skip to Main Content

ফিচার I কফি পিপলের কফি বিস্তার

শুরু রাজধানীই নয়, এর বাইরেও নানা স্তরে কফি পানের অভ্যাস ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে কফি পিপল। তাদের পথচলার গল্প লিখেছেন আল মারুফ রাসেল

একটা সময় ছিল, যখন ঢাকা শহরে খাঁটি কফি বিনস দিয়ে তৈরি করা কফি পাওয়া যেত হাতে গোনা কিছু দোকানে। ২০০৫ সালের আগে তো এর অস্তিত্বই ছিল না। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা আর খানিকটা বিশ্বায়নের প্রভাবে দেশে কফির সমঝদার তৈরি হয়েছে অনেক, বেড়েছে কফিশপ। আর কফির এই অগ্রযাত্রার নেপথ্যে থাকা কুশীলবদের মধ্যে অন্যতম কফি পিপল।
বাংলাদেশে অথেনটিক বিনস দিয়ে তৈরি করা কফি বিকোয়, এমন কফিশপের যাত্রা শুরুর গল্পটা খুব একটা মসৃণ ছিল না। প্রথম সমস্যাটি ছিল দেশের বাইরে থেকে কফি মেশিন আনা নিয়ে। সব ঝামেলা মিটিয়ে দেশে একটা মেশিন আনতে খরচের ধাক্কা যেমন ছিল, তেমনি ছিল দীর্ঘ চার-পাঁচ মাস অপেক্ষার পালা। আর ছিল কফি মেশিনের কারিগরি দিক সম্পর্কে জানা লোকের অভাব। এই সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসে কফি পিপল।
কফি পিপলের যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালে, আতিক আর অশোকার হাত ধরে। আগের আমদানিকারকদের সমস্যার জায়গাটা ধরে প্রযুক্তিগত জ্ঞানের জায়গায় সবার আগে শাণিয়ে নেয় নিজেদের। কারণ, দামি সব কফি মেশিন দেশে আনার পর হুট করে কারিগরি জটিলতা দেখা দিলে তা ঠিক করার লোক ছিল না দেশে। অর্থাৎ আগেকার আমদানিকারকেরা বিক্রয়োত্তর সেবার ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহী ছিলেন না। জ্ঞানের অভাব যেমন ছিল, তেমনি ছিল সদিচ্ছার ঘাটতিও।
কফি পিপল প্রথমেই দুবাই, সিঙ্গাপুর, মিলান ইত্যাদি সব কফি এক্সপোতে গিয়ে লিডিং ব্র্যান্ড খুঁজে বের করে। এভাবেই সানরেমোর বাংলায় আগমন। অবশ্য সানরেমো শুরুতেই শর্ত জুড়ে দেয়—বাংলাদেশে তাদের ফুল ইকুইপড সার্ভিস সেন্টার খুললেই কেবল তারা গ্রিন সিগন্যাল দেবে, নয়তো বাদ। কারণ, সানরেমোর একটা কফি মেশিন যদি দু-তিন দিন কারিগরি ত্রুটির জন্য পড়ে থাকে, সেটা যেমন ক্যাফের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি সানরেমোর সুনামের জন্যও। সে কারণে কফি পিপল প্রথমে তাদের ইঞ্জিনিয়ারদের দেশের বাইরে পাঠিয়েছে ট্রেনিং নিতে; এরপর ইতালি থেকে ট্রেইনার এনেছে বাংলাদেশে—এখানে ট্রেনিং দেওয়ার জন্য। এভাবেই সানরেমো বাংলাদেশে আসে।
কফি পিপল শুরু থেকেই কফি মেশিনের কিছু মজুত রেখেছে হাতে—যেন কোনো গ্রাহক চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে একটা মেশিন নিতে পারেন। ফলে সময় ও ডলারের মূল্যমানের ওঠানামা দেশীয় ক্রেতাদের খুব একটা প্রভাবিত করতে পারে না। এতে বাংলাদেশের বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল চেইন, তারকা হোটেলগুলোয় সানরেমো জায়গা করে নিয়েছে।
এর পাঁচ বছর পর পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিমিয়াম কফি মেশিন ব্র্যান্ড লা চিম্বালি আসে বাংলাদেশে। এই ব্র্যান্ডের মেশিন আন্তর্জাতিক বাজারে এতটাই জনপ্রিয় যে কফি পিপল লা চিম্বালি বাজারে আনার পরপরই ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো এই ব্র্যান্ডের খোঁজ করতে থাকে। মোটামুটি ঝামেলাবিহীন এই ব্র্যান্ড বাংলাদেশে আসার পর থেকে কফি মার্কেট বেশ গ্রোও করে। ২০১৫ সালেই কফি পিপল বাংলাদেশের বাজারে আনে নিজস্ব কফি ব্র্যান্ড প্যারামাউন্ট। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে বাছাই করা কফি বিনস ইতালিতে তিন প্রজন্ম ধরে কফি রোস্ট করা পরিবারের হাত ঘুরে আসে এ দেশে। দেশি কফি ব্র্যান্ড বাংলাদেশকে বিশ্ব কফি মানচিত্রে তুলে ধরার জন্যই। আতিকের সোজাসাপ্টা স্বীকারোক্তি, ‘আমাদের যদি সক্ষমতা থাকত নিজেদের দেশে একটা কফি মেশিন তৈরির প্ল্যান্ট তৈরি করতাম। আপাতত রেস্ত নেই বলে সেটা ভবিষ্যতের জন্য তোলা রয়েছে।’
কেবল তা-ই নয়, বারিস্তাদের নিয়েও এর আগে সেভাবে কাজ হয়নি। কফি পিপল প্রথম ২০১৮ সালে বাংলাদেশে বারিস্তা চ্যাম্পিয়নশিপের আয়োজন করে। তারা মোটিভেটেড হয়ে যেন ওয়ার্ল্ড ক্লাস বারিস্তার মতো আমাদের এখানকার কফি সিনারিওকে বদলে দেয়, এই লক্ষ্য নিয়ে। বাংলাদেশ বারিস্তা অ্যাসোসিয়েশন তৈরির কৃতিত্বও তাদের, মোট সাড়ে তিন হাজার বারিস্তা এই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। অনেক নারী বারিস্তাও রয়েছেন এখন এর সদস্য হিসেবে।
কেবল কফি মেশিন, কফি বিনস আর বারিস্তাদের ভেতর আটকে নেই কফি পিপলের কার্যক্রম। ক্যাফের মালিকদের সহযোগিতা করতেও তারা এগিয়ে এসেছে দায়িত্ব নিয়ে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কফি ফেস্ট আয়োজন করেছে তারা, যেখানে হাতেকলমে নানা ধরনের কফি চেখে দেখানো হয়েছে। ফলে তৈরি হয়েছে নতুন কফিপ্রেমী। সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় কফি ফেস্ট করা হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় কফি ফেস্ট করার পর দেখা গেছে, ওই এলাকাগুলোয় ২০-৩০ শতাংশ ‘কফিখোর’-এর সৃষ্টি হয়েছে।
অনেকে মনে করেন, এই কফি বা ক্যাফে কালচার ঢাকাকেন্দ্রিক। এই ধারণা যে ভ্রান্ত, তার প্রমাণ মিলেছে ঢাকার বাইরের কফি ফেস্টগুলোর সময়ে সাড়া দেখে। টেকনাফ, পাবনা, বরিশালের মতো জায়গায়ও কফি পিপল মেশিন ও কফি বিনস সরবরাহ করছে। ঢাকার বাইরে কফি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তাদের চেষ্টা প্রশংসার দাবিদার। এখন কফি পিপলের কাজ চলছে করপোরেট অফিস নিয়ে, সেখানে কফি কীভাবে কর্মীদের আরও উদ্যমী করে কর্মক্ষম করে তোলে, আর কাজে মনোযোগী করে রাখে, সে ব্যাপারটা নিয়ে। ইতিমধ্যে অন্যান্য বহুজাতিক সংস্থা, দূতাবাস তাদের থেকে সেবা নিচ্ছে।
প্রায় এক যুগের দ্বারপ্রান্তে এখন কফি পিপল। এই অগ্রযাত্রায় সঙ্গী হয়েছে নর্থ এন্ড থেকে শুরু করে ক্রিমসন কাপ, আমেরিকান অ্যাম্বাসি, জিআইজেডসহ আরও নানা ক্যাফে, পাঁচ তারকা হোটেল, বহুজাতিক সংস্থা, দূতাবাস, করপোরেট হাউস। তারা মনে করে, একটা দেশে কফিশপের সংখ্যা বাড়ার অর্থ সেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি। কারণ, একটা কফিশপের মাধ্যমে যে আর্থিক লেনদেন হয়, তার প্রভাব সমাজের উঁচু স্তর থেকে একদম নিচু স্তর পর্যন্ত সরাসরি প্রভাব পড়ে। সরকার এদিকে সরাসরি দৃষ্টি দিলে কফি ইন্ডাস্ট্রি আরও ভালো জায়গায় পৌঁছাতে পারবে।

ছবি: কফি পিপল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top