ছুটিরঘণ্টা I সোনালি দ্বীপের ঐশ্বর্যে
নীল নদ সন্নিহিত ভূখন্ডের আসল সৌন্দর্য নুবিয়ান নৃগোষ্ঠীর জীবনধারায় নিহিত। তাদের আতিথ্য মনোমুগ্ধকর। সেখানকার প্রকৃতির মতোই
নদের ওপারের যাত্রীদের সবাই নুবিয়ান। মিসরে আমার অনেকগুলো অভিজ্ঞতার মধ্যে একটি হলো, এখানে প্রতি পাঁচজন মেয়ের মধ্যে তিনজনের নাম ফাতিমা। এ কদিনে এখানকার লেকজন আমাকে মিসরীয় বলে ভাবতে শুরু করেছে। পথে বের হলে আরবি ভাষায় কথা বলাও শুরু করে দেয়।
নীলের জলে ভেসে থাকলে আমি আর এ জগতে থাকি না। দুলতে দুলতে হারিয়ে যাই ক্লিওপেট্রার আমলে। যেখানে নীল পদ্মের ভারে টলমল করত রাজসিংহাসন। আর সেই নীল পদ্মের কদর ছিল শুধুই নীল নদের কারণে। রানি নেফারতিতিও কত কান্ড ঘটিয়েছিলেন শুধু আশপাশে নীল কমলের শোভা বজায় রাখার জন্য। আর এই মরূদ্যানে জল আনবে যে, সে তো স্বয়ং নীল নদ। সকল রানির মান ভাঙাতে নিজ বুকে ফুটিয়েছে নীল কমল আর এখন আকাশ ফুটে আছে তার বুকে।
সারা দিন নীলের হৃদয়ে ভেসে বেড়ানোর ফন্দি আঁটছিলাম, আশরাফ মাঝির সঙ্গে কথা হলো। কাল আমায় ছেড়ে আসবে নীলের তীরে।
আপাতত রাস্তার উল্টো পাশে নুবিয়ান মিউজিয়াম ঘুরে দেখি।
জাদুঘরটি যেমন বিশাল, তেমনি বিভিন্ন সেকশনে রয়েছে বিস্ময়কর জিনিসপত্র। এমনিতেই মিসর দেশটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় বিস্ময়। তার ওপর এ দেশের প্রাচীন নৃগোষ্ঠীর নিদর্শন পাওয়ায় মাত্রাটা আরও বেড়ে গেছে। নুবিয়ান জাতির ইতিহাস মিসরের ইতিহাসসম প্রাচীন ও আভিজাত্যপূর্ণ। একসময় এই জাতি মিসর শাসন করেছে। ধীরে ধীরে তাদের সংখ্যা কমতে থাকে। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ায় খুব সামান্যই টিকে আছে এখানে। এদের নিজস্ব শিল্পকলা আছে, আছে স্বতন্ত্র হস্তশিল্প।
সতেরোটি সেকশন তিনতলাজুড়ে রয়েছে এই জাদুঘর। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে কুশ, খ্রিস্টান, মুসলিম—এসব রাজত্বকালের প্রায় পাঁচ হাজার নিদর্শন থরে থরে সাজানো। আছে সে সময়কার নুবিয়ানদের পোশাক, গয়না, তৈজসপত্র, শিলালিপি, কাগজের দলিলপত্রসহ আরও কত কী!
এসবের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেগেছে সতেরো হাজার বছর পুরোনো নুবিয়ান দেহের কঙ্কাল। আর পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো সূর্যঘড়ি, যার বয়স তেরো হাজার বছর।
মিসরের যেকোনো জাদুঘরে মমি থাকবেই। নুবিয়ান মিউজিয়ামও রেখেছে টলেমির সময়ের নুবিয়ান ধর্মযাজক ও তার স্ত্রীর মমি।
নিচতলার আরেক পাশে রাখা আছে মিসরের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজা রামসেস-২ (খ্রিস্টপূর্ব ১২৭৯-১২১৩)-এর মূর্তি।
আরেক পাশে নুবিয়ান জীবনযাত্রার খুঁটিনাটি মূর্তি আকারে সাজিয়ে রাখা আছে। কোথাও রাবাবা, রিক বাজিয়ে পুরুষ গাইছে আর মেয়েরা নাচছে, কোথাওবা পাঠশালায় ওস্তাদজির কাছে একদল ছাত্র তালিম নিচ্ছে।
জাদুঘর দেখা শেষ হলে এখানকার বাজারে গেলাম। অবশ্য আসওয়ান শহরে নুবিয়ান কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, সবাই মিসরীয়। বাজারটি বেশ খোলামেলা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মিসরের জনসাধারণ মাছ মাংস তেমন খায় না। ডাল, সবজি ইত্যাদি খায় রুটির সঙ্গে। তাই বাজারে সবজি, ফল, মসলার দোকান চোখে পড়ল।
সন্ধ্যার পর নীল নদের তীর হয়ে ওঠে আরও মোহনীয়। আমি দূরে বসে দেখছি এলিফেন্টিন আইল্যান্ড। নীল নদ, সোনালি মরুর বালিয়াড়ি আর আনচান করা মন মিলেমিশে একাকার, ছন্দলোকের গালিচায় বসে নীলে পা ডুবিয়ে এ যেন এক অজানা গন্তব্য সহজেই খুঁজে পাওয়া। এসবের মধ্যে যোগ হয় নুবিয়ান পথচারী আর মাঝিদের সঙ্গে আলাপ। ঘরে ফিরে প্রথমেই ফাতিমার কাছ থেকে নুবিয়ান রান্না ঝটপট শিখে ফেললাম। নৈশভোজের পর সবাই মিলে নীলের তীরে বসলাম। গত রাতের অসমাপ্ত আড্ডা নতুন করে জমে উঠল। সামনের মাসে সুমাইয়ার বিয়ে। আমি এখন এদের পরিবারের অলিখিত সদস্য, আমি না এলে নাকি আনন্দ সব মাটি হবে। কী অদ্ভুত মায়া এদের মনে!
অল্প সময়ে নীলের জলে ভেসে বেড়ানোর দিন ফুরিয়ে এল। আশরাফ আমাকে নিতে বিশাল সাদা পালতোলা নৌকা নিয়ে ঘাটে হাজির। আজকে সারা দিন জলে ভেসে থাকার জন্য বেরিয়ে পড়লাম।
মাঝি বুঝেছে, আমি এ দেশে একা এসেছি, তাই একাই নদের শোভা দেখতে চলেছি। আশরাফ নিজেও নুবিয়ান, পৈতৃক ব্যবসা নাও বাওয়া। শিক্ষিত ছেলে। ওর চুলের স্টাইল দেখে আমি নাম দিয়েছি বব মার্লে। নৌকায় বসতেই হাতে ধরিয়ে দিল এদেশীয় চা, আমার খুব পছন্দ, আলাদা এক স্বাদ আর সুবাস। মিসরীয় আরবি গান গেয়ে চলছে মাঝি। কোনো একটা অদ্ভুত কারণে মিসরীয় সংগীত আমার অসাধারণ লাগে। হয়তোবা মিসরের আপামর জনসাধারণ সঠিক কথাই বলে যে আমি মিসরীয়, তবে ছোটবেলায় হারিয়ে গিয়েছিলাম, এখন আবার দেশের টানে ফিরে এসেছি।
আশপাশে অনেক সারি বাঁধ নৌকা, সাদা পাল, সাদা নাও, সাদা ছাউনি, মাঝিদেরও সাদা গালিবায়া পোশাক। নীলের বুকে এক একটা রাজহাঁস পাখা মেলে প্লেনের মতো উড়তে চাচ্ছে।
ইঞ্জিন নৌকা খানিকক্ষণ চালিয়ে মাঝি মাঝ নদে ভেসে রইল। দেখা মিলল অপর পারের টেম্পল অব নুমের অবশিষ্ট ভগ্নাংশের। প্রায় চার হাজার বছরের পুরোনো মন্দিরের কয়েকটা স্তম্ভ ছাড়া আর কিছুই নেই এখন। ইতিহাসবিদেরা বলেন, সামনের প্রাঙ্গণে রাজা আমেনটোপ (২)-এর দরবার হল ছিল। তখন এ দ্বীপের নাম ছিল আবু, মানে হাতি পরে নামকরণ হয় এলিফেন্টিন। দ্বীপটি হাতির দাঁতের আকারের, তাই এই নামকরণ।
নাও ঘুরে আরেক পাশে যেতেই পাশের বালিয়াড়ির পাহাড়ের ওপর চোখে পড়ল আগা খান (৩)-এর সমাধিসৌধ, স্যান্ডস্টোনে নির্মিত, এক স্তর নিচে তার বাড়ি। আগা খান ছিলেন ভারতীয় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। তিনি ভারতবর্ষে জনসেবামূলক বিভিন্ন কাজ করে গেছেন।
খানিকক্ষণ পর নদের আরেক পারে নুবিয়ান জীবনযাপন দেখতে গেলাম। দূর থেকে ভীষণ রঙিন সব বাড়িঘর মনে হচ্ছিল, একটা রঙের দেশ। একেক বাড়ি একেকটা জ্বলজ্বলে রঙের খনি, গায়ে আঁকা কত না ছবি!
তীরে নেমে আমি দিশেহারা। সব বাড়িতে ঢুকতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু তারা কী ভাববে এই ভেবে আর যাওয়া হলো না!
মাঝি হাসতে হাসতে বলে, ‘প্রাচীনকাল থেকে নুবিয়ানরা মাটির ঘরের দেয়ালে রং করে, ছবি এঁকে আসছে। এটা নুবিয়ানদের ঐতিহ্য।’ আর এখানে কারও ঘরে ঢুকে আতিথ্য গ্রহণ করলে এরা খুশিই হবে। একেকটা ঘরের বৈঠকখানায় যেমন ছবির মতো আঁকা, তেমনি বাইরেও বিভিন্ন রঙের কারুকাজ। কোনো কোনো বাড়ির বৈঠকখানার মেঝেতে মরুভূমির মতো বালি বিছানো। দাওয়ায় বসে নুবিয়ান নারীরা কালো পোশাকে একমনে কুরুশ-কাঁটায় নকশা তুলে টেবিল ম্যাট বা ওয়াল ম্যাট বানাচ্ছেন। কেউ কেউ হোগলা পাতার মতো একধরনের পাতা দিয়ে ছোট ছোট রঙিন ঝুড়ি তৈরি করছেন। সব জায়গায় রঙের খেলা। চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
প্রায় সব বাড়িতেই অতিথির থাকার ব্যবস্থা আছে। কারও বাড়িতে আছে রেস্তোরাঁ। খাদ্যসামগ্রীতে সাজানো।
আরেকটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম, সবার বাড়িতে আছে মাঝারি আকারের কুয়া। তাতে কুমির পালে এরা। কুয়ার মুখ শক্ত ইস্পাতের জাল দিয়ে আটকানো। উঁকি দিয়ে দেখি, নিচে বিশালাকৃতির কুমির লেজ নাড়াচ্ছে। আমার এত উচ্ছলতা দেখে ঘরের মানুষজন হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে।
এই লোকালয়ের পাশে নুবিয়ান বাজার। সেখানকার দোকানে সাজানো হরেক রকমের রঙিন মসলা, চা। কোথাও বা কুরুশ-কাঁটায় নকশা করা টুপি, ওয়াল হ্যাংগিং, হাতে আঁকা রঙিন মাটির পাত্র, আরও আছে বিভিন্ন রঙের নুবিয়ানদের মুখোশ। দোকানিরা সবাই পুরুষ।
এদিকে একদল বাচ্চা ঘাট থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ছে নীলের জলে। আমার এক অদ্ভুত সাধ জাগল মনে। মাঝিকে বললাম, ‘নৌকা নদের একদম মাঝখানে নিয়ে গিয়ে তুমি আমাকে একা ছেড়ে চলে যাও। নৌকা সামলানোর কায়দাকানুন শিখিয়ে দিয়ো, তাতেই চলবে।’ আশরাফ ধমকের সুরে বলল, ‘তোমার মাথা পুরোই খারাপ। এত বড় নৌকা তুমি কিছুতেই সামলাতে পারবে না।’
নৌকা নদের বুকে ভেসে চলছে। তীরের সোনালি বালিতে সোনালি উট রঙিন ঝালর পরে উদাস বসে আছে। আমি সেদিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তাহলে ছোট নৌকাটা দাও, কিছুক্ষণ ভেসে বেড়াই।’
মাঝি আমাকে ভাসিয়ে দিল ছোট নৌকায়। তরী ডুববে না; কারণ, এটা আমি বাইতে জানি। আর যার কাছাকাছি আছি, সে তো আমার একান্ত আপন নীল। নীল নদে এ সময় সাধারণত কোনো নৌকার আনাগোনা থাকে না। শুধু আমি আর নীল।
চারদিকে গভীর নীল জল, আরেক পাশে সোনালি মরুভূমি। দ্বীপের কিছু কিছু জায়গায় সবুজ গাছের সারি। আগলে রেখেছে সোনালি তট।
নীলের স্বচ্ছ জলে উঁকি দিলে নিজের ছায়া ভেদ করে আরও গভীরে পৌঁছানো যায়।
ফাতিমা জাহান
ছবি: লেখক