ফিচার I স্পেস শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ছায়া
বিয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য ভেন্যু খোঁজার ঝামেলা মিটিয়ে দিচ্ছে ‘ছায়া’। এতে ঘটছে অর্থ ও সময়ের সাশ্রয়
বিয়ের ভেন্যু নির্বাচন কি চাট্টিখানি কথা! শিডিউল পাওয়া যাবে তো? বাজেটের মধ্যে যদি না পাওয়া যায়? এমন সব প্রশ্ন উঁকি দেয় ক্ষণে ক্ষণে। ভেন্যু নিয়ে এসবের সমাধান দিচ্ছে একদল তরুণ। ভেন্যু নিয়ে সমস্যা সমাধানে কাজ করছে তাদের ভিন্নধর্মী উদ্যোগ ‘ছায়া’। যেকোনো আয়োজনের এই কাজে সাহায্য করবে তারা।
বাংলাদেশের প্রথম স্পেস শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে যাত্রা শুরু করে ২০১৯ সালে। ‘সকলের জন্য একটি স্থান’ এই লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করে ছায়া। ভিন্নধর্মী উদ্যোগটির কারিগর ফারহিয়া তাবাসসুম ও মেহরাব আনোয়ার। একটা সমস্যা থেকেই ছায়ার সৃষ্টি। সালটা ২০১৯, ফারহিয়া তাবাসসুম ও মেহরাব আনোয়ার তাদের এক বন্ধুর ফ্যাশন ব্র্যান্ডের জন্য শুটের কাজ করেছিলেন। তারা খেয়াল করেছিলেন যে শুটের জন্য উপযোগী একটি স্পেস খুঁজে কাজটি করতে গিয়ে তাদের লভ্যাংশ রাখা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। তখন এক বন্ধুকে তার বাসা শুটের জন্য ভাড়া দেওয়ার অনুরোধ করেন। এই অভিজ্ঞতা থেকে তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে প্রযুক্তির সমন্বয়ে সমস্যাটির একটা সমাধানের পথ বের করা সম্ভব। ‘ছায়া’ যাত্রা শুরু করেছিল শুধু ফটোশুটের জন্য স্পেস শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে। শুরুতে তাদের ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক পেজে স্পেস বুকিং করার সুযোগ ছিল। আগ্রহীরা একটি গুগল ফরম পূরণ করার মাধ্যমে তাদের সেবা গ্রহণ করত। ফারহিয়া ও মেহরাবের পরিবার এবং বন্ধুমহলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল কার্যক্রম। মাসখানেকের মধ্যে তারা উপলব্ধি করেন যে তাদের সেবা গ্রহণকারীরা (যারা স্পেস বুকিং করে) শুধু ফটোশুট নয়, এর বাইরেও আরও বিভিন্ন কারণে স্পেস বুক করতে আগ্রহী, স্পেসও (যাদের স্পেস) বিভিন্নভাবে স্পেস ভাড়া দিতে ইচ্ছুক। তখন থেকে ছায়া বহুমুখী স্পেস শেয়ারিং মার্কেটপ্লেসে রূপ নিয়েছে। বর্তমানে ব্যক্তিগত এবং বাণিজ্যিক স্পেস মিলিয়ে প্রায় ৯০টি স্পেস তাদের সঙ্গে যুক্ত।
স্কলাস্টিকায় পড়াকালীন ফারিয়ার পরিচয় হয় সহপ্রতিষ্ঠাতা মেহরাবের সঙ্গে। কৈশোরকাল থেকেই ভালো বন্ধু তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই নিজেদের স্বপ্ন নিয়ে সচেতন ছিলেন। যখন দুজনেই বুঝতে পারেন তাদের দৃষ্টি অনেক ক্ষেত্রে একই, তখন তারা সিদ্ধান্ত নেন, একসঙ্গে কাজ করে একটি সমস্যার সমাধান করবেন।
বর্তমানে চারজন ফুলটাইম টিম মেম্বার কাজ করছে। পাশাপাশি তাদের সঙ্গে দুজন খন্ডকালীন ইন্টার্ন যুক্ত রয়েছে। তা ছাড়া তারা মার্কেটিং, আর্থিক ও লিগ্যাল বিষয়ের জন্য ফ্রিল্যান্সার, কনসালট্যান্ট অথবা এজেন্সিকে দিয়ে কাজ করিয়ে থাকেন। ব্যবহারকারীরা তাদের ওয়েবসাইট থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী স্পেস খুঁজে দেখতে পারেন। যদি তাদের প্রয়োজন অনুসারে কোনো স্পেস পছন্দ হয়, তখন একটি বুকিং রিকোয়েস্ট করতে হয়, যেটি পরবর্তীকালে স্পেসার চেক করে বুকিংটি গ্রহণ অথবা বাতিল করতে পারে। যখন স্পেসার রিকোয়েস্ট গ্রহণ করে তখন ব্যবহারকারীকে পুরো বুকিং অ্যামাউন্টটি পরিশোধ করতে হয় এবং বুকিংটি নিশ্চিত হয়। যারা নিজেদের প্রপার্টি থেকে খুব সহজেই কোনো রকম ঝামেলা ছাড়া আয় করতে চায়, তারা ওয়েবসাইট থেকে লিস্টিং ফরম পূরণ করে খুব সহজেই তাদের স্পেস ‘ছায়া’র সঙ্গে লিস্ট করতে পারে। লিস্টিং ফরমে স্পেসের বর্ণনা, প্রাইসসহ আরও অনেক তথ্য দিয়ে পূরণ করতে হয়। এরপর ছায়া তাদের পরবর্তী প্রতিটি ক্ষেত্রে সহযোগিতা দিয়ে থাকে।
ফারহিয়া তাবাসসুম বলেন, আগে যেকোনো ছোটখাটো ইভেন্ট পরিকল্পনায় গিয়ে অনেক সময় লেগে যেত, ব্যয়সাপেক্ষও ছিল। তবে এখন মানুষ তাদের অর্থ ও সময়— দুই-ই বাঁচাতে পছন্দমতো স্পেস বুক করতে পারছে ছায়া থেকে। এখন শুধু তারা যতটুকু সময়ের বুকিং ততটুকু সময়ের জন্য অর্থ পরিশোধ করতে পারছে, তা ছাড়া আমরা এমন অনেক নতুন স্পেস বুকিংয়ের জন্য এক্সেসযোগ্য করতে পেরেছি, যেটা আগে ছিল না। মোটকথা, আমরা পুরো স্পেস খোঁজা এবং বুকিংয়ের প্রক্রিয়াটিকে অনেক সহজ করতে পেরেছি। ইতিমধ্যে শতাধিক জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, ফটোশুট, করপোরেট ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট করেছি। কনটেন্ট ক্রিয়েটর রাফসান দ্য ছোট ভাই, ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী সাবিলা নূরসহ নানান পরিচিত মানুষের সঙ্গে কাজ করেছি। এ ছাড়া সুপরিচিত ফ্যাশন ব্র্যান্ড এবং নানা ধরনের স্টার্টআপ আমাদের সেবা ব্যবহার করেছে। আমরা স্পেসারদের সঙ্গে সব সময়ই একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। পরিচিত মানুষদের মাধ্যমে নতুন স্পেস লিস্ট করা অনেক সহজ এবং সবচেয়ে ভালো একটা উপায়। তা ছাড়া একটি প্রসেস তৈরি করেছি, যার মাধ্যমে সম্ভাব্য স্পেসারদের শর্টলিস্ট করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি।
কাজ করতে গিয়ে সীমাবদ্ধতার মধ্যে পড়তে হয়েছে। অবশ্য প্রাথমিকভাবে তথ্য আকারে সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হয়েছিলাম। আইনি এবং আর্থিক বাধ্যবাধকতা থেকে শুরু করে, বিনিয়োগের প্রস্তুতি নেওয়া, তথ্যের অ্যাক্সেস খুব কম ছিল। গত এক বছরে অনেক পরামর্শ ও নির্দেশনা পেয়েছি। আমি মনে করি, ইনকিউবেটরে প্রবেশ করা প্রাথমিক পর্যায়ের স্টার্টআপগুলোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ; কারণ, তারা সত্যিই আমাদের শিখিয়েছে, কীভাবে আইনগতভাবে সংগতিপূর্ণ হতে হয়, ব্যবসার নির্দিষ্ট সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার জন্য সঠিক ব্যক্তিদের যুক্ত হতে হয় ইত্যাদি। স্বল্প সময়ের মধ্যে আমরা এঞ্জেল বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে সিড ফান্ডিং সংগ্রহ করেছি। আমরা ‘এনএসইউ স্টার্টআপ নেক্সট’-এর দ্বিতীয় দল হিসেবে অংশ নেওয়ার জন্য নির্বাচিত হয়েছি। সম্প্রতি ‘She Loves Tech’ এর লোকাল রাউন্ডে তৃতীয় স্থানে জায়গা করে নিয়েছি। আমাদের অর্জনগুলো স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যেতে বেশ অনুপ্রেরণা জোগাবে বলে বিশ্বাস করি।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি জানান, ছায়ার তালিকায় ঢাকার বাইরে অন্যান্য শহরকে যুক্ত করার ইচ্ছা আছে। তারা এমন একটি বাংলাদেশকে কল্পনা করেন, যেখানে মানুষ একটি বাটনের ক্লিকে প্রতিটি স্থান খুঁজে পাবেন, যা তাদের সব প্রয়োজন পূরণ করবে।
গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত
ছবি: ইন্টারনেট