skip to Main Content

ফিচার I টি গাউন

র‌্যাপার আর বল ড্রেসের সংকর এই পোশাকের চল শুরু হয়েছিল বৈকালিক চায়ের আসরে উপস্থিতির প্রয়োজনেই। উনিশ শতকের মধ্যভাগে। আজ তা প্রায় অপসৃত। জানিয়েছেন ফাহমিদা শিকদার

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত দৃষ্টিনন্দন ও আরামদায়ক পোশাক হিসেবে জনপ্রিয় ছিল টি গাউন (ফ্রেঞ্চ: রোব দে শম্ব্রে)। এটি ছিল ইংলিশ এবং ফ্রেঞ্চ আপার ক্লাস সোসাইটির ফ্যাশনের একটা বড় সংযোজন। টি গাউন পরা যেত কোরসেট বা কোনো মেইডের সাহায্য ছাড়াই। তাই এই ড্রেসের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বিলুপ্তি ঘটে কোরসেটের। ফ্যাশনে টি গাউন কিন্তু হুট করে আসেনি। এর পেছনে রয়েছে ছোট্ট ইতিহাস।
রানি ভিক্টোরিয়ার আজীবনের বন্ধু ছিলেন সপ্তম ডাচেস অব বেডফোর্ড আনা মারিয়া রাসেল। ১৮৪০ সালের মাঝামাঝি, তিনি ঘুরতে গেলেন লেস্টারশায়ারের পঞ্চম ডিউক অব রাটল্যান্ডের বিভা ক্যাসেলে। দুটো মিলের ব্যবস্থা ছিল সেখানে। ব্রেক ফাস্ট ও ডিনার। এর মাঝে খুব অল্প খাবার দিয়ে লাঞ্চ করা হতো। ডিনার সার্ভ করা হতো রাত আটটারও অনেক পরে। এই অবস্থায় কোনো রিফ্রেশমেন্ট ছাড়া বিকেলে সবাই ক্ষুধার্ত হয়ে যেত। বিভা ক্যাসেলে থাকাকালীন এর সমাধান হিসেবে আনা মারিয়া উদ্ভাবন করলেন ‘আফটারনুন টি’। তিনি দেখলেন, বিকেলে, দার্জিলিং চায়ের সঙ্গে কেক বা স্যান্ডউইচ একটা পারফেক্ট ব্যালান্সড লাইট মিল। এতে ক্ষুধা মেটে আবার পেট ভরে এমন ভারীও হয় না যে ডিনারে ব্যাঘাত ঘটে। তিনি ক্যাসেলের বাটলারদের নির্দেশ দিলেন, তার ঘরে চা, স্কোন (লাইট সুইটেনড ইংলিশ কেক), জ্যাম এনে দিতে। বৈকালিক এই খাবারে তিনি অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। ডাচেস একপর্যায়ে তার সঙ্গে যোগ দিতে বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করেন। এভাবে আস্তে আস্তে চায়ের জন্য এই অবকাশ একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হলো। ব্রিটিশরা প্রতিটা উপলক্ষকে সব সময় গুরুত্বের সঙ্গে নিত। ছোট বড় সব অনুষ্ঠানে ভালো জামাকাপড় পরে সেজেগুজে যাওয়া ছিল তাদের রীতি। সাধারণত বড় ফরমাল আয়োজনে তারা ভারী বল ড্রেস (উইথ কোরসেট) পরত। আর তাদের ঘরের পোশাক ছিল র‌্যাপার। এটি ছিল অনেকটা রোবের মতো, যা মিনিমাল আন্ডারগার্মেন্টসের ওপর পরা হতো। সবাই যখন আফটারনুন টি পার্টিতে যাওয়া শুরু করল, তখন তাদের মাথায় একটাই চিন্তা এলো— সেখানে কী পরা উচিত। বল গাউন এমন হালকা ঘরোয়া আয়োজনের জন্য বাড়তি হয়ে যায়। আবার র‌্যাপার পরে ঘরের বাইরে বেরোনোর কথা চিন্তাও করা যাবে না। তাই তখন তারা এমন কোনো পোশাক বানানোর কথা ভাবল, যা বল ড্রেসের মতো বেশি ফরমাল এবং ভারী নয় আবার র‌্যাপারের মতো অত ইনফরমালও নয়। এভাবেই টি গাউনের উদ্ভব হলো। র‌্যাপার এবং বল ড্রেসের হাইব্রিড।
টি গাউনে প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল প্রিন্সেস কাট বা এম্পায়ার ওয়েস্টলাইন। এই বিশেষ দুটি কাটের জন্য কোমরের দিকটা সরু এবং ফিট দেখাত। তাই কোরসেট পরার কোনো প্রয়োজন হতো না। টি গাউনে বিভিন্ন রকমের হাতা দেখা যেত। বেশির ভাগই ছিল ঢোলা, লম্বা এবং সুন্দর লেস কাফ সংবলিত। অনেকটা এখনের পাফড এবং রাফল স্লিভের মতো। বেশি গর্জাস। এতে আরও দেখা যেত ফ্লোরাল বা ন্যাচারাল মোটিফের ব্যবহার। টি গাউন বানাতে ব্যবহার করা হতো হাই কোয়ালিটির ফ্যাব্রিক। যেমন সিল্ক, ভেলভেট। প্রথম দিকের টি গাউনে এশিয়ান বিশেষ করে চীনা, জাপানিজ এবং ইন্ডিয়ান প্রভাব ছিল অনেক বেশি।
প্রথম প্রথম কেবল টি-পার্টিগুলোতেই এ পোশাক পরা হতো। এরপর ধীরে ধীরে যেসব ডিনার পার্টিতে কেবল পরিবারের সদস্য এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব উপস্থিত থাকত, সেখানে টি গাউন পরা শুরু হলো। এর বাইরে অন্য কারও সামনে কেউ এটি পরে যেত না। এই সম্পর্কে ভালো জানা যায় ১৯২২ সালে এমিলি পোস্টে ‘এটিকেট ইন সোসাইটি, ইন বিজনেস, ইন পলিটিকস অ্যান্ড অ্যাট হোম’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে। তাতে বলা হয়, ‘টি গাউন যে র‌্যাপার এবং বল ড্রেসের সংকর, তা সবারই জানা। চমৎকার ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি এই পোশাকে সব সময়ই একটি ট্রেইন (পেছনের লম্বা অংশ) এবং সাধারণত লম্বা সাবলীল স্লিভ থাকে, যা এর সঙ্গে খুব সুন্দর মানিয়ে যায়। আর টি টেবিলে বসার চেয়ে পরিবারের সঙ্গে ডিনারেই বরং এর ব্যবহার বেশি। যাহোক, নিজের বাসায় চা খেতে বসার জন্য এই পোশাক পরলে, ডিনার খাওয়া পর্যন্ত এটি পরেই থাকা যেত। তা না হলে একজন নারী লাঞ্চনে পরার পোশাক পরেই চা খেতে বসেন, আর ডিনারের আগে পোশাক পাল্টান। নিজের পরিবার বা খুব কাছের বন্ধুর বাসায় না হলে টি গাউন পরে কেউ খেতে যান না। এদের বাইরে অন্য কোনো অতিথি এলে যিনি টি গাউন পরে থাকেন, সেই অতিথির বাসায় যেতে তিনি ডিনার ড্রেস পরে যান।’
আরামদায়ক ও স্বাস্থ্যসম্মত পোশাক হিসেবে এর বেশ নামডাক শোনা যেত। এ প্রসঙ্গে ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও টি গাউনের গুরুত্বের বিষয়টি উঠে আসে। সেখানে বলা হয়, ‘কোরসেটের হাত থেকে নারীদের মুক্তি দিয়েছে টি গাউন, তাই স্বাস্থ্যসম্মত পোশাক হিসেবে এর ভূমিকা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিছু নারী টি গাউনের নিচেও কোরসেট পরে থাকেন বলে শোনা যায়, তবে তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম। এই ফ্যাশন যারা অনুসরণ করে যাচ্ছেন, তাদের জন্য অন্তত আশা করাই যায়, এই পোশাক পরার প্রবণতা সাময়িক ঝোঁকের বিষয় না-ও হতে পারে।’
ভিক্টোরিয়ান সময়ের টি গাউন ঘরের ভেতর সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সপ্তম এডওয়ার্ডের শাসনকালে এ ধারার পরিবর্তন দেখা যেতে থাকে। সে সময়ে দেখা যায়, গৎবাঁধা ঘরোয়া টি-টাইম বদলের পথ ধরেছে। তখন নারীরা শুধু ঘরের লেডিস চেম্বারেই নয়, এর বাইরে, পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানেও টি গাউন পরেছেন। পরিবর্তন এসেছিল এর গঠনেও। সকালের দিকে হাইনেক লাইনের আর রাতে তুলনামূলক বেশি খোলা গলার টি গাউন পরা হতো।
১৯২০ সালের মধ্যেই টি গাউন তরুণীদের প্রিয় পোশাকের জায়গাটি দখল করে নেয়। এই সময়কার গরমে পরার বেশির ভাগ টি গাউনে সাদা আইলেট, এমব্রয়ডারি বা লেইস ইনসেট শিয়ার ছিল; আর শীতে পরা হতো গাঢ় রঙের একটু ভারী কাপড়ের গাউন। বিশের দশক ছাড়িয়ে ত্রিশের দশকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত টি গাউনের জনপ্রিয়তা অটুট ছিল।
মডেল: মারিয়াম
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: তানভীর খান
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: তুতলি রহমান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top