ফিচার I দেবীর পাঁচালি
আরাধ্য প্রতিমার বন্দনায় যুগ যুগ ধরে গীত হয়েছে ছন্দোবদ্ধ কিছু রচনা। পুরাণ আর লোকশ্রুতির প্রেরণায়। মন্ডপে সাংগীতিক আবহ সৃষ্টি করে
দেব-দেবীকে তুষ্ট করার জন্য তাদের গুণকীর্তন করে বিভিন্ন আখ্যান বা সংগীত পরিবেশনের চল অনেক আগে থেকেই। এগুলো পাঁচালি নামে পরিচিত। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এর মাধ্যমে দেবতার কাছে রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি, ব্যবসায় বা কর্মক্ষেত্রে উন্নতি, অশুভ শক্তির প্রভাব থেকে রক্ষা, যেকোনো বিপদ থেকে উদ্ধার, সন্তানদের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সাফল্য কামনা, সংসারের মঙ্গল প্রার্থনা, বসতভিটায় প্রাচুর্য ইত্যাদি আবেদন জানায়। বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় এটিকে লোকগীতির একটি ধারা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পাঁচালি শব্দের উদ্ভব পঞ্চাল বা পঞ্চালিকা থেকে। এই আঙ্গিকে গান, বাজনা, ছড়াকাটা, গানের লড়াই ও নাচ—এই পঞ্চাঙ্গের সমাবেশ ঘটে বলে কেউ কেউ একে পাঁচালি বলে। আগে থেকেই কাহিনিমূলক সংগীতের সঙ্গে পুতুলনাচের প্রচলন ছিল। পরে উনিশ শতকের প্রথম দিকে বা তারও আগে মূল গায়েন নিজে পায়ে নূপুর বেঁধে, হাতে চামর ও মন্দিরা নিয়ে নৃত্য পরিবেশন করত। এই ধারাও পাঁচালি নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। মধ্যযুগে রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য, এমনকি অনেক পুঁথিও এই সুরে গাওয়া হতো। এতে পৌরাণিক, লৌকিক বা সমসাময়িক বিষয়ও যোগ হতে দেখা গেছে। একজন প্রধান গায়ক নাটকীয় ভঙ্গিতে আবৃত্তি, ছড়া ও গীতের মাধ্যমে কাহিনি বলত। ধীরে ধীরে একাধিক গায়েন যুক্ত হয়। তারা মৃদঙ্গ, ঢোল, কাঁসি ইত্যাদি লোকবাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে পাঁচালি গাইত।
আঠারো শতকের শেষ দিকে এই আঙ্গিক নতুন রূপ নেয়। এতে তখন আখ্যান, কবিগানের ছড়া কাটা, অঙ্গভঙ্গি ও অভিনয়ের চল শুরু হয়। উনিশ শতকে সংলাপ যোগ হয়, যা মূল গায়েনের দ্বারাই অভিনীত হতো। এ সময় এতে একটি সঙ চরিত্রের আগমন ঘটে। যে আবৃত্তি, নাচ, গানের মধ্য দিয়ে সমাজের অসংগতি হাস্যরসের মাধ্যমে তুলে ধরত।
জানা যায়, লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাস ছিলেন পাঁচালির প্রথম রচয়িতা। পরে প্রসিদ্ধি লাভ করেন দাশরথি রায়। তিনি প্রথম জীবনে কবিয়াল ছিলেন। কথিত আছে, একবার কবিগানের আসরে প্রতিপক্ষ রামদাস স্বর্ণকারের কাছে তিরস্কৃত হয়ে তিনি দলত্যাগ করেন। তারপরই তার পাঁচালি রচনার শুরু। ১৮৩৬ সালে দাশরথি একটি আখড়া স্থাপন করেন। প্রচলিত রীতি বাদ দিয়ে তিনি কবিগানের মতো চাপান-উতোর ভঙ্গিতে সাজান গানের এই আঙ্গিক। যোগ করেন উৎকৃষ্ট ছড়া। দাশু রায়ের পাঁচালি সারা বাংলায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। পরবর্তীকালে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি পাঁচালিতে যোগ হয় টপ্পা। ফলে তা অনেকটা আসরকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। পাঁচালি হয়ে যায় আখড়াই গানের একটি প্রকরণ। সে সময় দাশরথি এবং অন্যান্য কবির প্রচেষ্টায় যে নতুন পাঁচালি-ধারার সূচনা হয়, তা মূলত কীর্তন থেকে উদ্ভূত। তখনকার খ্যাতিমান পাঁচালিকারেরা হলেন ঠাকুরদাস দত্ত, রসিকচন্দ্র রায়, ব্রজমোহন রায়, নন্দলাল রায়, কৃষ্ণকমল গোস্বামী প্রমুখ। লক্ষ্মী, শনি, শিব, শীতলা, সত্যনারায়ণের পাঁচালি তখন খ্যাতি লাভ করে।
উনিশ শতকে পাঁচালি পরিবেশনের পর্যায়ে পৌঁছেছিল। শুরুতে ‘সাজ-বাজানো’ নামে বাদ্যযন্ত্রের লড়াই হতো। এরপর থাকত সমবেত শ্যামা সংগীত। একজন কবি সুর সহযোগে ছড়া বলে শ্রোতাদের মুগ্ধ করতেন। সে জন্য ভালো ছড়াকারকে গানও জানতে হতো। একদল শ্যামাসংগীত শেষ করার পর অন্য দল আসরে আসত। তারা সখী-সংবাদের গান গেয়ে ছড়া কাটা শুরু করত। এভাবে কবিদের ধারাবাহিক বিষয় থাকত মাথুর, মান, দান ইত্যাদি। তবে এ সবকিছু করতে হতো পাঁচালিকার একটি বিষয়ের ভেতর থেকেই। এই বাইরে যাওয়া পাঁচালির রীতিতে ছিল না।
লক্ষণীয়, এই অঞ্চলে লক্ষ্মী, শনি, শিব, শীতলা, সত্যনারায়ণের পাঁচালি বিশেষ প্রসিদ্ধি অর্জন করে। কারণ হিসেবে অনেকের মত হলো, মানুষ সব সময়ই অশুভ শক্তি, রোগশোক থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে। পৃথিবীতে যা কিছু শক্তিমান, অসীম ক্ষমতাধর, সেগুলোকেও দেবতার আসনে বসিয়ে পূজা এবং গুণকীর্তনে তুষ্ট করেছে। অন্যদিকে সবাই চেয়েছে ধনসম্পদে তাদের জীবন পূর্ণ করতে। কিন্তু বিদ্যায়-বুদ্ধিতে সমৃদ্ধ হওয়ার বাসনা খুব একটা ছিল না। ফলে সরস্বতীর পাঁচালির দেখা পাওয়া যায় না বললেই চলে। সে যা-ই হোক, এগুলো পরিবেশনের সময় ও ধরন আলাদা।
আশ্বিন মাসের শেষে পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার আরাধনা হয়। এতে সংসারের মঙ্গল কামনা ও আয়-উন্নতি বাড়ানোর কথা থাকে। এই পূজার উপযুক্ত সময় প্রদোষকাল, অর্থাৎ সূর্যাস্ত থেকে তার পরের দুই ঘণ্টা পর্যন্ত। আগের রাত্রি থেকে পরদিন প্রদোষ পর্যন্ত তিথি থাকলেও প্রদোষেই পূজা করা বিধিসম্মত। সময়ের এমন রকমফের রয়েছে। তবে লক্ষ্মীপূজায় পাঁচালি পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া কোজাগরী অসম্পূর্ণ থাকে। এতে রোগব্যাধি থেকে মুক্তি, ব্যবসায় ও কর্মক্ষেত্রে উন্নতি, স্বপ্নপূরণ, বিপদ থেকে উদ্ধার, ঋণমুক্তি, বসতভিটায় প্রাচুর্য কামনা করা হয়।
পয়ার ছন্দে রচিত লক্ষ্মীর পাঁচালি শুরুর অংশ : ‘শরৎ পূর্ণিমার নিশি নির্মল গগন,/ মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয় পবন।/ লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ণ,/ বৈকুণ্ঠধামেতে বসি করে আলাপন।’
লক্ষ্মীর পাঁচালিতে দেবীর আরাধনা, আহ্বান, বর-প্রার্থনা ইত্যাদি মন্ত্র রয়েছে। সেসব উচ্চারণ করে ঘট ও দেবীর পায়ে ফুল দিয়ে অর্চনা করার নিয়ম। হাতে ফুল নিয়ে পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র পড়ে, শাঁখ বাজিয়ে পাঁচালি আবৃত্তির মধ্য দিয়ে সংসারের আয়-উন্নতি ও মঙ্গল কামনা করা হয়।
শিবের আশীর্বাদ লাভের সবচেয়ে ভালো সময় মহাশিবরাত্রি। প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে এই উৎসব পালিত হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তবে শুধু মেয়েরাই শিবের মতো বলিষ্ঠ ও বুদ্ধিমান স্বামী পাবার উদ্দেশ্যে এই ব্রত পালন করে না, ছেলেমেয়ে-নির্বিশেষে শাক্ত বৈষ্ণব সবাই এটি করে থাকে। মহাশিবরাত্রির আগের দিন একবার হবিষ্যান্ন খেয়ে সংযত জীবনযাপন করার রীতি আছে। আর পূজার দিন রাত্রি দ্বিপ্রহরে চারটি শিবপূজা করতে হয়। পরের দিন ব্রাহ্মণভোজন। মহাশিবরাত্রিতে ব্রতকথা পাঠ আবশ্যক।
শনিদেবের পাঁচালিতেও রয়েছে দেবতাকে তুষ্ট করার নানান কৌশল। যেমন : ‘প্রণামো চরণে প্রভু দেব গজানন।/ তোমার স্মরণে হয় বিঘ্নবিনাশন ॥’
গবেষকদের মতে, পাঁচালির মধ্য দিয়ে সমকালীন সমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা বোঝা যায়। এই ব্রতকথা কালে কালে নানাভাবে রূপান্তরিত হয়। এটার পেছনে সমাজ-রাষ্ট্রের অর্থনীতির সূত্রগুলো জড়িয়ে আছে বলে তারা মনে করেন।
বিপ্লব সরকার
ইলাসট্রেশন: দিদারুল দিপু