কভারস্টোরি I প্রসাদবিচিত্রা
নৈবেদ্যর প্রধান একটি অংশ প্রসাদ। দেবদেবীর সামনে যা রাখা হয়। এটি কেবল ভক্তের দেওয়া সুবিন্যস্ত খাদ্যদ্রব্য নয়, প্রার্থনার প্রতীকও বটে। তবে কালে কালে এতে বদল ও বৈচিত্র্য এসেছে। লিখেছেন কনক বিশ্বাস
পূজার প্রসাদ এবং প্রদীপ প্রজ্বালন আবশ্যিক ব্যাপার। বৈদিক যুগে অবশ্য দীপ জ্বালানোর প্রথা ছিল না। কারণ, তখন হোম-যজ্ঞ হতো। ধারণা করা হয়, বৈদিক হিন্দুত্বের বাইরেও যে সনাতন ধর্ম রয়েছে, সেখান থেকে এই প্রথা এসেছে। হিন্দুরা সাকার দেবদেবীর পূজা-অর্চনা শুরু করার পর থেকেই এর চল। ভগবতগীতার ৯.২৬ শ্লোকে ভগবান কৃষ্ণ বলেছেন, শুধু একটি ফল, একটি ফুল, গাছের একটি পাতা ও অল্প জল দিয়ে যদি ভক্তরা তাঁকে পূজা করে, তাতেই তিনি সন্তুষ্ট হন।
দুই হাজার বছর অথবা তারও আগে পুরাণ রচনার পর থেকে ঈশ্বর আর নিরাকার রইলেন না। তখনই সাকার হয়ে উঠলেন। এরই মধ্যে মানবসভ্যতার অনেক রূপান্তর ঘটলেও সে সময়ের সঙ্গে এখনকার পূজার বেশ কিছু মিল পাওয়া যায়। আরাধনার অনুষঙ্গ হিসেবে যেমন স্নানাভিষেক, বস্ত্র, নৈবেদ্য, গন্ধদ্রব্য, ধূপ ও দীপ রয়েছে। একই সঙ্গে প্রসাদের উপকরণেও পরিবর্তন ঘটেছে। আবার টিকেও আছে অনেক কিছু।
সব সনাতন ধর্মাবলম্বীর মধ্যে, তা সে বৈদিক, পৌরাণিক, নিগমীয় অথবা অগমীয় হোক কিংবা শ্রৌত বা স্মার্ত—সবার পূজার ধরন অনেকটা একই রকম। তারা প্রথমে ঈশ্বরকে আহ্বান জানায়, তারপর তাকে নৈবেদ্য উৎসর্গ করে। ভক্তরা সেই প্রসাদ পায়। এরপর তারা দেবতার কাছে কোনো বর চায়। সবশেষে থাকে বিসর্জন। বাঙালি হিন্দু সমাজের সব জায়গায় পূজার এই রীতি প্রায় অভিন্ন। তবে কালের বিবর্তনে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং উপকরণের প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে প্রসাদের বিষয়টি। যেমন বৈদিক যুগ থেকে কালীপূজায় পাঁঠা বলির প্রথা চালু হয়। কোথাও কোথাও মহিষও উৎসর্গ করা হতো। বলি দেওয়া হতো ভেড়াও। তবে সেই রীতি এখন অনেক জায়গায় আর পালিত হয় না, পশু বলির পরিবর্তে কালীকে তুষ্ট করতে দেওয়া হয় আখ ও চালকুমড়া। অন্যদিকে ষষ্ঠীপূজা বা জামাইষষ্ঠী কোথাও কোথাও অরণ্যষষ্ঠী নামে পরিচিত। অরণ্যে যত ফল পাওয়া যেত, সেগুলোই ছিল দেবতার প্রসাদ। এখন সেসব উপাদানের ধরন বদলেছে। যোগ হয়েছে এ সময়ের উচ্চফলনশীল বা আধুনিক উদ্যানে উৎপাদিত ফল।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা। প্রথম দিন নবদুর্গা মা শৈলপুত্রীকে পূজা দেওয়া হয়। সেদিন মাকে আলুর হালুয়া, লাড্ডু আর সাবুদানার খিচুড়ি ভোগ রাখা হয়। নবরাত্রির দ্বিতীয় দিনে দেবী ব্রহ্মচারিণীর আরাধনা। এই তিথিতে ভোগে রাখা হয় চিনির তৈরি প্রসাদ। কোথাও দেওয়া হয় কলার বরফি বা আটার হালুয়া। তৃতীয়ার নৈবেদ্যে দুধ অর্পণ করার রীতি। মাখানা ক্ষীর আর ফলও থাকে। চতুর্থীর দিনে দেবী কুষ্মান্ডার পূজায় ভক্তরা সারা দিন উপবাসের পর মাকে দেয় মালপোয়া। পঞ্চমীতে থাকে কলার তৈরি প্রসাদ। নবরাত্রির ষষ্ঠীর দিন মা কাত্যায়নীকে পূজায় দেওয়া হয় আলুর তৈরি সবজি ভোগ। সপ্তমী তিথিতে দেবীর জন্য থাকে গুড়ের তৈরি খাবার। অষ্টমীর দিন চলে মহাধুমধাম। এই তিথিতে দেবীকে দেওয়া হয় নারকেলের তৈরি মিষ্টান্ন। শেষ দিন নবমী, সিদ্ধিদাত্রী রূপে দেবীর প্রসাদে থাকে হালুয়া, পুরি ও ছোলার খাবার।
তবে স্থান ও কালের বিবেচনায় দেবীর প্রসাদে পরিবর্তন ঘটে। আগেই বলা হয়েছে, এর সঙ্গে ভক্তদের অর্থনৈতিক অবস্থাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গৃহস্থ অনেকে পারিবারিক পূজা উৎসব করে। সেখানে আত্মীয়স্বজনের বাইরে প্রতিবেশীরাও যোগ দেয়। যেমন অজয় নদের পাশে রসুই গ্রামে ১৯০৫ সালে স্থানীয় শশীভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় পূজা প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে শুরুতে সর্ষে বাটা মাছের ঝোল রান্না করে প্রসাদ দেওয়ার রীতি ছিল।
যেকোনো মাছ সেখানে গ্রহণ করা হতো না। পুকুরের জ্যান্ত রুই, কাতলা, মৃগেলের পোনা দিয়ে তা রান্না করার চল ছিল। মসলা হিসেবে দেওয়া হতো সর্ষে, জিরা, আদাবাটা। রসুন ও পেঁয়াজ ব্যবহৃত হতো না। এ ছাড়া পূজার কদিন পাঁচ পদের অন্নভোগ তৈরির রীতি ছিল। সেগুলো হলো পোলাও, খিচুড়ি, গোবিন্দভোগ, সেদ্ধ চাল ও পায়েস। গোবিন্দভোগ চালের ভাত মাটির হাঁড়িতে রেঁধে পাথরের থালায় পরিবেশনের নিয়ম। সপ্তমীতে সাত, অষ্টমীতে আট ও নবমীতে নয় পোয়া চাল রান্না হতো।
কথিত আছে, ভগবান বিষ্ণু মর্ত্যলোকে এসে চার ধামে যাত্রা করেন—বদ্রিনাথ, দ্বারিক, পুরী এবং রামেশ্বরম। প্রথমে হিমালয়ের শিখরে অবস্থিত বদ্রিনাথ ধামে স্নান করেন, তারপর গুজরাটের দ্বারিকে গিয়ে পোশাক পরিধান করেন, ওড়িশার পুরী ধামে ভোজন এবং সবশেষে রামেশ্বরমে বিশ্রাম নেন। বিষ্ণুর সব অবতারের চিহ্ন আছে জগন্নাথদেবের মধ্যে। আবার ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত করা হয় তাকে। সে জন্য তাকে অর্পণ করা হয় ছাপান্ন ভোগ।
পুরাণমতে, যশোদা বালক কৃষ্ণকে আট প্রহর খেতে দিতেন। একটা সময় ইন্দ্রের রোষে পড়ে মহাপ্রলয়ের সৃষ্টি হয়েছিল। তখন প্রাণিকুলকে রক্ষা করতে তিনি নিজের কনিষ্ঠ আঙুলে গোবর্ধন পাহাড় তুলে নিয়েছিলেন। সাত দিন এভাবেই কাটে তার। ফলে খাবার ও জল কোনো কিছুই মুখে দেননি। প্রলয় বন্ধ হওয়ার পর সেই পাহাড় নামিয়ে রেখেছিলেন। এদিকে যে ছেলে দিনে আটবার খেত, টানা সাত দিন তাকে অনাহারে থাকতে দেখে যশোদার মন কেঁদে ওঠে। তখন ব্রজবাসীসহ যশোদা সাত দিন ও আট প্রহরের খাবার হিসেবে শ্রীকৃষ্ণের জন্য ছাপান্নটি পদ পরিবেশন করেন। সেই থেকে নারায়ণের এতগুলো ভোগের আয়োজন চলে আসছে।
জগন্নাথদেবের প্রসাদে মূলত দুই ধরনের খাবার দেওয়া হয়। ভাত, ডাল, তরকারি, খিচুড়ি জাতীয় রান্না করা পদ। আর শুকনা প্রসাদের মধ্যে খাজা, গজা, খই, মুড়কি, নারকেল নাড়– ইত্যাদি।
পুরীর মন্দিরে প্রতিদিন সমপরিমাণ প্রসাদ রান্না করা হয়; যা দিয়ে কয়েক হাজার ভক্তের ভরপেট খাওয়া হয়ে যায়। জগন্নাথ মন্দিরের একাংশে রয়েছে রান্নাঘর। সেখানে ৭৫২টি চুলা। ভোগ রান্নার কাজ করে তিন শর বেশি রাঁধুনি। রান্নার প্রক্রিয়াও বেশ মজার। একটির ওপর আরেকটি, এভাবে পরপর সাতটি পাত্র চুলায় বসানো হয়। এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে ওপরের পাত্রটির রান্না আগে হয়, তারপর একে একে নিচেরগুলো। সবার ধারণা, জগন্নাথদেবের আশীর্বাদেই এমনটি ঘটে। মূলত ফুটন্ত জলে সবজি এবং মসলা দিয়ে চলতে থাকে মহাপ্রভুর রান্না। মসলা বলতে নুন ও হলুদ। পেঁপে, আলু, টমেটো, কাঁচা লঙ্কাজাতীয় সবজি এতে ব্যবহার করা হয় না।
বাল্যভোগে জগন্নাথদেবকে দেওয়া হয় খই, চিড়ে, বাতাসা, মাখন, মিছরি, কলা, দই ও নারকেল কোরা। এরপর রাজভোগ। এতে থাকে মিষ্টি চালের খিচুড়ি, ডাল, তরকারি, ভাজা এবং পিঠাপুলি। দুপুরেরটি মূলত অন্নভোগ। তাতে ভাত, ডাল, শুক্তো, তরকারি ও পরমান্নের সমাহার। এ ছাড়া দেওয়া হয় ক্ষীর ও মালপোয়া। সন্ধ্যায় লেবু, দই দিয়ে মাখা পান্তাভাত; সঙ্গে খাজা, গজা এবং নানা ধরনের মিষ্টি। রাত্রি প্রথম প্রহরে বা ১১টায় ভাজা ও ক্ষীর আর মধ্যরাতে ডাবের জল পান করেন ভগবান।
জন্মাষ্টমী হলো হিন্দুদের খুব গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। গোকুলে দেবকীর অষ্টম গর্ভে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টম তিথিতে জন্ম হয় কৃষ্ণের। তারপর থেকে এই দিনটির মাহাত্ম্য তৈরি হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে। এই তিথির আরেকটি নাম গোকুলে অষ্টমী। এদিনেও ছাপান্ন ভোগের আয়োজন করা হয়। প্রসাদগুলো ছাড়া জন্মাষ্টমীর পূজা সম্পন্ন হয় না। তবে ভোগ দিলেই হবে না। এরও রয়েছে কিছু নিয়ম। এসবের ব্যত্যয় হলে রুষ্ট হবেন শ্রীকৃষ্ণ। আবার সেগুলো পরিবেশনের রীতিও জানতে হবে। এই তিথিতে দুধের তৈরি খাবারগুলো প্রথমে পরিবেশন করার নিয়ম। এই ভোগের মধ্যে থাকবে ষোলো ধরনের জলখাবার, বিশটি মিষ্টি এবং কুড়ি ধরনের শুকনা ফল। গোপালের প্রধান খাবার হলো মাখন ও মিছরি। ভোগ সাজানোর সময়ও প্রথমে দুধের তৈরি খাবার এবং শেষে দিতে হয় মিষ্টি।
জন্মাষ্টমীর ব্রত পালনে নিয়ম মেনে পূজা করলে সুফল পাওয়া যায়। এ সময় নবরূপে সুসজ্জিত করতে হয় শ্রীকৃষ্ণকে। সেখানে রাখা হয় ঝুলন, নতুন জামা, ময়ূরের পালক পরানো মুকুট, পাঞ্চজন্য শঙ্খ, বাঁশি, সুদর্শন চক্র, পুলের মালা, হাতের বালা ইত্যাদি। পূজার উপকরণগুলো হলো—ফুল, পঞ্চগব্য, পঞ্চগুড়ি, আতপ চাল, ফলের নৈবেদ্য, তুলসীপাতা, দূর্বা, ধূপ, দীপ, পাট, বালি, পঞ্চবর্ণের গুঁড়ো, মধু পর্কের বাটি, আসন-অঙ্গুরী ইত্যাদি। এই ব্রত পালনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসাদ হলো তাল ক্ষীর। শ্রীকৃষ্ণের ভোগের আরতিতেও রয়েছে প্রসাদের বিবরণ। যেমন :
শুক্তা-শাকাদি ভাজি নালিতা কুষ্মান্ড
ডালি ডাল্না দুগ্ধ-তুংবী দধি মোচা-খন্ড।
মুদ্গ-বোডা মাষ-বোডা রোটিকা ঘৃতান্ন
শুষ্কলী ষ্টিক খীর পুলি পায়সান্ন।
কর্পূর অমৃত-কেলি রংভা খীর-সার
অমৃত রসালা, আম্ল দ্বাদশ প্রকার।
জগন্নাথদেবকে যে প্রসাদ দেওয়া হয়, সেটিই নিবেদন করা হয় মা বিমলাকে। অর্থাৎ ভগবতী এখানে ভগবানের উচ্ছিষ্ট ভোজন করেন। মহাভারতে রয়েছে, একবার বৈকুণ্ঠে নারায়ণ ভোগ গ্রহণ করার পর মা লক্ষ্মী নিজে সেই এঁটো পাতে খেতে বসেন। এমন সময় নারদ এসে উপস্থিত। প্রভুর প্রসাদ দেখেই তার লোভ জেগে ওঠে। তিনি বারবার লক্ষ্মী দেবীকে অনুরোধ করতে থাকেন, প্রসাদের একটি কণা অন্তত তাকে যেন দেওয়া হয়। কিন্তু দেবী তাতে নারাজ। অবশেষে নারদ সখীর রূপ ধরে দীর্ঘদিন লক্ষ্মীর পরিচর্যা করলেন। দেবী খুশি হয়ে বর দিতে চাইলে নারদ বিষ্ণুর প্রসাদ চাইলেন। নিরুপায় দেবী নারদের ইচ্ছা পূরণ করলেন। ফলে তিনি ওই প্রসাদ খেয়ে মহাভাব প্রাপ্ত হলেন। তারপর তিনি বিভোর হয়ে টলতে টলতে কৈলাসে গেলেন। শিব নারদের এই পরিবর্তন দেখে হতবাক। তিনি সব ঘটনা শুনে বললেন, অধম, আমার জন্য আনতে পারলে না নারায়ণের একবিন্দু প্রসাদ? দেখো তোমার হাতে কিছু লেগে আছে কি না! অনেক খুঁজে নখের ভেতর একটি কণা পাওয়া গেল। শিব সেটি খেয়েই মহাভাবপ্রাপ্ত হলেন। এমন সময় সেখানে এলেন দেবী দুর্গা। তিনি দুজনের এমন মহাভাব দেখে বুঝতে পারলেন এবং মহাদেবের কাছে সেই প্রসাদ চাইলেন। শিব ভাবের ঘোরে বললেন, তুমি এই প্রসাদ ভক্ষণের যোগ্য নও ভবানী। এতে দেবী ক্ষুব্ধ হলেন এবং প্রতিজ্ঞা করলেন, ‘কলিযুগে আমি এই হরিপ্রসাদ আচন্ডাল-ব্রাহ্মণে খাওয়াব, এমনকি তা কুকুরেও ভক্ষণ করবে। আর আমাকে নিবেদন না করা পর্যন্ত এই প্রসাদ ভক্ষণের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। আমি মুখে দিলেই তা হয়ে উঠবে মহাপ্রসাদ।’
দুর্গাপূজার মহাঅষ্টমীতে ছাগ এবং মহানবমীতে মহিষ বলি দেওয়া হয়। প্রভু জগন্নাথের শয়ন হয়ে গেলে ছাগশিশু বলি এবং আমিষ ভোজনের নিয়ম। দেবীর প্রতিষ্ঠা মাসে ভেড়া বলির চল আছে। ভৈরব ও দীপান্বিত কালীপূজার সময়ও বলি হয়। তবে এখন পশু বলির রীতি অনেক ক্ষেত্রেই অনুসরণ করা হয় না।
তবে দেবতাভেদে প্রসাদ পছন্দেরও ভিন্নতা রয়েছে। সর্বশক্তিমান শিবের যেমন দুধ। তাতে অল্প ভাং বা কেশর মিশিয়ে প্রসাদ তৈরি করলে তিনি অত্যন্ত প্রসন্ন হন বলে কথিত আছে। একইভাবে বিষ্ণুদেব শুয়ে আছেন দুধের সাগরে, ক্ষীরের ওপর। বেদে দুধকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ থেকে উৎপন্ন ঘি যজ্ঞে ব্যবহৃত হয়। নারায়ণের পছন্দ হলুদ রঙের খাবার। তাই প্রতি বৃহস্পতিবার ডাল, হলুদ লাড্ডু এবং গুড় দিয়ে এই দেবতার আরাধনা করার রীতি প্রচলিত। অন্যদিকে শ্রীকৃষ্ণ ভালোবাসেন মাখন ও ঘি। গণেশ ঠাকুরের মোদক এবং লাড্ডু। বুধবার এই প্রসাদ তাকে পরিবেশনের রীতি। শাস্ত্রমতে প্রতি মঙ্গল ও শনিবার শ্রী হনুমানের পূজা করলে দারুণ উপকার পাওয়া যায়। বিশেষত সংসারের ওপর খারাপ শক্তির প্রভাব কমে। তার পছন্দের প্রসাদ ডাল এবং গুড়। শনিদেবের আরাধনায় তিলবীজ, ডাল এবং সরিষার তেল নিবেদন করতে হয়। তবে গুড়ের তৈরি তিলের লাড্ডুও তিনি ভালোবাসেন। মা লক্ষ্মীর মন জয় করার জন্য পূজায় দিতে হয় ভাতের যেকোনো পদ এবং ক্ষীর। এতেই তিনি তুষ্ট হন। বিদ্যার দেবী মা সরস্বতী ভালোবাসেন খিচুড়ি। আর কালীর পছন্দ ভাতের যেকোনো পদ এবং ক্ষীর। শিবপত্নী দেবী দুর্গার প্রিয় খাবার হলো খিচুড়ি এবং ক্ষীর। এ কারণে তাকে পূজার সময় ফল ও মিষ্টির পাশাপাশি প্রসাদ হিসেবে এই খাবার নিবেদন করা হয়।
দেবদেবীরা শুধু প্রসাদ পেতে নয়, রান্না করে খাওয়াতেও ভালোবাসেন। এদের মধ্যে সীতা উল্লেখযোগ্য। তিনি খুব ভালো রাঁধুনি ছিলেন। অন্যকে রেঁধে খাইয়ে তুষ্ট করতে তার জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু ব্রাহ্মণেরা খেতেন খুব অল্প। তাতে সীমার মন ভরত না। তাই তিনি একদিন রামকে এমন একজন ব্রাহ্মণ নিয়ে আসতে বললেন, যিনি খেতে পছন্দ করেন। রাম অগস্ত্য মুনিকে নিয়ে এলেন। সীতা অনেকগুলো পদ রান্না করে তার সামনে পরিবেশন করলেন। মুনি বললেন, এত অল্প খাবারে তার পেট ভরবে না। তখন সীতাদেবী গণেশ ঠাকুর এবং তার দুই পত্নী রীতি ও সিদ্ধিকে রান্নার কাজে সহযোগিতা করতে বললেন। পদের পর পদ রান্না হলো। তাতেও অগস্ত্যর পেট ভরল না। সতেরো দিন পর্যন্ত তিনি খেয়েই চললেন। শেষে আঠারো দিন পর রামের অনুরোধে তিনি আধপেটা অবস্থায় আহার থামিয়েছিলেন।
দুই
পূজা মানেই উৎসব। দেবতার উদ্দেশে ভক্তের আত্মনিবেদন। যেকোনো পোশাকেই দেবতাকে স্মরণ করা যায়। তবু উৎসবের দিনগুলোকে আনন্দময় করতে বিশেষ রঙের ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিধেয়র বিষয়টি অনেক আগে থেকেই মানুষ মেনে আসছে। মেয়েদের সাদা গরদের শাড়ি, লাল পাড় এবং ছেলেদের ধুতি, পাঞ্জাবি যেন বাঙালির পূজার চিরায়ত পোশাক। তার সঙ্গে চন্দনের ছোঁয়া, কপালে বড় লাল টিপ, সিঁথিতে সিঁদুর, হাতে শাঁখা। পায়ে আলতা দেওয়ার রীতিও আছে। তবে ষষ্ঠীর দিন ভক্তরা সাদা পোশাক পরে। নবমী তিথিতে গোলাপি পরিধেয় থাকে পূজারিদের। যেন দেবীর সঙ্গে নিজেদের রূপ ও সৌন্দর্যের একটা মেলবন্ধন তৈরি হয় এ সময়। উলুধ্বনি, শঙ্খনাদ, ঢোলের বোল আর মাতৃবন্দনার মাধ্যমে পূজার মন্দির ও মন্ডপে নানা আনুষ্ঠানিকতায় যোগ দেন ভক্তরা।
বৈদিক যুগে মন্ডপে ঘৃতাহুতি দেওয়ার জন্য আগুন জ্বালানো হতো না। তবে পূজার সময় চারপাশ আলোকিত করে তুলতে দীপ প্রজ্বালনের ব্যবস্থা থাকত। মূলত মাটির প্রদীপ ছিল। পরবর্তীকালে সে জায়গায় ধনীরা ব্যবহার করত পিতলের প্রদীপ। এতে ব্যবহৃত হতো অর্থনৈতিক অবস্থাভেদে তেল অথবা ঘি। প্রসাদের পাত্রও ছিল মাটি ও পাথরের। পরবর্তীকালে সেসবের স্থান দখল করে কাঁসা-পিতলের তৈজস। এখন স্টিল বা সিরামিকের বাসনকোসনও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। তবে দেবীর আভিজাত্যময় রূপের সঙ্গে মিলিয়ে কাঁসা-পিতলের ধাতব পাত্রই সবচেয়ে বেশি সমাদৃত। সঙ্গে থাকে ঘট আর আম্রপল্লব।
বাড়ির কর্ত্রী দীপ জ্বালে, প্রসাদের থালাও থাকে তার হাতে। দীপশিখা এবং যজ্ঞের আগুন একেবারে আলাদা। যজ্ঞশালায় ব্রাহ্মণ হোম করার উদ্দেশে অগ্নি প্রজ্বালন করেন। সন্ন্যাসীরা জ্বালাতেন ধুনি। তাতে তারা বনের কাঠপাতা ব্যবহার করতেন। আবার প্রসাদ অর্পণের সময় ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানোর রীতি আছে। এই ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে নৈবেদ্যর ঘি দিয়ে প্রদীপ জ্বাললে সংসারে অশুভ শক্তি প্রবেশ করতে পারবে না। প্রসাদের এই ঘি খাওয়া বারণ। তা শুধু দীপ জ্বালাতেই ব্যবহার্য।
দেবদেবীর প্রসাদ ভক্তদের প্রাণে প্রশান্তি এনে দেয়। বৈদিক যুগ থেকে এ পর্যন্ত তাতে সৃষ্টি হয়েছে নানান বৈচিত্র্য। সাম্প্রতিক বাস্তবতায় তারও ঘটেছে বদল। যেমন ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন, ঢাকেশ্বরী মন্দিরসহ কয়েকটি স্থানে কুমারীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ৩০-৩৫ হাজার দর্শনার্থীর সমাগম ঘটত। ভক্তদের জন্য থাকত দেবীর প্রসাদ। তবে করোনা পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে এমন সমাবেশ বাতিল করা হয়েছে। ফলে প্রসাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছে হাজার হাজার ভক্ত।
মডেল: অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: কিয়ারা
ছবি: তানভীর খান