিবেশকে উপভোগ্য করে তোলাও এর উদ্দেশ্য। লিখেছেন সিফাত বিনতে ওয়াহিদ
‘হরেক রঙের বাহারে/ সকাল হলো আহা রে/ চুলার পারে উড়ছে ধোঁয়া/ এক কাপ চা/ শিশির ভেজা দেহটাকে ঢাকছে কুয়াশা’। জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘জলের গান’-এর এই গান শুনে বাঙালির চা-প্রীতি অনুমান করা যায়। ঘুম থেকে উঠে এক কাপ চা না খেলে সকাল শুরুই হয় না। কিন্তু শুধু কি পেয়ালা ভর্তি চা খেলেই হবে? জীবনের সব ক্ষেত্রেই যেমন কিছু বিধান মেনে চলতে হয়, চা পরিবেশনের ক্ষেত্রেও রয়েছে সে রকম কিছু নিয়ম এবং এটিকেট। এখান থেকেই চা পরিবেশনের সঙ্গে মানুষের সৌন্দর্যবোধের সম্পর্ক টের পাওয়া যায়। সংস্কৃতির ভিন্নতা অনুযায়ী চা পরিবেশনেও রয়েছে পার্থক্য।
আমন্ত্রণটি ফরমাল বা ক্যাজুয়াল যেমনই হোক, পরিবেশনের সৌন্দর্যে ঘাটতি মানে আতিথ্যের প্রতি উদাসীনতার প্রমাণ। প্রশ্ন জাগতে পারে, চা পরিবেশনের আবার রীতি কী? নানা ঢঙের কাপে ঢেলে অথবা টি-পটে চা রেখে, আলাদা কাপ-পিরিচ-চামচ-দুধ-চিনি রাখলেই হয়ে যাচ্ছে, ব্যস! আসলে কিন্তু এমন নয়। আমরা কতটুকুই-বা জানি! পুরো পৃথিবীতে রয়েছে নানা রকম আচার-বিচার, সংস্কৃতি, নিয়মকানুন বা রীতি! পরিবেশন যে অনেক বড় একটি শিল্প, এটাই অধিকাংশ মানুষ জানেন না। এর মাধ্যমেই পাওয়া যায় ব্যক্তিক বা পারিবারিক রুচির পরিচয়।
আমন্ত্রিত অতিথির যেন কোনোভাবেই মনে না হয়, সাদামাটা কাপ-পিরিচে তিনি গরম পানি খাচ্ছেন! গ্রিন টি হোক বা ব্ল্যাক টি; দার্জিলিংয়ের হোক বা সিলেটের, পরিবেশনায় এবং চুমুকে যেন মুগ্ধতা আসে, তা লক্ষ রাখা জরুরি। চায়ের পরিবেশনায় নানা রকম রীতি আছে। চাইলে রান্নাঘর থেকেই কাপে চা ঢেলে, ট্রে-তে করে একেবারে সাজিয়ে নিয়ে আসা যায়। আবার আলাদাভাবে কাপ-পিরিচ সাজিয়েও করা যায়। পরিবেশ কী চাইছে, সেটার ওপর নির্ভর করে পরিবেশনা। সবকিছু পৃথকভাবে রাখার মধ্যে আভিজাত্য প্রকাশ পায়। সে ক্ষেত্রে গরম পানিতে চা-পাতা মেশানোর পর টি-পটটিকে টি-কোজি পরিয়ে রাখা যায়। এতে চা অনেকক্ষণ গরম থাকবে। প্লাস্টিকের ট্রের প্রচলন ইদানীং পুরোনো ট্রেন্ড বলেই মনে হয়। এর বদলে ব্যবহার করা যায় কাঠ, বাঁশ, বেত বা কাচের ট্রে। চীনামাটির টি-সেটও এখন বেশ পুরোনো হয়ে গেছে। এর বদলে সিরামিক বা মাটির ভাঁড় ব্যবহারে ভিন্নতা আসে।
চা আপ্যায়নের ক্ষেত্রে টি-পট অনেকের কাছেই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাজারে বিচিত্র রকমের এই তৈজস পাওয়া যায়। গরম রাখার জন্য এর কোনো কোনোটির সঙ্গে ওয়ার্মার থাকে। টি-পটের নকশার সঙ্গে মিল রেখে চিনি আর দুধের জন্য আলাদা পাত্র ব্যবহার করা ভালো। তাতে রুচির প্রমাণ মেলে। চাইলে একই নকশায় তৈরি চায়ের কাপ এবং সুগার ও মিল্ক পটও রাখা যায়। একইভাবে টি-পট, চায়ের কাপ এবং এর সঙ্গে আর যা যা থাকবে, সেসব একই নকশার হলে আসবে ভিন্নতা। পরিবেশনের সময় সবকিছু ট্রেতে রাখা যায় অথবা পিরিচের ওপর কাপ রেখে ছোট একটা চামচ দিয়ে অতিথির হাতে দিলে রুচির ভিন্নতা আসবে। তবে অতিথির হাতে কাপ দেওয়ার আগে টি-কোস্টার পেতে দেওয়া যায়। যদি টি-ব্যাগ হয়, কাপ অতিথিকে না দেওয়াই ভালো। কোনো অবস্থাতেই হাত বা চামচ দিয়ে অতিথির সামনে এটি চাপা যাবে না। এ জন্য হাতের কাছেই একটি ছোট্ট বিন বা টিস্যু রাখা যায়। চায়ের টি-সেটের সঙ্গে মিল রেখে ট্রে থেকে শুরু করে টি-কোস্টার, টি-কোজি, টিস্যু পেপারের বক্স এবং বিন— সবকিছুই মানানসই রাখা ভালো।
অতিথির সামনে চা পরিবেশনের সময় লক্ষ রাখতে হবে, যেন কাপ-পিরিচ বা চামচের শব্দ কম হয়। ভেতরে ফিলটার বা ছাঁকনি আছে কি না, আগেই চেক করে নিতে হবে। চা ঢালতে গিয়ে যেন কোথাও না পড়ে যায়, সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।
শুধু কাপ-পিরিচ, পটই নয়, পরিবেশনের ক্ষেত্রে টি-টেবিলও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আড্ডার মেজাজ মূলত নির্ভর করে টেবিল সেটিংয়ের ওপর। এটিও রুচির অংশ। সাধারণত সাদা বা অফ হোয়াইট রঙের টেবিলক্লথই অধিকাংশ মানুষ ব্যবহার করে। তবে সন্ধ্যাকালীন চায়ের আমন্ত্রণে উজ্জ্বল রঙের নকশা ব্যবহার করা ভালো। টেবিলক্লথের সঙ্গে মিলিয়ে কাপড়ের ন্যাপকিন ইউজ করা যায়। টি-টেবিলে ন্যাপকিন একটি অপরিহার্য উপাদান। এমনকি নকশা করা ফুলদানিতে রাখা যায় কিছু তাজা ফুল, যা আপ্যায়নের পরিবেশকে উপভোগ্য করে তুলবে।
আমাদের দেশে দুধ-চায়ের প্রচলন একটু বেশি। অনেকেই মনে করে, দুধ-চা পরিবেশন করা বোধ হয় উন্নত রুচির পরিচয়। অথচ তারা হয়তো জানেনই না, অধিকাংশ ভালো মানের চা-দুধ চিনি যুক্ত না করেই খেতে হয়। সে ক্ষেত্রে দুধ-চিনি বা সুগার কিউব আলাদা পাত্রে পরিবেশন করা রুচিসম্মত। অতিথিরা প্রয়োজনে তাদের পছন্দ অনুযায়ীই ব্যবহার করতে পারবেন। দুধ ও চিনির সঙ্গে একটি আলাদা ছোট পাত্রে লেবুর স্লাইস রাখা যায়। যারা লিকার বা লাল চা খান, ওটা তাদের জন্য।
খালি মুখে শুধু চা পানে অতিথিকে বিদায় দেওয়া বেরসিক জাতি বাঙালি নয়। লাঞ্চের পরপরই কাউকে চায়ের নিমন্ত্রণ জানাতে চাইলে সেখানে নানা ধরনের কুকিজ; স্যান্ডউইচ, পেস্ট্রি এবং প্যাটির মতো হালকা নাশতা রাখা যেতে পারে। যদি সন্ধ্যায় বা ডিনারের আগে আগে কেউ চায়ের আমন্ত্রণে আসে; সে ক্ষেত্রে কেক, প্যাটি, স্যান্ডউইচের আকার বড় হতে পারে। সঙ্গে দেওয়া যেতে পারে নুডলস, শিঙাড়া, সমুচা, পুরি বা তেলে ভাজা আলুর চপ-বেগুনি, চিকেন বা চিজের বিভিন্ন পদও।
বাঙালির আপ্যায়নের সংস্কৃতির সঙ্গে চায়ের সম্পর্ক গভীর। কোনো বাড়িতে বেড়াতে গেলে এক কাপ চা না খেয়ে আসার নজির খুব একটা দেখা যায় না। যত আয়োজনই থাকুক, চা পরিবেশন না করতে পারলে অতিথি আপ্যায়নে যেন অপূর্ণতা রয়েই যায়।
ছবি: ইন্টারনেট