ফিচার I বি বা হ গী ত
বিয়ের প্রতিটি পর্বে রয়েছে গান; বিশেষত গ্রামীণ জনপদে। সেসব গানের আবেদন ও আবেগ আজও টিকে আছে
বিয়েতে নাচ-গানের রীতি বহুকালের পুরোনো। মেয়েরাই সেগুলো পরিবেশন করে আসছে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিয়েতে মেয়েলি আচার-অনুষ্ঠানের একটা অঙ্গ ছিল মঙ্গলগীত। ধীরে ধীরে মুসলমানদের মধ্যেও এই রীতি যোগ হয়। দশ-পনেরো বছর আগেও গ্রামে গায়েহলুদের পর্বে গান গাওয়ার জন্য ‘গীত গাওনি’ মেয়েদের ডাক পড়ত। এখন সেসব গানের ধারা ক্ষীণ হয়ে এসেছে, তবে গ্রামীণ জনপদে আজও বিয়েতে গান গাওয়ার প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশের কোনো কোনো এলাকা, বিশেষ করে হাওর অঞ্চলের এসব গান লোকসংগীতের স্বতন্ত্র একটি ধারা হয়ে উঠেছে। এগুলো সাধারণত আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এবং প্রজন্ম পরম্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত, স্মৃতি ও স্বতঃস্ফূর্ততায় বিকশিত। দাদি-নানি, মা-চাচি-কাকিদের ঘিরে থাকে শিশুরা। তারা এসব গান শোনে এবং মনে রাখে। বড় হয়ে সেগুলো তারা গাইতে থাকে। ফলে কখনো কখনো মূল গানের কথায় সমকালীন অনেক কিছুই যোগ হয়ে যায়, তবে তাতে রস আস্বাদনে কোনো কমতি থাকে না।
কীভাবে বাঁধা হতো বিয়ের গান? গবেষক শক্তিনাথ ঝাঁ ‘মুসলমান সমাজে বিয়ের গীত’ বইতে এর উৎস সন্ধান করেছেন। তাতে তিনি বলেছেন, বাড়ির মেয়েরা অবসরে কথায় কথায় গান বাঁধত। কোনো প্রবাদ, প্রচলিত কথা নিয়ে আলাপ শুরু হতো, তারপর তারা নিজের স্বভাবগত কবিত্বশক্তি দিয়ে একেকজন মুখে মুখে একেক কলি যোগ করত। এভাবে তৈরি হতো একেকটা গান। আত্মীয়স্বজনের বিয়েতে সেসব গানই গাওয়ার চল ছিল। শহরাঞ্চলে বা মফস্বলে নানান ধরনের বাদ্যযন্ত্রসহযোগে সিনেমায় ব্যবহৃত গান গাওয়া হলেও পুরোনো দিনের গীত আবার ফিরে আসছে।
বিয়ের গানের আসরে পরিবারের বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা যোগ দেয়। ঢোল, ঘুঙুর, খোল ইত্যাদি বাদ্যের সঙ্গে দিনভর গীত গাওয়া হয়। তার সঙ্গে নাচ। রঙ্গরসিকতা এর আরেক ঐতিহ্য। দুজন বা তার বেশি মেয়ে একেক চরিত্রে অভিনয় করে কৌতুকের ছলে নেচে চাপান-উতরের মধ্য দিয়ে সুরে বাঁধা কথোপকথন চলে। বিয়ের বিভিন্ন পর্ব ও আচারকে কেন্দ্র করে গানগুলো বাঁধা হয়। অনুষ্ঠান ও গানের কথার মধ্যেও থাকে একধরনের ধারাবাহিকতা।
বন্দনা: বিয়েতে গানের আসর শুরু হয় বন্দনা গান দিয়ে। এই উপমহাদেশের শিল্পকলার অন্যান্য ধারার মতো এতেও ধর্মীয়, সামাজিক এবং পরিবারের পূজনীয়দের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর রীতি আছে। আল্লাহ-রাসুল, পীর-আউলিয়া, দেব-দেবী, পরিবার-পরিজন এবং গ্রামের মুরব্বিদেরও ভক্তি প্রকাশ করা হয়।
ক্ষীর খিলানী: বর-কনেকে ক্ষীর খাওয়ানোর অনুষ্ঠান দিয়ে বিবাহ-পূর্ব আচার শুরু হয়। বিয়ের এক দিন আগের রাতে পাত্র-পাত্রীকে বাড়ির লোকেরা, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা ক্ষীর, পিঠা, পায়েস, ফল, মিষ্টি ইত্যাদি খাওয়ায়। এ সময় চলতে থাকে গান। এই গীতে ক্ষীর তৈরি, তা খাওয়ানোর সময় সবার ভূমিকা, বর-কনের মনের অবস্থা— এসব কথা উঠে আসে।
ঢেঁকি মঙ্গলার গান: বিয়ের আগের দিন বর-কনের কৌমার্যের শেষ দিন হিসেবে আইবুড়ো ভাত বা থুবড়া ভাত খাওয়ানো এবং তার সঙ্গে নানান আচার অনুষ্ঠান প্রচলিত। এই খাবারের প্রধান পদ ‘পাকান’ বা একধরনের চালের পদ তৈরির জন্য ঢেঁকিতে চাল কোটা দিয়ে শুরু হয় এদিনের পর্ব। ঢেঁকিতে চাল কোটার সময় চলতে থাকে মঙ্গলগীতি।
আলমতলার গীত: বরের বাড়িতে তৈরি হয় মন্ডপ বা আলমতলা। এখানে অনুষ্ঠান শুরু হয় মেয়েদের গান দিয়ে। এই গীতে বিয়ের সময় ঘনিয়ে আসা এবং ভবিষ্যৎ জীবনের নানান সম্ভাবনার কথা থাকে।
ঝুমুর ডালা: এটি বিয়ের আগে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব। ঝুমুর ডালা অনুষ্ঠানের মধ্যে একেকটি আচারের সঙ্গে বিভিন্ন রকম গানের চল আছে। এ সময় সরষে চালা, শিরতেল, হলুদ মাখা, সোহাগ মানানো, পানি খিলানো পর্বগুলো পালন করা হয়। এসব অনুষ্ঠানের ধরন, ব্যবহৃত উপাদান বা সেই বিশেষ আচারের উদ্দেশ্যের সঙ্গে যোগ আছে ঝুমুর ডালার গানের। সেখানে যেমন সরষে চালার সময় ব্যবহৃত নানান কৃষিজ উপকরণের বিষয়ে, অন্যদিকে সোহাগ মানানোর ক্ষেত্রে আত্মীয়দের আশীর্বাদমূলক নানান গান গাওয়া হয়। তবে এই পর্বে গায়ে হলুদের আনুষ্ঠানিকতা সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং অবশ্যই পালনীয়। নানান ধরনের গানের চল থাকলেও একটি গীত প্রায় সর্বজনীন হয়ে উঠেছে:
হলুদ বাটো মেন্দি বাটো
বাটো ফুলের মউ।
বিয়ের সাজে সাজবে কন্যা
নরম সরম বউ।
হলুদ মেখে বিভিন্ন আচার-পর্ব শেষ হলে বাড়ির মেয়েরা বর-কনেকে ঘিরে নেচে নেচে ঠাট্টাকৌতুক করে গান গায়। এতে পাড়া-প্রতিবেশী বা পরিবারের লোকদের স্বভাব-চরিত্র, কথাবার্তার ধরন নিয়ে তামাশা করা হয়।
কামান করার গান: বিয়ের গীত একান্তই মেয়েদের হলেও সেখানে পুরুষের প্রবেশ ঘটে যখন পাত্র-পাত্রীর কামান করতে আসে পাড়ার নাপিত। মেয়েরা নরসুন্দরকে বিদ্রূপ করে নানা রকম গান গায়, আবার নাপিতও ছড়া কেটে প্রত্যুত্তর দেয়। এ ধরনের গীত বাঁধার চল কোথাও কোথাও রয়ে গেলেও এখন এই রীতি দেখা যায় না বললেই চলে। গ্রামেও কনেকে পাঠানো হয় বিউটি পার্লারে, আর বরের জন্য অপেক্ষাকৃত ভালো স্যালন।
মঙ্গলস্নান বা কলস ভরার গীত: কামান করানোর পর বর-কনের স্নানের পালা। এ জন্য বাড়ির মেয়েরা কাছের পুকুর বা নদী থেকে কখনো নিজেরা অথবা পাত্র-পাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে জল আনতে যায়। এই যাওয়া-আসা ও কলসে পানি ভরার সময় গাওয়া হয় নানা রকম গান।
থুবড়া ভাতের গান: এই সময় পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন উপস্থিত হয়ে ‘থুবড়া থাল’ থেকে বর-কনেকে খাওয়ায়। বিয়ের আগের রাত এবং অসংখ্য লোকসমাগম মিলিয়ে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। ফলে গানের আসরও বিচিত্রানুষ্ঠানের রূপ নেয়। থুবড়া থালের আয়োজনের এক পাশে মঞ্চ তৈরি করে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে মেয়েরা বসে পড়ে গীত গাওয়ার উদ্দেশ্যে। এ সময় বন্দনা থেকে শুরু করে সব পর্বের গানগুলো আবার গাওয়া হয়। কন্যা বিদায়সহ বিয়ের যাবতীয় আচার-অনুষ্ঠানের বিষয় উঠে আসে এই পর্বের গীতে। তা ছাড়া নানা রকম নাচ, পালা, কৌতুকে অংশ নেয় মেয়েরা।
বিয়ের দিন: সাধারণত মূল অনুষ্ঠানের দিন বাড়ির সবাই ব্যস্ত থাকে, ফলে এ সময় গানের চল সীমিত। আগে মাইকে রেকর্ডের গান বাজানোর রীতি ছিল। তবে কনে সাজানোর সময় গাওয়া যে গীতটি বেশ শোনা যায় এবং জনপ্রিয়, সেটি হলো—
লীলা বালি লীলা বালি ভর যুবতী সইগো
কী দিয়া সাজাইমু তরে।
মাথা চাইয়া সিন্থি দিমু ঝাঝরি লাগাইয়া সই গো
কী দিয়া সাজাইমু তরে।…
ফিরানির গান: কন্যা শ্বশুরবাড়ি থেকে দুদিন পর বাপের বাড়িতে আসে। বিয়ের পর প্রথম এই আসাকে বলে ফিরানি। বর-কনে একসঙ্গে কন্যার বাড়িতে এলে তখন উৎসবের আমেজ লাগে। পাড়া প্রতিবেশীরা আসে নতুন জামাই দেখতে। তাকে কীভাবে আদর-আপ্যায়ন করা হবে সিলেটের আঞ্চলিক একটি গানে রয়েছে তার অসাধারণ ভাবাবেগ। গানটি সম্প্রতি নেট দুনিয়ায় ভাইরালও হয়েছে। এই গানে রয়েছে বাড়িতে নতুন জামাই আসার চিরায়ত ছবি। গানটি হলো—
আইলারে নয়া দামান
আসমানের ও তেরা
বিছানা বিছাইয়া দিলাম
শাইল ধানের নেরা
দামান বও দামান বও
নারীর মনের আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখের প্রকাশ ঘটে বিয়ের গানে। একই সঙ্গে নতুন দাম্পত্য জীবনের হাসিঠাট্টা, একে অপরকে চেনার আনন্দও এতে মিশে থাকে। এসব গানের অধিকাংশেই আয়াসসাধ্য কোনো অলংকার বা স্বরভঙ্গি নেই। সুরেরও তেমন বৈচিত্র্য প্রায়শ খুঁজে পাওয়া যায় না। একই কথার পুনরাবৃত্তি চলতে থাকে। এ কারণেই তা গ্রামীণ নারী সমাজের মজ্জায় গেঁথে যায়। বিয়ের গীত লোকসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক বলে গবেষকদের অভিমত।
কনক বিশ্বাস
ছবি: ইন্টারনেট