ফিচার I বরযাত্রা
বরযাত্রা রীতিটিও সাড়ম্বরে পালিত হতে দেখা যায় বাঙালির বিয়ের উৎসবে। সঙ্গে থাকে ব্যান্ড পার্টি। বর চলেছে কনের বাড়ি, এটা জানিয়ে দিতেই এত আয়োজন। লিখেছেন কনক বিশ্বাস
সংস্কৃত ন্যায়বিদ রঘুনন্দন ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘ভার্যাত্বসম্পাদকং গ্রহণং বিবাহঃ।’ আবার সংস্কৃত স্মৃতিকার গোপালের মতে, ‘পিত্রাদি কর্তৃক কন্যোৎসর্গান্তরং বরংস্বীকারো বিবাহঃ।’ অর্থাৎ পিতা কর্তৃক কন্যা সম্প্রদান এবং কন্যা কর্তৃক বর বরণের নাম বিয়ে। এই দিন পাত্রপক্ষ বরকে সাজিয়ে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে কন্যার বাড়িতে যায়। এটিই বরযাত্রা, যা বিয়ে নামক সংস্কৃতির গুরুত্ব অংশ। পৃথিবীর সব জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে এটি বিয়ের প্রচলিত একটি রীতি। তবে বিবাহ পদ্ধতি দেশ, জাতি, ধর্মীয় পরিচয়ভেদে আলাদা। আধুনিক শিক্ষা, প্রযুক্তির বিকাশ ও সভ্যতা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন অনেক উৎসব, রীতিনীতি, আদবকায়দা, প্রথা বদলেছে। এসব পরিবর্তনও ঘটে ধীরে ধীরে। তবে তা যে কেবল বিত্তবানদের মধ্যে দেখা যায় তা নয়, নিম্নবিত্ত সমাজেও তা লক্ষ করা যায়। এই বদল বরের পোশাক, সাজসজ্জা, যাত্রার আগে আচরিত নানান রীতি, বাহন ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই ঘটেছে।
বিয়ের দিন বরযাত্রার আগেই, সকাল থেকে চলে নানান রীতি অনুসরণ। এদিন শেষবারের মতো বরের গায়ে হলুদ মাখিয়ে গোসল করানো হয়। অনুষ্ঠানটি ‘বরস্নান’ নামে পরিচিত হলেও একই উপলক্ষে কন্যার বাড়িতে তাকেও স্নানের আয়োজন চলতে থাকে। আগেই বলা হয়েছে, এসব রীতি জাতি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় এবং দেশভেদে পরিবর্তিত হয়।
বাংলাদেশে মুসলমানরাও একধরনের আচার পালন করে। সাধারণত তাদের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় দুপুরবেলা। এ জন্য সকালে বরকে সাধারণ খাবারের পাশাপাশি মিষ্টিমুখ করানো হয়। বরযাত্রা শুরু হয় জোহরের নামাজের আগে। কন্যার বাড়ির দূরত্ব মেনে। কেননা, বরযাত্রীদের লক্ষ্য থাকে কন্যার বাড়িতে উপস্থিত হয়ে নাশতা সেরে জোহরের নামাজ পড়া। ফলে যাত্রার আগে বরকে গোসল করানো হয়। এ জন্য শেষবারের মতো এদিন তাকে হলুদ মাখানো হয়। তারপর ভাবি, দাদি, নানি সম্বন্ধীয় মেয়েরা বরকে গোসল করায়। কোথাও কোথাও এ সময় একে অপরকে রং মাখিয়ে আনন্দ করতে দেখা যায়। ‘বরস্নান’ শেষে ছেলে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি— সাধারণত দাদা, নানা অথবা বাবা— তাকে কোরআন তেলাওয়াত ও কলেমা পাঠ করান।
বরকে পরানো হয় পাজামা, পাঞ্জাবি, পাগড়ি এবং শেরওয়ানি বা কটি। এসব পোশাকের রঙেরও বৈচিত্র্য থাকে। সাধারণত পাজামা-পাঞ্জাবির সঙ্গে শেরওয়ানি কিংবা কটি হয় বিপরীত রঙের— সাদা, বাদামি, মেরুনের প্রাধান্যই বেশি দেখা যায়। আবার তা বেছে নেওয়া হয় কন্যার পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে। তবে দরিদ্র পরিবারের ক্ষেত্রে পরিধেয়র জাঁকজমক থাকে না। পাঞ্জাবি, পাজামার সঙ্গে সাধারণ টুপি তাদের পরতে দেখা যায়।
পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি— সাধারণত বাবা, চাচা, ভগ্নিপতি বরের বাহনে তার পাশে থাকে। কখনো ভাবি অথবা সমতুল্য মহিলাও সঙ্গে যায়। পরিবারে কোনো শিশু থাকলে তাকেও বরের পাশে বসিয়ে দেওয়া হয়। বাড়ি থেকে যাত্রার আগে বর পরিবারের বড় সদস্যদের সালাম করে, দোয়া চায়। ছেলের মঙ্গল এবং সুখী দাম্পত্য জীবন কামনায় মোনাজাতও করা হয়। শুধু পরিবারের সদস্য নয়, প্রতিবেশী বয়স্ক ব্যক্তিদের কাছ থেকেও বর দোয়া নিয়ে থাকে।
কন্যাপক্ষের জন্য বরের সঙ্গে দেওয়া হয় দই, মিষ্টি। বিয়ে সম্পন্নের পর সবাইকে মিষ্টিমুখ করানোর জন্য নেওয়া হয় বাতাসা বা এজাতীয় মিষ্টান্ন।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বরকে সকালবেলা ধান, দূর্বা, কাঁচা হলুদ দিয়ে স্নান করানো হয়। তার আগে তাকে একটা ঘরের মধ্যে পাটির ওপর বসিয়ে রাখার নিয়ম আছে। দুপুরবেলা বরের বউদি, ঠাকুমা বা নানি একটা বাঁশের নতুন চালুনে ধান, দূর্বা, হলুদ, সরিষার তেল, আদা ও মাটির প্রদীপ সাজিয়ে তার সামনে নিয়ে আসে। সেগুলো বরের মুখের সামনে উঁচু করে ধরে। অতঃপর তার হাত ধরে উঠানের এক পাশে যেখানে স্নানের আয়োজন করা হয়েছে, সেখানে নিয়ে যায়। একটা বড় কাঠের পিঁড়িতে বসিয়ে স্নান করানো হয়। বরকে গোসল করানোর সময় বিশেষ এক নাচের প্রচলন রয়েছে। তাকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী নারীরা এ নৃত্যের আয়োজন করে। তারা ধান, দূর্বা, পান, কড়ি ইত্যাদি দিয়ে বিয়ের নাচে অংশ নেয়। এতে বিশেষ গানও গাওয়া হয়।
বরযাত্রার আগে বরের সাজসজ্জার পালা। উচ্চ বর্ণ ধনী হিন্দুদের মধ্যে স্থানভেদে কোথাও কোথাও সাজপোশাকে কিছুটা পরিবর্তন দেখা যায়। তবে মাঙ্গলিক ধর্মকর্মগুলো সব ক্ষেত্রে প্রায় একই। বর কিরীট-কুন্ডল-কঞ্চুকাদি-মন্ডিত হয়ে যাত্রা করে। কেউ আবার সাদা শুদ্ধ ধুতি, পাঞ্জাবি ও উত্তরীয় পরে। বর উপবাসী থেকে যাত্রা করে। তার আগে কপালে চন্দনের ফোঁটা দেওয়া হয়। বাড়ির মেয়েরা তার কপালে শ্বেতচন্দন লেপে দেয় এবং বিপদাপদ থেকে মুক্তির জন্য মঙ্গল প্রার্থনা করে।
গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিয়েতে নতুন লুঙ্গি বা ধুতির সঙ্গে পাঞ্জাবি পরে বরের বসে থাকার অনেক পুরোনো আলোকচিত্র পাওয়া গেছে। এ থেকে বরযাত্রার বদলগুলো সম্পর্কে ধারণা করা যায়। বাংলা সাহিত্যে ত্রিশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবি জীবনানন্দ দাশের বিয়ের যে ছবি পাওয়া গেছে, সেখানেও তাঁকে সাধারণ ধুতি, পাঞ্জাবি এবং উত্তরীয় পরে থাকতে দেখা যায়।
পাজামা-পাঞ্জাবি, ধুতি, শেরওয়ানি, পাগড়ি অথবা টুপির সঙ্গে বরের সাজপোশাকের চিরায়ত অনুষঙ্গ রুমাল। রঙিন ফুল তোলা বা নকশা করা একখন্ড কাপড়ে নতুন জামাই মুখ ঢাকবে— এটা গ্রামবাংলার চিরন্তন ও প্রাচীন রীতি। এখানে ধনী-গরিবের ভেদাভেদ নেই। পার্থক্য থাকে শুধু দামে। আরও একটি হলো নাগরায়। এটিতেও ওই একই কথা খাটে। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বরের জন্য এ যেন ধরাবাঁধা নিয়ম।
বিয়ের নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বরযাত্রায় ‘বরের বাহন’ গুরুত্বপূর্ণ এবং খুব আকর্ষণীয় একটি বিষয়। প্রাচীনকাল থেকে বাংলা অঞ্চলে এই অনুষ্ঠানে বিশেষ বাহনের ব্যবস্থা হয়ে আসছে। সেই রীতিরেওয়াজ এখনো চলমান। একসময় শুধু পালকির ব্যবহার ছিল, সময়ের ব্যবধানে এখন যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন বাহন। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতাকে আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য করে তুলতে অনেক সময় ব্যয়বহুল এবং বর্ণিল বাহনের আয়োজন চলে। আজকাল বর গাড়িতে যাত্রা করলেও কনের জন্য বিভিন্ন ডিজাইনের পালকির ব্যবস্থা করতে দেখা যায়। গরু বা ঘোড়ার গাড়ি, এমনকি হাতিও থাকে বাহন হিসেবে। তবে এখন পালকিতে এসেছে বেশ আকর্ষণীয় পরিবর্তন। পশুপাখির আদলেও তৈরি হচ্ছে সেগুলো। পছন্দমতো নকশায়ও বানিয়ে নেওয়া যায়। পালকির সঙ্গে কতজন বেয়ারা থাকবে, তাদের গানবাজনা কেমন হবে— সবই এখন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের অংশ হয়ে উঠেছে। রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে গড়ে উঠেছে এগুলোর বাজার। চাইলে যে কেউ সামর্থ্য বুঝে অর্ডার করতে পারে। বরের বাহন সাজানো হয় কাঁচা ফুল, রঙিন ফিতা, নেট, জরির সুতা ইত্যাদি দিয়ে। সম্প্রতি হাতির পিঠে ও গরুর গাড়িতে চড়ে বরযাত্রার খবরও বেশ সাড়া ফেলেছে।
ছবি: ইন্টারনেট