ফিচার I যেখানে আড্ডা জমে
নানা কারণে বিখ্যাত হয়ে ওঠে চায়ের দোকানগুলো। সমাগমস্থলের রূপ নেয়। বিশেষত মধ্যবিত্ত নগরজীবনে
এ দেশে চায়ের কাপে ঝড় তুলে বহু আন্দোলন গড়ে উঠেছে। সেসবের বেশির ভাগেরই উৎসস্থল ছিল চায়ের দোকান যেগুলো কয়েকটি কালের সাক্ষী হয়ে আছে।
ঢাকায় প্রথম চায়ের দোকান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এই শহরে এক চা-ওয়ালা গভীর রাতে সামোভারে ফেরি করে চা বিক্রি করতেন। যত দূর জানা যায়, প্রথম স্থায়ী চায়ের দোকান সূত্রাপুরের খাঁ সাহেবের। দেশভাগের পর নওয়াবপুরের আমজাদিয়া এবং আমিনিয়া রেস্তোরাঁ মালাই চা বিক্রি করে বেশ বিখ্যাত হয়েছিল। ওদিকে বাংলাবাজারে চায়ের জন্য বিখ্যাত ছিল মেহেরবান রেস্তোরাঁ।
পুরান ঢাকার অলিগলিতে অসংখ্য ছোট আকারের টং দোকান আছে। সার্বিক পরিবেশ আর সেবার মানের জন্যই এগুলোতে ভিড় হয়। আড্ডার জন্য দোকানগুলো বেশ জুতসই। বটতলা থেকে সোজা এগিয়ে এলে বাঁ দিকে পড়বে শেখ সাহেব বাজার দোতলা মসজিদ আর ডান দিকে বেশ কিছু ছোট ছোট চায়ের দোকান। শেখ সাহেব বাজার দোতলা মসজিদের কাছে প্রথম দোকানটি ফজরের আজানের আগেই খুলে যায়। নামাজের পর এখানে চাসহ বিভিন্ন ধরনের বিস্কুট ও রুটি পাওয়া যায়। এই দোকান বন্ধ হয় দুপুর সাড়ে ১২টায় অর্থাৎ জোহরের নামাজের আগে। পুরান ঢাকার স্বাভাবিকতায় এটি ব্যতিক্রম বটে।
ঠিক বিপরীত দিকেই রয়েছে আরেকটি ছোট দোকান। এখানকার রং-চা বেশ ভালো। তবে লালবাগ রোডে যেকোনো ধরনের চায়ের জন্য সেরা ‘মনির ভাই’র দোকান। এখানে শীতকালে সকাল-সন্ধ্যায় খাঁটি খেজুরের গুড়ের তৈরি দুধ-চায়ের কোনো তুলনা নেই। সব সময় ভিড় লেগে থাকা ছোট্ট দোকানটি; আড্ডার জন্যও বিখ্যাত। সকাল থেকে রাত ১২টা অবধি লাল রঙের টিন দিয়ে ঘেরা একাধারে তিনটি কেতলিতে মনিরের কার্যক্রম চলছেই। বিশেষ দিনে অবশ্য তার দোকান বন্ধ থাকে। পুরান ঢাকায় টং চায়ের দোকান বেশ জনপ্রিয়।
একসময় টিপু সুলতান রোডে এক চায়ের দোকানে আফিম মিশ্রিত চা বিক্রি হতো। সেখানে চা পানে আগ্রহীদের ভিড় লেগে থাকত সকাল থেকেই। একসময় শহরের সব পাড়ায় চায়ের দোকানির কাছে জমা হতো যত গল্প। কোন দেশে সরকারের পতন হয়েছে। কোন বই বেস্টসেলার হয়েছে বা কোন সিনেমা সুপার হিট ইত্যাদি।
পুরান ঢাকার খাঁ চা নামটি শুনে মনে হতে পারে, চা খেতে বলা হচ্ছে অথবা কাউকে বন্দি করে রাখার সেই খাঁচাকে বোঝানো হচ্ছে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, নামটি দিয়ে প্রসিদ্ধ চায়ের দোকানকে বোঝানো হয়েছে।
প্রাচ্যের ড্যান্ডি খ্যাত নারায়ণগঞ্জের বোস কেবিন একসময় দুই বাংলাতেই প্রসিদ্ধ ছিল। ১৯২১ সালে একটি টংঘরে এই বোস কেবিনের যাত্রা শুরু হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা নৃপেন চন্দ্র বসু। তিনি ভুলুবাবু নামেই পরিচিত। স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ দিনের একটি সময়ে বোস কেবিনে যেতেনই। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক, সাংবাদিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, গায়ক, শিক্ষক, অভিনেতা, রাজনীতিবিদ। কড়া লিকারের এই চা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সমরেশ বসু প্রমুখ। নারায়ণগঞ্জ ১ নম্বর ও ২ নম্বর রেলগেটের মাঝামাঝি, ফলপট্টির কাছাকাছি রেললাইনের পাশেই বোস কেবিন। রেস্তোরাঁ দেখতে মোটেই জাঁকজমকপূর্ণ নয়, কিন্তু এর খ্যাতি বিস্ময়কর।
ষাটের দশকের শেষ দিকে এবং সত্তরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত শরীফ মিয়ার ক্যানটিন ছিল কবি-সাহিত্যিকদের জন্য বিশেষ এক আড্ডার জায়গা। এটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির পেছনে। পরে এর সামনে স্থানান্তরিত হয়েছিল। কথিত আছে, মধুর ক্যানটিনে রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনগুলোর যেসব আড্ডা বা সভা হতো, শরীফ মিয়ার চা ফ্লাস্কে ভরে সেখানে নিয়ে যাওয়া ছিল সাধারণ প্রবণতা। উল্লেখ্য, শরীফ মিয়ার ক্যানটিনে বিখ্যাত কিছু কবিতাও রচিত হয়েছে। যেমন হেলাল হাফিজের ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। এখানে নিয়মিত আসতেন আবুল হাসান, আহমদ ছফা, নির্মলেন্দু গুণ, আফসান চৌধুরী, রফিক কায়সার, মোরশেদ শফিউল হাসান প্রমুখ।
আশির দশকের গোড়া থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চায়ের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল হাকিমের দোকান। লাইব্রেরি ভবনের দক্ষিণে মাঠ পেরিয়ে রেলিং ঘেঁষে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। তার সামনেই স্থানটি হাকিম চত্বর হিসেবে পরিচিত। উল্লেখ্য, বাংলা ১৪০০ সনের প্রথম দিনে সেখানে নিয়মিত আড্ডা দেন এমন কয়েকজন তরুণ লেখক মিলে এই নামটি দেন। ২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর হাকিম ভাই মারা যান। কিস্তু স্থানটির পরিচয় আগের মতোই আছে।
৩২ বছর ধরে টিএসসিতে চা বিক্রি করছেন স্বপন মামা। স্বপনের পাশেই আজাদ, মধু, রুবেলসহ বেশ কয়েকটি চায়ের দোকান আছে। এগুলোতে দুধ-চা ও মসলা মিশ্রিত রং-চা পাওয়া যায়। পলাশীর মোড়ে কয়েকটি চায়ের টং দোকান দেখা যায়। হরেক স্বাদের চায়ের জন্য বিখ্যাত এই দোকানগুলোতে রীতিমতো লাইন দিয়ে চা পেতে হয়। দাম শুরু ছয় টাকা থেকে।
গুলশানের নাসিরের চায়ের দোকানের খ্যাতি আছে এর আশপাশের অঞ্চলেও। পাতিল ভর্তি চা নিয়ে সকাল আটটা থেকে ‘চা-যাত্রা’ শুরু করেন দোকানি। ভোরে এসেই তিনি সব উপাদানযোগে আগে থেকেই বানিয়ে পাতিল ভর্তি করে চুলার ওপর রাখেন। আর খদ্দের এলেই তাদের হাতে তুলে দেন গরম চায়ের কাপ।
খিলগাঁওয়ের বাগিচা মসজিদের পাশে কাজীর চায়ের দোকানের সুখ্যাতি আছে এলাকাজুড়ে। শীত এলেই এই দোকানে ‘জলপাই রং চা’ বিক্রি শুরু করে। টক মিষ্টির মিশেলে রোমাঞ্চকর অনুভূতি আসে এটি পান করলে। তবে এর পাশাপাশি কাজীর পুদিনা, লেবুর চা-ও অসাধারণ।
মিরপুর ৬-এ অবস্থিত সেলিম চায়ের দোকান বেশ পুরোনো এবং ঐতিহ্যবাহী। দোকানে দেখা যাবে লম্বা লিস্ট সাঁটানো। এই দোকানের মালাই ও রং-চা বেশ ভালো হয়।
পান্থপথের ‘হান্নানের চা দোকান’ বিখ্যাত।
ধানমন্ডি রবীন্দ্রসরোবরের সামনে ডায়নামিকের চা খুব প্রসিদ্ধ। সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চায়ের আসর জমজমাট। এ ছাড়া দৃক গ্যালারির সামনে দুটি চায়ের দোকান আছে। তাদের লেবু চায়ের খ্যাতি আছে। ইউল্যাব ইউনিভার্সিটির সামনের দোকানেরও আছে সুখ্যাতি।
কারওয়ান বাজার একুশে টিভির পেছনের গলির পুরোটাই বিখ্যাত চায়ের জন্য। এ ছাড়া এফডিসির ভাঙা গেটের সামনে মোশাররফের দোকানের চায়ের নাম এলাকার মানুষের মুখে ছড়িয়ে আছে। সাতরাস্তার র্যাংগসের গলিতে দক্ষিণবঙ্গ নামে জালালের চায়ের জন্য বিখ্যাত। এখানকার বিশেষত্ব ‘র’ চা। পুদিনাপাতা, আদা, দারুচিনিসহ আরও উপকরণ দিয়ে বানানো সেগুলো।
উত্তরা বিইউএসটির সামনে এনামের দোকান। উত্তরা রাজলক্ষ্মীর পেছনের দোকানগুলো চাপ্রেমীরা বেশ পছন্দ করেন। কীভাবে চায়ের দোকানগুলো বিখ্যাত হয়ে ওঠে? তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রথমত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তির নিয়মিত আগমনে স্থানটি বিশেষ পরিচিতি অর্জন করে।
দ্বিতীয়ত আড্ডার একটি সাধারণ স্থান হিসেবে কিছুদিন ব্যবহৃত হলে দোকানটি সবার চেনা হয়ে ওঠে। তখন তা কারও ঠিকানা বের করার উপায় হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। এভাবে চা-দোকানটির পরিচিতি আরও বেড়ে যায়।
তৃতীয়ত চায়ের বিশেষত্ব। তবে অনেক ক্ষেত্রে দোকানির আন্তরিক আচরণ খ্যাতির কারণ হয়ে ওঠে।
সিফাত বিনতে ওয়াহিদ
ছবি: সংগ্রহ