skip to Main Content

সাক্ষাৎকার I ডিজাইনে কম্প্রোমাইজ করি কিন্তু কমফোর্টে নয় — প্রীতি মোদি

‘উই ওয়ান্ট পিপল টু এনজয় আওয়ার ক্লোদিং’— ঢাকা বেসড ডিজাইনার হাউস ‘কিয়ারা বাই প্রীতি মোদি’-এর মূলমন্ত্র এটাই। প্রীতি মোদি। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ভারতের বেঙ্গালুরুতে। বৈবাহিক সূত্রে ঢাকাতেই থাকছেন আট বছর ধরে। ২০১৮ তে নিজস্ব ব্র্যান্ড কিয়ারা প্রতিষ্ঠার পর দেশের ফ্যাশন জগতে তৈরি করেছেন স্বতন্ত্র পরিচিতি। ক্লোদিং ব্র্যান্ডের পাশাপাশি জনপ্রিয় করে তুলেছেন নিজস্ব ফুটওয়্যার ভেঞ্চার ‘জুত্তিওয়ালা’কেও। নিজের শুরুর দিনগুলোর কথা, ঢাকায় বসবাস, তাঁর আগামী দিনের স্বপ্ন এবং আরও অনেক কিছু নিয়ে কথোপকথনে প্রীতি মোদি

ক্যানভাস: ঠিক কবে থেকে ফ্যাশন নিয়ে আগ্রহের শুরু?
প্রীতি মোদি: সে তো কলেজের সময় থেকেই। ফ্যাশন নিয়ে ডিপ্লোমা সেরে নিয়েছিলাম আগেই। ফিন্যান্সে আমি যখন গ্র্যাজুয়েশন করছিলাম, তখন মাথায় আসে, এ দুটো ডিগ্রিকেই কাজে লাগিয়ে কিছু একটা করতে হবে। আর সেটা নিয়ে কাজ করতে করতেই কিয়ারা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করে ফেলি।
ক্যানভাস: কিয়ারা বাই প্রীতি মোদি ব্র্যান্ডটির শুরুর গল্পটা জানতে চাই। জুত্তিওয়ালার শুরুটাও কি একই সময়ে?
প্রীতি মোদি: কিয়ারার শুরুটা হয়েছিল বছর তিনেক আগে। শুরুতে ব্রাইডাল ওয়্যারটাই ফোকাস ছিল। প্রথম বছরের অভিজ্ঞতাটা একদমই ভালো ছিল না। দেশের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কাজ করতে গিয়ে অনেকটা হতাশই হতে হয়েছিল। সে সময় দুটি এক্সিবিশনে অংশ নিয়েছিলাম, আশানুরূপ ফল মেলেনি। পরবর্তীকালে মার্কেট রিসার্চ করে দেখলাম, মানুষ আরামদায়ক পোশাক খুঁজছে। শাড়ির প্রতি দুর্বলতা আমার বরাবরের। কিন্তু আরামদায়ক, ট্রেন্ডি শাড়ির অভাবে তরুণ প্রজন্ম এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। সেটা মাখায় রেখেই আমি মলমল শাড়ি নিয়ে কাজ শুরু করি। দারুণ সাড়া মিলেছিল প্রথম থেকেই। তারপর ধীরে ধীরে টিমটাও বড় হয়েছে। ব্র্যান্ডটাও। কিয়ারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
জুত্তিওয়ালা শুরু হয় কিয়ারার আট মাস পর। ছোটবেলা থেকে জুত্তির প্রতি আমার আলাদা আকর্ষণ ছিল। যখন দেখলাম বাংলাদেশের মানুষ শখ করে, পছন্দ করে নাগরা পরছে, তখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি জুত্তিওয়ালা শুরুর। ট্রেন্ড এবং ট্র্যাডিশনের মিশেলে তৈরি হয় এর একেকটি জুত্তি।
ক্যানভাস: আপনাদের ডিজাইনিং স্টুডিওতে কাজের ধারাটা কেমন?
প্রীতি মোদি: আমরা যখন মলমল শাড়ির নকশা করি, তখন উজ্জ্বল রংগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। কিয়ারার ইন হাউস মোটিফগুলোর মধ্যে ফড়িং অন্যতম। প্রতি সিজনেই ফড়িংয়ের নতুন নতুন মোটিফ আর নকশা নিয়ে কাজ করি। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই পোশাকটা যেন আরামদায়ক হয়। উই ওয়ান্ট পিপল টু এনজয় আওয়ার ক্লোদিং। ব্রাইডাল ওয়্যারের ক্ষেত্রেও আরামকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। আর বাজারে যা মিলছে, তা থেকে কিয়ারার পোশাক যেন আলাদা হয়, সে চেষ্টা আমাদের সব সময়ই থাকে। বাংলাদেশে আমাদের ডিজাইনিং তবে ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডিয়াবেসড। স্পেশালি মলমল শাড়ির। কারণ, ফ্যাব্রিকটা দেশে পাওয়া যায় না। ইন্ডিয়া থেকে সোর্স করে হ্যান্ডব্লক করে আনানো হয়। সেখান থেকে ডিজাইনিংয়ের বিশেষ কিছু কাজ আমরা ইন্ডিয়া থেকেই করিয়ে আনি। এ ছাড়া বাকি যে কাতান সিল্ক শাড়ি, ব্রাইডাল লেহেঙ্গা, অরগ্যাঞ্জা শাড়ি আছে, সেগুলোর ফ্যাব্রিক ইন্ডিয়া থেকে ইমপোর্ট করা। বাকি কাজটা বাংলাদেশেই হয়। কিয়ারার কারখানায় বর্তমানে ২৯ জন কারিগর কাজ করছেন। জুত্তিওয়ালার জুত্তিগুলোর ডিজাইন বাংলাদেশে বসে করা হলেও তৈরি হয় ইন্ডিয়ায়।
ক্যানভাস: পোশাক বা নাগরা ডিজাইনের ক্ষেত্রে কোন ঘরানা বা স্টাইলকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন আপনারা?
প্রীতি মোদি: পোশাক বা জুত্তি তৈরিতে আমাদের প্রথম প্রায়োরিটি থাকে, সেগুলোকে আরামদায়ক করে তোলা। সেই সঙ্গে ইউনিকনেসকে আমরা প্রাধান্য দিই। উই ক্যান কম্প্রোমাইজ উইদ দ্য ডিজাইন বাট উই ক্যান নট কম্প্রোমাইজ উইদ দ্য কমফোর্ট।
ক্যানভাস: টেকনিক্যাল ট্রেনিং, ট্রেন্ড সম্পর্কে নলেজ, নাকি ক্রিয়েটিভিটি— ডিজাইনিংয়ে কোনটা বেশি জরুরি।
প্রীতি মোদি: তিনটাই অনেক জরুরি, ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে একটা ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। সে সঙ্গে মার্কেটিংটাও জরুরি। ডিজাইনও ইউনিক হওয়া প্রয়োজন। কারণ, নকশা ভালো হলে সেটা এমনিতেও বিকোবে। কিন্তু নকশা যদি নজরকাড়া না হয়, তাহলে শুধু মার্কেটিংয়ে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে না। তাই মার্কেটিং আর ক্রিয়েটিভ ডিজাইনিংকে আমি বেশি প্রাধান্য দিই।
ক্যানভাস: দেশের অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় ডিজাইনার ফ্যাশন ব্র্যান্ড থেকে কিয়ারা কেন আলাদা?
প্রীতি মোদি: বাংলাদেশে অনেক জনপ্রিয় ডিজাইনার আছেন। রয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন হাউসও। প্রতিনিয়ত চমৎকার সব কাজ হচ্ছে, যেগুলো দেখে আমি মুগ্ধ। দারুণ সব কাতান, ঢাকাই শাড়ির জন্য বাংলাদেশে বহু বছর থেকেই প্রসিদ্ধ। আমি শাড়ির প্রতি ভীষণ দুর্বল, তাই এটা নিয়েই অন্যদের থেকে আলাদা কাজ করার চেষ্টা করেছি শুরু থেকেই। আমরা কটনের যে শাড়িটা তৈরি করি, তার ফ্যাব্রিক, প্রিন্টিং, ডিজাইন, প্যাটার্ন বাজারে অন্য কোথাও মিলবে না। সবাই জানেন, মলমল কটনের জন্য কিয়ারাই বেস্ট। ট্রেন্ডকে ফলো করা নয়, বরং ট্রেন্ড তৈরি করার চেষ্টা করে থাকি আমরা।
ক্যানভাস: ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে তিন বছরের এ পথচলায় কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে? ইতিবাচক সাড়া মিলেছে কেমন?
প্রীতি মোদি: প্রথম বছরটা আমার জন্য ভীষণ চ্যালেঞ্জিং ছিল। মনে হচ্ছিল, কিয়ারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু হাল ছাড়িনি, চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। তাই এক বছর পর থেকেই আমার কঠোর পরিশ্রমের ফল মিলতে শুরু করে। কিয়ারা আলাদা জায়গা করে নেয় ক্রেতাদের মাঝে। ফ্যাব্রিক ইমপোর্ট করা নিয়ে ভাবতে হয়েছে অনেক। আমার কালেকশন দেখে ক্রেতাদের থেকে কেমন সাড়া মিলবে, সেটা নিয়েও খুব চিন্তায় থাকতাম। প্রথম বছরের ভুলগুলো শুধরে মার্কেটিং আর ব্র্যান্ডিং নিয়ে কাজ করেছি প্রতিনিয়ত। অ্যাডভারটাইজিং আর মার্কেটিং নিয়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আর এখন কিয়ারার নতুন কালেকশনের জন্য ক্রেতারা অপেক্ষা করে থাকেন। এটাই আমার বড় প্রাপ্তি। জুত্তিওয়ালা নিয়ে আমার তেমন কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়নি। কিয়ারার প্ল্যাটফর্ম থেকে জুত্তিওয়ালা লঞ্চ করা হয়, তাই শুরুতেই ইতিবাচক সাড়া মিলেছিল।
ক্যানভাস: বর্তমান সোশাল মিডিয়া ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে কীভাবে প্রভাবিত করছে বলে মনে করেন?
প্রীতি মোদি: আমি বলব, কোভিডের কারণে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে মিডিয়ার প্রভাব অনেক বেড়েছে। তিন বছর আগে কিয়ারার পথচলা শুরু হয় অনলাইনে। কিন্তু তখন সোশ্যাল মিডিয়া এত স্ট্রং ছিল না। কোভিডকালীন বা তার পরবর্তী সময়ে ছোট কিংবা বড়— ফ্যাশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানেরই এখন ফেসবুক পেজ আছে, ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট আছে। আমার কাছে এটা ইতিবাচকই মনে হয়। ক্রেতাদের কাছে এখন অনেক অপশন, দাম যাচাই করে পছন্দমতো সবচেয়ে ভালো জিনিসটা তারা বেছে নিতে পারছেন। হোম ডেলিভারি সার্ভিস চালু হওয়ার ফলে দূরদূরান্তের পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে বাসায়। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিও সোশ্যাল মিডিয়ার সুফল পাচ্ছে। এখন শুধু এলাকা বা শহরে নয়, বিক্রেতারা দেশ এবং দেশের বাইরেও তাদের পণ্য উপস্থাপন করতে পারছেন। মার্কেট প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে, সো ইট ইজ বেনিফিশিয়াল টু দ্য কাস্টমারস অ্যান্ড টু দ্য ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অলসো।
ক্যানভাস: আপনার পছন্দের ডিজাইনার কারা? কোন ব্র্যান্ডের পোশাক করতে ভালোবাসেন?
প্রীতি মোদি: ট্র্যাডিশনাল বা এথনিক ওয়্যারের জন্য ডিজাইন করা পোশাকই সবচেয়ে বেশি পছন্দ। এর মধ্যে কিয়ারার সবুজ রঙের একটা জর্জেট গাউন আছে, যেটা আমার ফেবারিট। পুরোটাই চিকেনকারি ওয়ার্ক করা। সঙ্গে স্মার্ট সিল্কের প্যান্ট আর সিম্পল ওড়না। কিয়ারার বেস্ট সেলিং গাউন এটা।
ক্যানভাস: কিয়ারাকে নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
প্রীতি মোদি: দেশীয় মার্কেটে কিয়ারা যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটেও শক্তিশালী জায়গা করে নেবে, সেখানেও ক্রেতারা কিয়ারাকে পছন্দ করবে সেটাই স্বপ্ন। দুবাই ও যুক্তরাজ্যে আমাদের ক্লায়েন্ট আছে। কিন্তু ফেডএক্স দিয়ে পণ্য পাঠিয়ে নয়, আমরা চাই সেখানে কিয়ারার নিজস্ব ডেসপাচ সেন্টার থাকবে। সেই লক্ষ্য পূরণেই প্রতিনিয়ত কাজ করছে কিয়ারা।

শ্রুতলিখন: জাহেরা শিরীন
ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top