ফিচার I আত্মা, শস্য, যৌনতা ও দেবত্ব
ফসল উৎপাদনের নিশ্চয়তা এবং বেশি ফলনের সঙ্গে যৌনতার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ বলে মনে করা হতো একসময়। কিছু দেবীর উদ্ভবের পেছনে শস্য ও যৌনতার ভূমিকা আছে বলে বিশ্বাস ছিল। যদিও এসব ধারণার আঁতুড়ঘর আদিম সমাজ। লিখেছেন শিবলী আহমেদ
আদিম মানুষ বিশ্বাস করত, এক বস্তুর আত্মা অন্য বস্তুকে প্রভাবিত করতে পারে। মানে, সবকিছুরই আত্মা রয়েছে—এই বিশ্বাস গেঁথে গিয়েছিল তাদের মনে। ফলে প্রকৃতিকে আয়ত্তে আনতে তাদেরকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল জাদুতত্ত্বের। যেটির মাধ্যমে আত্মার শক্তিকে সঞ্চালন করা যেত বলে তাদের ধারণা ছিল। সেটির চর্চা হতো দুটি পদ্ধতিতে: সামঞ্জস্য ও সংক্রমণ। যেমন কোনো শত্রুর কুশপুত্তলিকা দাহ করলে শত্রুটিও দহন জ্বালা ভোগ করবে—এমন ধারণা থেকে যেই জাদুচর্চা করা হতো, তা সামঞ্জস্যের জাদু। আবার কারও কেটে ফেলা নখ কুড়িয়ে এনে তা পোড়ালে সেই নখ যার আঙুলে ছিল, সে ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়বে—এমন বিশ্বাসের জন্য যেই জাদুর চর্চা হতো, তা ছিল সংক্রমণের জাদু। তবে জাদু যে শুধু অন্যের অনিষ্ট করার জন্য ব্যবহৃত হতো, তা নয়। প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে, ফসল ফলাতে, গর্ভবতীর সুরক্ষায় এবং গৃহপালিত পশুদের বংশবিস্তারের কামনাতেই জাদুর ব্যবহার হতো বেশি।
সর্বপ্রাণবাদ অনুসারে সবকিছুতেই আত্মা আছে। আবার জাদুতত্ত্ব মতে, এক আত্মা আরেক আত্মাকে প্রভাবিত করতে পারে। এর ফলে কৃষি আবিষ্কারের পর মানুষ নারীর যৌন উর্বরতাকে ফসলের উর্বরতার সঙ্গে যুক্ত করেছিল, কিংবা মেলাতে বাধ্য হয়েছিল। কেননা, কৃষি আবিষ্কারের আগে মানুষ ছিল শিকার-সংগ্রাহক। খাদ্য চোখের সামনেই ঘুরত। একটি প্রাণী বধ করতে পারলে কিংবা গাছ থেকে কিছু ফল পেড়ে আনলেই দিব্যি কয়েক দিনের খাবারের জোগান মিলত। কিন্তু কৃষির ফসল ছিল অদৃশ্য। বীজ বুনলেই যে শস্য ফলবে—এমন নিশ্চয়তা ছিল না। আবার চারা গজালেও তা থেকে যে ছড়ায়-ছড়ায় ফসল মিলবে, সেটাও অনিশ্চিত। এই অনিশ্চয়তা দূর করতেই মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল জাদুতত্ত্বের। বেশি যৌনতায় যেমন অনেক সন্তান মেলে, তেমনি নর-নারীর অতি সঙ্গমের প্রভাব ফসল উৎপাদনেও পড়ে বলে ধারণা করত তারা। এতে বেশি ফসল বা পশু লাভ করা সম্ভব হয়—এমন বিশ্বাসে আস্থা রাখত আদিমরা। এমনকি কিছু মানুষ অনুষ্ঠান করে বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে যৌনতার আয়োজন করত।
আজকাল যৌনতাকে যে দৃষ্টিতে দেখা হয়, আদিম ও প্রাচীন মানুষদের কাছে এই শারীরিক সম্পর্কের অর্থ সে রকম ছিল না। যৌনতা ছিল তাদের টিকে থাকার যুদ্ধ। কেননা, তাদের ধারণায়—এটির ওপরই নির্ভর করত সেকালের ফসল উৎপাদন ও পশুর বংশবৃদ্ধি। কারণ, মানুষ যত বেশি যৌনক্রিয়ায় অংশ নেবে, প্রকৃতিও তত বেশি যৌনসক্রিয় হয়ে উঠবে। ফলে ফসল বেশি ফলবে। আগের মানুষের ধারণায়, বৃষ্টি ও মাটির যৌনতার ফলাফলই ছিল শস্য। এমনকি তারা তাতে এত গভীরভাবে বিশ্বাস করত যে, ৭ থেকে ১১ আষাঢ় পর্যন্ত প্রাচীন ভারতবর্ষের চাষিরা প্রজনন ব্রত পালন করত। এ সময় হলকর্ষণ নিষিদ্ধ ছিল। তারা ভাবত, এ সময় পৃথিবী রজঃস্বলা থাকে। ভারতবর্ষের বাইরেও এসব বিশ্বাসের বিস্তার ছিল। যেমন মধ্য আমেরিকার পিপাইল জাতির চাষিরা জমিতে বীজ বোনার চার দিন আগে থেকে স্ত্রী সঙ্গম থেকে বিরত থাকত; যাতে বীজ বপনের ঠিক আগের রাতে দম্পতি তীব্র তেজে যৌনসঙ্গম করতে পারে। এই প্রবল রতিক্রিয়ার প্রভাব বীজে সঞ্চারিত হবে বলে বিশ্বাস করত তারা। এমনকি প্রাচীন মানুষেরা এমন কিছু নর-নারী নিয়োগ করত, যারা বীজ বপনের সময় চাষের খেতের ওপর যৌনক্রিয়ায় অংশ নেবে। তখনকার পুরোহিতেরা এই যৌনতাকে বাধ্যতামূলক করেছিল। জমিতে গিয়ে নর-নারী যৌনতায় অংশ না নিয়ে বীজ বোনাকে রীতিমতো বেআইনি গণ্য করা হতো। জাভার কিছু অঞ্চলে ধানে বীজ আসার আগে কিষান-কিষানি সঙ্গম করত। মধ্য আফ্রিকার বাগান্ডা গোষ্ঠীর লোকেরা মানুষের যৌনমিলনের প্রভাবকে ফসল উৎপাদনের সঙ্গে এত গভীরভাবে মিশিয়ে ফেলেছিল যে, বন্ধ্যা নারীকে জমির পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে দেওয়া হতো না। আবার আমেরিকার আদিবাসীরা চাইত, নারীর উর্বরতাশক্তি যেন বীজে ঢুকে যায়। তাই তারা মেয়েদের দিয়েই বীজ বোনাত। তাদের ধারণা ছিল, নারীরা ভুট্টা বুনলে প্রতি বৃন্তে তিনটি করে ভুট্টা ফলবে। কেননা, মেয়েরাই জানে কেমন করে ফলবতী হওয়া যায়। তারাই জানে কীভাবে জন্ম দিতে হয়। সাড়ে তিন হাজার বছর আগে সুমেরীয় অঞ্চলের উর্বরতার দেবী ইশতারের মন্দিরে গমচাষিরা উদ্বৃত্ত শস্য জমা করে ব্রোঞ্জের ছোট ছোট পয়সা নিয়ে ফিরত। যেটিকে ‘শিকেল’ নামে ডাকা হতো। মুদ্রাটি যার কাছে থাকত, সে উর্বরতা-দেবী ইশতারের মন্দিরে থাকা বেশ্যাদের সঙ্গে সঙ্গম করতে পারত। মানে শিকেল ছিল যৌনমিলনের টিকিট। মন্দিরের গণিকাদের মনে করা হতো উর্বরতা-দেবীর প্রতিনিধি। তাদের সঙ্গে সঙ্গম কেবল মনোরঞ্জনই নয়, সেকালের জাদুবিশ্বাসে তা ছিল ফসল উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
মানুষের যৌনতার ফলে যে সন্তানের জন্ম হয়, সেটির সঙ্গে পিতামাতার আত্মীয়তা ঘটে। ফলে মানব যৌনকর্মের প্রভাব যে ফসলে পড়েছে এবং সেখানে যা উৎপন্ন হয়েছে, সেটির সঙ্গেও মানুষের আত্মীয়তা গড়ে ওঠে। যেমন জার্মানিতে দানা শস্যকে মূলত ‘শস্য মাতা’ বলে ডাকা হতো। অস্ট্রিয়ার প্রদেশ স্টাইরিয়ার গম খেতে চাষিরা সর্বশেষ যেই গমগুলো কেটে আঁটি বাঁধত, সেটি দিয়ে তারা একটি নারী আকৃতির মূর্তি তৈরি করত। তারা এটিকে ‘শস্য জননী’ বলে ডাকত। সেটিকে তারা বাহারি পোশাকে সাজাত। একই রীতির দেখা মিলত ডানজিগের শহরতলির চাষিদের মধ্যে। তারা শুধু ফসলের শেষ আঁটি দিয়ে পুতুল তৈরি করেই ক্ষান্ত থাকত না; সেটিতে পানিও ঢালত; বৃষ্টির প্রত্যাশায়। স্লাভ অঞ্চলেও ফসল দিয়ে এমন মূর্তি তৈরির রীতি ছিল। ফ্রান্সের অক্সারের চাষিরা ফসল দিয়ে যেই পুতুল তৈরি করত, সেটিকে মা বলে ডাকত এবং বাহারি কাপড়ে সাজাত। পুতুলের নাম দিত ‘সেরেস’। পরে সেটিকে কেন্দ্র করে নাচগান করত। উত্তর ব্রিটেনেও সর্বশেষে কর্তিত ফসল দিয়ে বাঁধা আঁটি ব্যবহার করে দিয়ে মানবাকৃতির মূর্তি তৈরি হতো। তাদের ধারণা ছিল, জমির শেষ কিছু শস্যেই পুরো ফসলের মাঠ থেকে কর্তিত চারাগুলোর আত্মা ঠাঁই নেয়। তাই সর্বশেষে কর্তিত ফসলের আঁটির এত কদর এবং সেটিকে সাজিয়ে এত আমোদ-প্রমোদ। যাতে শস্য আত্মাকে সন্তুষ্ট রাখা যায়। কেননা, এই আত্মাই তো পরবর্তী বছরের ফসলে প্রবেশ করবে; বীজের মাধ্যমে। শেষ শস্যের আঁটি দিয়ে মূর্তি তৈরিতে বুলগেরিয়ার চাষিরা ছিল আরও একধাপ এগিয়ে। তারা শস্য দিয়ে মানবাকৃতির পুতুল তৈরি করেই থামত না, সেটিকে সারা গ্রাম ঘোরাত। শেষে বিসর্জন দিত পানিতে।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে শস্যের সর্বশেষ আঁটি দিয়ে তৈরি মূর্তিগুলোর মধ্যে একটা মিল ছিল। তা হলো, সবাই সেগুলোকে ‘শস্য মাতা’ হিসেবে গণ্য করত। কিন্তু বিশ্বের কিছু অঞ্চলে মূর্তিগুলো মায়ের আসন না পেয়ে পেত ‘কন্যার’ আসন। যেমন, স্কটল্যান্ডের হাইল্যান্ডসে চাষি যেই শস্য কাটত, সেগুলোকে বলা হতো ‘মেইধিনবুয়া’, যার বাংলা অর্থ ‘কর্তিত কন্যা’। পার্থশায়ারের বালকুহিডার জেলায় খেতের সর্বশেষ ফসলগুলো কাটত কম বয়সী কোনো একটি মেয়ে। তারপর আঁটি বেঁধে সেটি দিয়ে একটি পুতুল তৈরি করত। সেটিকে ফিতা ও রঙিন কাপড়ে সাজিয়ে দিত গ্রামবাসী। এই পুতুলের নাম ‘কনে’। মানে, শস্যকন্যা। ১৮৩০ সালে ডামবারটনশায়ারের গেয়রলক জেলার চাষিরা জমির শেষ শস্যগুলোকে শস্যকন্যা বলেই ডাকত। সাইফশায়ারেও শেষ শস্যকে কনে বলত। তারা সেগুলো দিয়ে মানবাকৃতির পুতুল তৈরি করে রাখত।
এই আলোচনার সারকথা হলো, আদিম ও প্রাচীন বিশ্বাসে সবকিছুতেই আত্মার উপস্থিতি দেখা যায়। এক আত্মা আরেক আত্মার কর্মকান্ড দিয়ে প্রভাবিত হতে পারে। যেমন মানুষের যৌনতার প্রভাব শস্যেও পড়ে। শস্য যখন কাটা হয়, তখন আত্মাগুলো পালিয়ে যেতে থাকে এবং সব আত্মা ঠাঁই নেয় জমির সর্বশেষ ফসলগুলোতে। তাই কৃষকদের কাছে জমির সর্বশেষ ফসলগুলোর কদর অনেক। তারা সেগুলো দিয়ে মূর্তি বানায়। কোথাও কোথাও সেগুলোকে কেন্দ্র করে আমোদ-প্রমোদ চলে এবং সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করা হয়। শেষ আঁটি দিয়ে তৈরি মানবাকৃতির মূর্তিগুলোকে কোথাও মায়ের মর্যাদা আবার কোথাও কন্যার মর্যাদা দেওয়া হয়।
ইউরোপের চাষিরা শস্যনির্মিত পুতুল বা মূর্তির খুব খাতির করত। কারণ, তারা সেটিকে শস্য আত্মার প্রতিনিধি ভাবত। সেটিকে রক্ষা করা গেলে শস্যও বাড়বে, ফলনও ভালো হবে। পেরুর আদিবাসীরা তাদের শেষ ফসলের আঁটি দিয়ে স্বর্গীয় মাতার আকৃতি তথা মূর্তি তৈরি করত। তারা ভাবত, ওসব ফসলের রয়েছে আরও অনেক ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা। মালয় ও ডিয়াক অঞ্চলের লোকেদের ধারণা, মানুষের মতো ধানেরও আছে আত্মা। শস্যটির উৎপাদন ও বৃদ্ধিতে ওসব আত্মা প্রভাব বিস্তার করতে পারে। রোমানরা ভুট্টাকে সেরেস দেবীর নামে ডাকত। সেলেবেসের মধ্য প্রদেশে চাষের আগে জমির একটি স্থানে নৈবেদ্য দেওয়া হতো। ফসল ফলার পর সেই স্থানের শস্যগুলো একসঙ্গে বেঁধে রাখত তারা। সেগুলোকে চাষিরা সবার শেষে কাটত এবং অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে গোলায় নিয়ে আসত।
এবার দেখা যাক ওসব কর্তিত শস্যের সঙ্গে দেব-দেবীর সম্পৃক্ততা কী। গ্রিক দেবী ‘দিমিতার’, তিনি শস্য মাতা নামে পরিচিত। তিনি একাধারে ‘পারসিফোনি’ দেবীর মা। দিমিতার মূলত পাকা ফসলের দেবী। তার থেকে যেই বীজ মেলে, সেটিই হলো পারসিফোনি। স্কন্দ কার্তিকেয় একজন লৌকিক দেবতা, যিনি কৃষি ও প্রজননের দেবতা। আদোনিস, আটিস ও ওসিরিস দেব-দেবীর সঙ্গেও কৃষির যোগ রয়েছে। প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতাকে প্রাচীন মানুষেরা নর-নারীর জননাঙ্গের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করেছিল। লিঙ্গ ও যোনিপূজাকে তারই ফল বলে মত দেন কেউ কেউ।
ছবি: ইন্টারনেট
সহায়ক বই:
১. গোল্ডেন বাউ, স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজার; অনুবাদ খালিকুজ্জামান ইলিয়াস।
২. লোকায়ত দর্শন, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।
৩. ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।
৪. কাউ টু ক্রিপ্টোকারেন্সি, মো. আদনান আরিফ সালিম ও মো. আব্দুল হামিদ।