ফিচার I হার্ডিঞ্জ ব্রিজ
তখনকার পূর্ব বাংলায় কর্মমুখরতার স্পন্দন ধারণ করেছিল এই ব্রিজ। পদ্মার দুই তীরের সংযোগ তৈরির এই ধাতব স্থাপনা আজও অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে অবদান রেখে চলেছে। লিখেছেন কনক বিশ্বাস
—কত বড় পুল, পুরোটাই নোয়া [লোহা] দিয়া বানাইছে। কত টেকার নোয়া নাগছে?
—তা কমপক্ষে পাঁচ শ টেকার নাগছেই!
কুষ্টিয়া-পাবনার সংযোগ স্থাপনকারী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নিয়ে স্থানীয়দের কাছে এমন কৌতুক বেশ প্রচলিত। এসব রসিকতা এবং স্মৃতি নিয়ে এই ধাতব সেতু এক শ বছর পার করেছে ছয় বছর আগে।
সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যের নিদর্শন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। ব্রিটিশ স্থাপত্যশিল্পের অনন্যতার উজ্জ্বল সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজও। কেবল তা-ই নয়, তখন এই সেতু নির্মাণকে কেন্দ্র করে যোগাযোগব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনমানের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে পাকশীসহ আশপাশের বিস্তৃত অঞ্চলে।
দুই
১৯১০ সালে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নির্মাণকাজ শুরু হয়। যদিও প্রস্তাব করা হয়েছিল ১৮৮৯-তে। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কলকাতার সঙ্গে আসাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা ও উত্তরবঙ্গের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপনের প্রয়োজনে ব্রিজটি নির্মাণ করে। দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ইংরেজ প্রকৌশলী রবার্ট উইলিয়াম গেইলসকে। ব্রিজ নির্মাণের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে সরকার স্যার উপাধিতে ভূষিত করে। নকশা প্রণয়ন করেন বিখ্যাত আরেক স্থপতি আলেকজান্ডার মেয়াডোস রেন্ডেল। আর ব্রিটিশ কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ব্রেথওয়েট অ্যান্ড ক্লার্কের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয় এই ধাতব সেতু।
১৯০৯ সালে সার্ভে শুরু করলে রবার্ট গেইলস বুঝতে পারেন, উত্তাল পদ্মায় ব্রিজ নির্মাণ বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। তাই প্রথমে নদী রক্ষা বাঁধ তৈরি করেন। দুই বছর ধরে এ কাজই করেন তিনি। এ ক্ষেত্রে গেইলস অসাধারণ এক পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। বড় বড় পাথর আর মাটি একসঙ্গে মিশিয়ে নদীর দুই পাড়ে ফেলেন। প্রায় পনেরো কিলোমিটার এভাবে বাঁধ দেন তিনি। ধারণা করা হয়, নদী রক্ষায় যে পাথর ব্যবহৃত হয়েছে, তা দিয়ে কয়েকটি ব্রিজ নির্মাণ করা যেত। রবার্ট গেইলসের এই পদ্ধতি খুব কাজে লেগেছিল। শত বছর পেরিয়েও সেই বাঁধ সম্পূর্ণ অক্ষত, প্রায় কোনো একটি পাথরও খসে পড়েনি। ১৯১২ সালে শুরু হয় ব্রিজ নির্মাণের মূল কাজ। শেষ হয় ১৯১৫ সালে। কথিত আছে, এতে ব্রিটিশরা তৎকালীন সর্বোচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহার করেছিল। ব্যয় হয়েছিল তখনকার হিসাবে ৩ কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার ১৬৪ ভারতীয় রুপি।
প্রায় ২৪ হাজার ৪০০ শ্রমিক হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণে কাজ করে, এদের অধিকাংশই ছিল বাঙালি। সে সময় ইংরেজ নাগরিকদের জন্য পাকশীতে গড়ে তোলা হয়েছিল বাংলো ও কটেজ। স্যার রবার্ট উইলিয়াম গেইলসের বাড়িটি ছিল বেশ বড়। বলা হয়ে থাকে, ব্রিজ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের এই বাংলো থেকে তিনি দূরবীন দিয়ে নির্মাণকাজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতেন।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এককভাবে বাংলাদেশের বৃহত্তম ইস্পাত নির্মিত ডাবল গেজ রেলওয়ে সেতু। পাশাপাশি রয়েছে পথচারীদের ওয়াকওয়ে। সেতুটির দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৭৯৮ দশমিক ৩২ মিটার বা ১ দশমিক ৮ কিলোমিটার। মোট ১৫টি গার্ডার বা স্প্যান রয়েছে, প্রতিটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১২০ মিটার। ১৯১৫ সালের ৪ মার্চ ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড ব্যারন এটি উদ্বোধন করেন। তার নামানুসারে ব্রিজটির নামকরণ হয়। যদিও সে বছরের ১ জানুয়ারি প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে ঈশ্বরদী থেকে সেতুর ওপর দিয়ে খুলনা অভিমুখে ট্রেন যাত্রা করেছিল।
এ সময় পাকশী এবং আশপাশের অঞ্চলে ছোটখাটো অনেক কলকারখানা, দোকানপাট ও বাজার গড়ে উঠেছিল। জনজীবনেও প্রভাব পড়েছিল ব্রিটিশ আধিপত্যের। স্থানীয়দের জীবনমানে এসেছিল পরিবর্তন।
তিন
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এ দেশের মুক্তিসংগ্রামেরও উজ্জ্বল এক ইতিহাস। পাকিস্তানি বাহিনীর ট্যাংক, যুদ্ধ সরঞ্জাম ও সৈন্য পারাপারে ব্যবহৃত হতো এই ধাতব সেতু। সে জন্য ১৪ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর যুদ্ধবিমান এর ওপর বোমা ফেলে। এতে ১২ নম্বর স্প্যানটি ভেঙে পানিতে পড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৯ ও ১৫ নম্বর স্প্যান।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার [পাবনা এফ এফ] কাজী সদরুল হক এবং অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘১৪ ডিসেম্বর ঈশ্বরদীজুড়ে ১০টি অপারেশন ক্যাম্প তখনো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল। এরই মধ্যে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালাতে শুরু করে পাকিস্তানি সেনারা। তারা ওই দিন পালিয়ে পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ হয়ে ঈশ্বরদীর দিকে আসছিল। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলা করার জন্য চরসাহাপুরে প্রকৌশলী আবদুল গফুরের বাড়ির সামনের রাস্তায় অবস্থান নেন।…দলে দলে পাকিস্তানি হানাদাররা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পার হতে লাগল। ব্রিজে তারা ডিনামাইট [চার্জ] লাগিয়ে বিদ্যুৎ সংযোজন করে রেখেছিল। কারণ, অবস্থা বেগতিক দেখলে ব্রিজটি উড়িয়ে দেওয়া হবে। তারা বেশ ক্ষুধার্ত ছিল বলে মনে হয়েছিল।…এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে পাকিস্তানি সেনারা কর্ণপাত না করে গুলি ছুড়তে থাকে।…তখন বেলা বারোটার দিকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর বিমান আকাশে মহড়া দিচ্ছিল। প্রথমে পরপর তিনটি এবং কিছুক্ষণ পর আরেকটি বিমান থেকে বোমা বিস্ফোরণের প্রচন্ড শব্দ পাওয়া যায়। শব্দে মাটি কেঁপে ওঠে। চরের ধুলা ও ধোঁয়া এলাকায় ছড়িয়ে যায়। পরে আমরা গিয়ে দেখি, ব্রিজের ১২ নম্বর স্প্যানের পশ্চিম ভাগের অংশ পানির নিচে পড়ে আছে।’
মুক্তিযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকারের সহায়তায় ব্রিজটি মেরামত করা হয়। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর পুনরায় ট্রেন চলা শুরু করে। শতবর্ষ পার হয়ে গেলেও ব্রিজটির ওপর গতিসীমা ৫০ কিমি নির্ধারণ করা আছে। নিক্ষিপ্ত একটি অবিস্ফোরিত বোমা পরে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় চরের বালুতে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। তারই একটি অংশ এখনো মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে রেখে দেওয়া হয়েছে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপকের কার্যালয়ের সামনে। নতুন প্রজন্মের অনেকেই বোমার খোলসটি দেখতে আসে।
পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশীতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের অবস্থান। এই এলাকার রেলস্টেশনের দক্ষিণে পদ্মা নদীর ওপর লালরঙা ধাতব সেতুটি দাঁড়িয়ে আছে। এর অপর প্রান্তে রয়েছে কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলা। নদী তখন ছিল উত্তাল। এখন সেই যৌবন ফুরিয়ে গেছে। খরস্রোতা পদ্মা এখন কূলকূল রব তুলে বয়ে চলেছে। কিন্তু তার ওপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ যেন অনন্ত যৌবনের জয়গান গেয়ে যাচ্ছে।
প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এখানে আসে, দূরদূরান্ত থেকে। ফলে এই অঞ্চলজুড়ে গড়ে উঠেছে স্থায়ী-অস্থায়ী নানা ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। হোটেল, রেস্তোরাঁ, চায়ের দোকান, কফি শপ তো আছেই। এ ছাড়া দুপুরের পরপরই ঝালমুড়ি, ফুসকা, আইসক্রিম, কোমল পানীয়, বাদাম, ছোলা-বুট, টক-ঝাল-মিষ্টি, চানাচুর, এমনকি বিভিন্ন খেলনাসামগ্রীর পসরা নিয়ে বসে ভাসমান বিক্রেতারা। শীত মৌসুমে পাওয়া যায় ঈশ্বরদীর বিখ্যাত লিচু। তা ছাড়া পিঠার দোকান তো থাকেই। পদ্মায় দলে দলে ভ্রমণার্থী নিয়ে ভেসে বেড়ায় অনেক নৌকা। আসে পিকনিকের দল। উৎসব বা ছুটির দিনে এই এলাকায় যেন মানুষের মেলা বসে।
উপমহাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উল্লেখযোগ্য স্মারক এই লাল ধাতব সেতু। নির্মাণের পর থেকেই বিপুল মানুষের কৌতূহলের শেষ ছিল না। প্রমত্তা পদ্মার বুক চিরে নৌকা নিয়ে দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসত এটি দেখতে। মানুষের সেই কৌতূহল আজও ফুরায়নি।
ছবি: ইন্টারনেট