skip to Main Content

ফিচার I পদে পৃথক

আমাদের দেশ ও এর আশপাশের অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাসে রয়েছে বেশ কিছু ফারাক। ভারত ও বাংলাদেশ আলাদা হওয়ার আগে থেকেই। প্রধান খাবার থেকে শুরু করে মসলাদির ব্যবহারেও পার্থক্য দেখা যায়। অবশ্য যুগসন্ধিকালে ওসব বিভেদ অনেকটাই ঘুচে গেছে। কাছাকাছি অঞ্চলগুলোর খাদ্যাভ্যাসের পার্থক্য নিয়ে লিখেছেন শিবলী আহমেদ

বহুমাত্রিক সংস্কৃতির অঞ্চল হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশের তুলনা মেলা ভার। এখানে এক সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য সংস্কৃতির বিভেদই শুধু ঘটেনি, উল্টোটাই হয়েছে। পারস্পরিক আদান-প্রদানে দিনে দিনে নানা বাঁক বদল ঘটেছে এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক কারণে একসময়ের অখন্ড ব্রিটিশ-ভারত ভেঙে এখন তিন দেশ। সেগুলোর মধ্যে নতুনতম দেশ বাংলাদেশের বয়স পঞ্চাশ বছর। বিবর্তনের জন্য সময়টি খুবই কম। ফলে এই অঞ্চলে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত কোনো সংস্কৃতির ফিরিস্তি দিতে গেলে অখন্ড ভারতের ইতিহাসে দৃষ্টিপাতের প্রয়োজন পড়ে; এমনকি খাদ্যবৈচিত্র্যের বর্ণনা দিতেও। রন্ধনপ্রক্রিয়া ও তেলের ব্যবহারের পার্থক্য আছে।
বৈচিত্র্যগুলো অঞ্চলগত। এসব ফারাকের সংক্ষিপ্ত বয়ান মেলে ড. অতুল সুরের লেখা ‘ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ বইয়ের একটি অধ্যায়ে। তা ছাড়া নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদি পর্ব’ বইসহ আরও কিছু সূত্র থেকে মেলে তথ্য-উপাত্ত।
অতুল সুর তার লেখনীতে ১০০ বছর আগেকার ভারতবর্ষের খাদ্যবিভেদ তুলে ধরেছেন। এই যুগসন্ধিকালে সেই ফারাক ক্ষয়িষ্ণু হওয়াটাই স্বাভাবিক। যাহোক, অতুল সুরের বয়ানে চাল, গম, যব, বজরা, রাগি ও ভুট্টা—এসব তন্ডুলজাতীয় ফসলই ভারতবর্ষের মানুষের প্রধান খাদ্য। একেক অঞ্চলে উল্লিখিত একেকটি শস্যকে প্রধান খাবার হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন বাংলা, বিহার, আসাম ও ওডিশার উপকূল অঞ্চলের মূল ফসল ধান। ফলে এসব অঞ্চলের প্রধান খাবার ভাত। অঞ্চলভেদে তা রান্নার প্রক্রিয়ায় পার্থক্য রয়েছে। বিহার ও ওডিশার আদিবাসীরা ভাতের মাড় ফেলেন না, কিন্তু বাঙালিরা মূলত তা ফেলে খান। ওডিশার লোকেদের মধ্যে পান্তাভাতের চল বেশি থাকলেও বাঙালিরা গরম ভাতেই আগ্রহী।
উত্তর ভারতের প্রধান খাদ্য গম। শস্যটির চূর্ণতে পানি যোগ করে রুটি সেঁকে খান সেই অঞ্চলের লোকেরা। অন্যদিকে প্রাচ্য ভারতের বাসিন্দাদের দেখা যায় আটা সেদ্ধ করে রুটি বানাতে। রন্ধনপদ্ধতির আরও কিছু পার্থক্য মেলে এসব ভূখন্ডের রসুইঘরে। প্রাচ্য ভারতের লোকেরা রান্নায় মূলত শর্ষের তেল ব্যবহার করেন, অন্যদিকে উত্তর ভারতে ঘিয়ের ব্যবহার বেশি। পশ্চিম ভারতে আবার শর্ষেও নয়, ঘিও নয়; তারা রাঁধেন তিলের তেল দিয়ে। দক্ষিণ ভারতে চলে নারকেল তেল।
এসব তেল ভাঙানোর ঘানিতেও অঞ্চলভেদে পার্থক্য দেখা যায়। কোলজাতির লোকেরা দুই খন্ড কাঠের পাটার মধ্যে বীজ পিষে তেল নিষ্কাশন করেন। এ ধরনের ঘানি পরিচালনায় তারা বলদের বদলে নিজেরাই টানেন। ওডিশার উত্তর ভাগে আবার তিন ধরনের ঘানি দেখা যায়: দুটি বলদ দিয়ে টানা নালি ছাড়া একখন্ড কাঠের ঘানি, একটি বলদ দিয়ে টানা নালিযুক্ত একখন্ড কাঠের ঘানি এবং এক বলদ দিয়ে টানা নালিযুক্ত দুই খন্ড কাঠের তৈরি পিঁড়িবিশিষ্ট ঘানি। বিভিন্ন স্থানের কলু জাতির মধ্যে এসব ঘানির পার্থক্য দেখা গেছে। তারা যেখানেই গেছেন, সেখানেই তাদের তেল ভাঙানোর রীতি নিয়ে হাজির হয়েছেন। অধ্যাপক নির্মলকুমার বসুর মতে, কিছু কলু জাতি ওডিশার, কেউ বিহারের, আবার কেউ বাংলাদেশি।
ব্যঞ্জন রান্নার সংখ্যায়ও পার্থক্য রয়েছে। এই অঞ্চলের ভাষাগোষ্ঠীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধরনের পদ রান্না করতে পারে বাঙালিরা। বলা হয়, এই ভাষী মেয়েরা ৬৪ ধরনের পদের রান্না জানেন। তাতে মসলাদির ব্যবহারেও পার্থক্য মেলে। ভারতের বেশ কিছু অঞ্চলে রান্নার আগে মসলা ভুনা করে নেওয়ার চল রয়েছে। তবে আসামে এই পদ্ধতি এড়িয়ে চলা হয়। পশ্চিমবঙ্গের সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালিদের রান্না মূলত ফোড়নসমৃদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশে দেওয়া হয় বাগার। এ দুটি পুরোপুরি এক নয়। বাংলাদেশিরা রান্নার শেষে বাগার দেন। সেই উদ্দেশ্যে আগেই আলাদা করে তেলের ওপর পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, হলুদযোগে মিশ্রণ তৈরি করে রাখতে হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ফোড়নে তেলের ওপর প্রথমে ‘ছক’ দেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশি বাঙালিদের রসনার আরেকটি পার্থক্য রয়েছে হিং-এর ব্যবহারে। অবাঙালিদের কাছ থেকে এই উপাদানের চল বাঙালিদের কাছে এসেছে বলে ধারণা করা হয়।
মাছ খাওয়াতেও প্রভেদ রয়েছে। বাংলা ও প্রাচ্য ভারতের কিছু প্রদেশের লোকেরা মাছ খান। উত্তর ভারতের লোকেরা তা এড়িয়ে চলেন। তাদের বেশির ভাগই নিরামিষাশী। এ ধরনের খাদ্যকে সুষম করতে ওই অঞ্চলের লোকেরা ব্যঞ্জনে বেশি ঘি ব্যবহার করেন। বিহার ও উত্তর প্রদেশের পূর্বাংশের কিছু বাসিন্দা রান্না করা খাদ্যের পরিবর্তে ছাতু খান। সেটি মূলত ছোলা বা যবের গুঁড়া। এ তাদের প্রধান খাবার। কোথাও কোথাও আবার চিড়া দিয়ে দই প্রধান খাদ্য।
অঞ্চলভেদে ডাল খাওয়ায় পার্থক্য মেলে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ডাল রান্নার ধরন আলাদা। কলকাতায় মটর ডালের চল; যা বাংলাদেশে খুব একটা প্রচলিত নয়। আবার কয়েকজন রন্ধনশিল্পীর মতে, এ দেশের ডাল চর্চরি সম্পর্কে কলকাতার বাসিন্দারা জানেনই না! তারা কেবল ঘন কিংবা পাতলা করে তা রেঁধে খান।
মিষ্টান্ন তৈরিতেও পার্থক্য মেলে। উত্তর ভারতের মিষ্টিগুলো তৈরি হয় ক্ষীর দিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশে তা তৈরিতে বেশি ব্যবহৃত হয় ছানা। একটা সময় ক্ষীরের পেঁড়া ও লাড্ডু ছিল উত্তর ভারতের উৎকৃষ্ট মিষ্টি। তা ছাড়া ঘিয়ে ভাজা কিছু নোনতা খাবার, শিঙাড়া, নিমকি, কচুরি, জিলাপি, আমৃতি, বালুসাই, মুগের লাড্ডু—এসব খাদ্যকে উত্তর ভারতের অবদান হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলার অবদান রয়েছে রসে সেদ্ধ রসগোল্লা ও রসমালাইয়ে। ধারণা করা হয়, নারকেলযোগে মিষ্টান্ন তৈরির অবদান বাঙালিরই। আবার দক্ষিণ ভারতের লোকেরা যে ‘ইডলি’ তৈরি করেন, উত্তর ভারতের লোকেরা তা তৈরি করতে জানতেন না।
খানাখাদ্যের এমন বৈচিত্র্যের জন্য ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ু তো বটেই, বিভিন্ন রাজরাজড়ার শাসন এবং ধর্মীয় অনুশাসনও ভূমিকা রেখেছে। যেমন আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপবাসীর খাবারে রয়েছে সামুদ্রিক প্রাণীর আধিক্য। তাদের অনেকেই শিকার-সংগ্রহের মাধ্যমে খাদ্য জোগাড় করেন। সেখানকার বাসিন্দাদের খাদ্যাভ্যাস তৈরিতে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে ভূগোল। অবশ্য এখন মূল ভূখন্ডের মানুষের আনাগোনাতে ওই অঞ্চলের মেনুতে বদল এসেছে। গোয়ায় গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ু থাকায় সেই অঞ্চলের রান্নায় মসলার আধিক্য থাকে। স্বাদও তীব্র। তবে অতীতে সেখানে পর্তুগিজ উপনিবেশ থাকায় সেই দেশের খানাখাদ্যেও রয়ে গেছে প্রভাব।
ওপরে বর্তমানকে বলা হয়েছে যুগসন্ধিকাল। অ্যানালগ উতরে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে প্রবেশের কারণে এই সময়কে তা বলা হয়েছে। যান্ত্রিক উৎকর্ষে মানুষ খুব অল্প সময়েই অনেক তথ্য পেয়ে যাচ্ছে। ফলে রেসিপির আদান-প্রদান হচ্ছে প্রায় প্রতি বেলাতেই। একবার স্বাদে মজে গেলে সেই পদ চর্চিত হচ্ছে নিত্য। ফলে ‘এটা ওদের খাবার, ওটা আমাদের’—এমন বিভেদ প্রায় ঘুচেই যাচ্ছে।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top