কভারস্টোরি I চন্দ্রচয়ন
‘দ্য মুন লিভস ইন দ্য লাইনিং অব ইয়োর স্কিন’—বিশ শতকের নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক পাবলো নেরুদার কবিতার বিখ্যাত এই লাইন থেকেই যেন মিলে যায় চাঁদ আর সৌন্দর্যের যোগসূত্র। বাংলা সাহিত্যও কম যায় না। চাঁদ নিয়ে যত গান, কবিতা, বিবরণ, তুলনা কিংবা বাগধারা প্রচলিত, সেগুলোর বেশির ভাগই সৌন্দর্যের সমীকরণ বোঝাতে সচেষ্ট। যার পুরোটাই আবেগনির্ভর, কল্পনানির্মিত। চাঁদ বহু বছর ধরে উপমা হিসেবেই প্রচলিত। তবে ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটার দূরে থাকা এই উপগ্রহের পৃথিবীর মানুষের সৌন্দর্যের ওপর আসলেই কোনো প্রভাব রয়েছে কি না, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের আগ্রহ ছিল বরাবরই। জোর প্রমাণ মিলেছে সম্প্রতি। লিখেছেন জাহেরা শিরীন
পূর্ণিমা-অমাবস্যায় চাঁদ যে নদী-সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা নিয়ন্ত্রণ করে, তা অনেকেরই জানা। তবে মজার ব্যাপার হলো, মানবদেহ যেহেতু ৬০ শতাংশ পানিতে গড়া, সে ক্ষেত্রে চাঁদের প্রভাব পড়ে শরীরেও। প্রভাবিত হয় মানবমনও। শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক এ প্রভাব সরাসরি প্রভাবিত করে সৌন্দর্যকে। এ ছাড়া লুনার সাইকেল বা চন্দ্রচক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষের আচরণগত পরিবর্তন আর মেজাজ-মর্জির হেরফেরের প্রমাণ মিলেছে বহু বছর আগেই। এর ওপর নির্ভর করেও রূপরুটিন পাল্টে যায় অনেকের। সৌন্দর্যও প্রভাবিত হয়।
পূর্ণ চন্দ্রচক্রে মোট আটটি পর্যায় রয়েছে। প্রথম চারটি পর্যায় অর্থাৎ ওয়াক্সিং ফেজে দেহ-মন কসমিকালি রিচার্জড থাকে। ফলাফল উত্তেজনা আর আত্মবিশ্বাসে ভরপুর থাকে মন। তাই সৌন্দর্য নিয়ে নতুন নিরীক্ষার জন্য এ দারুণ সময়। পরবর্তী চারটি পর্যায় বা ওয়েনিং ফেইজ ঢিমেতালে চলার সময়। দেহ-মনকে বিশ্রামে রেখে পরিপূর্ণ পুষ্টি জুগিয়ে পরবর্তী চন্দ্রচক্রের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য উপযুক্ত। এ সময় ত্বক ও চুলের যত্নও হওয়া চাই সেটা মেনেই। তাই বলা যায়, চন্দ্রচক্রের ২৯.৫ দিনে ত্বক উজ্জ্বলতা সঞ্চার করে, দূষণ করে দূর। পুনরুজ্জীবিত হয় পর্যায়ক্রমে। তাই এর ওপর ভিত্তি করে রূপচর্চাও হওয়া চাই অনন্য উপায়ে। কসমিকালি চার্জড সৌন্দর্যের জন্য সাম্প্রতিক সময়ে তাই জোর চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে লুনার বিউটি কেয়ার। প্রকৃতপ্রাণিত সৌন্দর্যপ্রেমীদের মাঝে এর কদর বাড়ছে দিন দিন।
নিউ মুন
নো মুন বা ডার্ক মুন। খাঁটি বাংলায় অমাবস্যা। আকাশে চাঁদের টিকিটাও মেলে না এ সময়। অনেকেই অন্ধকারাচ্ছন্ন এ সময়কে মন্দ বা নেতিবাচকতার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেন। কিন্তু চন্দ্রচক্রের হিসেবে নিউ মুন ফেইজ এটি। খালি ক্যানভাসের মতো। রহস্যে ঘেরা বটে। কিন্তু পরিবর্তন, নবীকরণ আর পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠার এ দারুণ সময়। চন্দ্রচক্রের সূত্রপাত এখান থেকেই। ফলে নতুন কিছু শুরুর মোক্ষম সময়। তা হতে পারে সৌন্দর্যচর্চার নতুন অভ্যাস তৈরির ক্ষেত্রেও। এত দিন যাদের অভ্যাস ছিল মুখভর্তি মেকআপ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার, সেটা পরিবর্তনের পরিকল্পনা থাকলে নিউ মুন ফেইজ উপযুক্ত সময়। নিউ মুনকে তুলনা করা হয় কসমিক রিবার্থের সঙ্গে। ফলে প্রাকৃতিকভাবেই উদ্দীপনায় ভরপুর থাকে দেহ-মন। এই কসমিক কনফিডেন্সকে যদি সৌন্দর্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া যায়, তার ইতিবাচক প্রভাব ফুটে ওঠে ত্বকে। তাই ভিটামিনে ভরপুর এবং শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্টযুক্ত সৌন্দর্যপণ্য ব্যবহার করা যেতে পারে এ সময়।
নিউ মুন বিউটি রুটিনের শুরুটা হওয়া চাই ডিপ নারিশমেন্ট দিয়ে। ত্বক পরিষ্কার করে নেওয়া চাই প্রথমেই। অ্যাকটিভেটেড চারকোলযুক্ত ক্লিনজার ব্যবহার করা যায় এ সময়, গভীর থেকে ধুলা-ময়লা তুলে আনার জন্য। অয়েল ক্লিনজারও ব্যবহারোপযোগী। নিম বা ভেটিভার দিয়ে তৈরি পিউরিফায়িং, নারিশিং অয়েল ক্লিনজার সবচেয়ে উপযোগী। তারপর ব্যবহার করতে হবে ফেস মিস্ট—রোজ পেটাল, ল্যাভেন্ডার অথবা তুলসীতে তৈরি। আলতো করে বুলিয়ে নিতে হবে ত্বকে। স্প্রে করে নিলেও চলবে। তারপর ময়শ্চারাইজেশনের পালা। শিয়া বাটার এ ক্ষেত্রে চমৎকার। প্রয়োজনীয় পরিমাণে হাতে নিয়ে গলিয়ে নিতে হবে প্রথমে। তারপর মুখ আর গলায় মেখে নিতে হবে আলতো হাতে। সার্কুলার মোশনে। এরপর কিছুক্ষণের বিশ্রাম। পছন্দসই ফ্লেভারের চা পান করার জন্য মোক্ষম সময় কিন্তু। তারপর পালা শিয়া স্টিমের। একটা ছোট ওয়াশ ক্লথ বা রুমাল ঈষদুষ্ণ পানিতে ডুবিয়ে নিংড়ে নিতে হবে। তারপর সেটা ছড়িয়ে দিতে হবে মুখে। আস্তে আস্তে রুমাল চেপে বসিয়ে দিতে হবে গাল, কপাল আর চিবুকে। এতে ত্বক শিয়া বাটার পুরোপুরি শুষে নেবে। নরম পেলব হয়ে উঠবে নিমেষেই। তারপর আবার ফেস মিস্ট স্প্রে করে নিতে হবে ত্বকে। প্রয়োজনে আরও শিয়া বাটার মেখে নেওয়া যাবে।
দেহত্বকের জন্যও বিশেষ পরিচর্যা সেরে নেওয়া যায় এ সময়। সে ক্ষেত্রে মুখত্বকে শিয়া বাটার মেখে গোসলের প্রস্তুতি সেরে নেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে বাথটাব থাকলে ভালো। গোসলের উষ্ণ পানিতে ডেড সি, হিমালয়ান বা ম্যাগনেশিয়াম বাথ সল্ট মিশিয়ে নিতে হবে। তবে এর বদলে নেটেল, ল্যাভেন্ডার, রোজ পেটাল আর লেমন বামের মতো ভেষজ চায়ের মিশ্রণও চমৎকার। তারপর বাতি নিভিয়ে দিতে হবে। এমনকি মোমবাতিও জ্বালানো যাবে না। অন্ধকারের মধ্যেই বাথটাবের পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে শরীর—নিউ মুন ফেইজ উদযাপনের জন্য। এ সময় পানির তাপেই মুখত্বকের শিয়া বাটার গভীরে পুষ্টি জোগাবে। অথবা গোসলের পানিতেই রুমাল ভিজিয়ে তা নিংড়ে নিয়ে ছড়িয়ে দিতে মুখত্বকে। এতে শিয়া বাটার ত্বকের গভীরে প্রবেশ করবে। বাথটাব থেকে উঠে টাওয়েল ড্রাই করা স্যাঁতসেঁতে ত্বকে মেখে নিতে হবে বডি অয়েল। ব্যস!
এ ছাড়া ত্বক পরিচর্যায় ব্যবহার করা যেতে পারে স্কিন স্মুদেনিং ক্লে মাস্ক। তিন থেকে চার টেবিল চামচ তরল দুধে মিশিয়ে নিতে হবে দুই টেবিল চামচ মুলতানি বা কেওলিন ক্লে, ১ টেবিল চামচ ওটস, ১ চা-চামচ মধু আর দুফোঁটা এসেনশিয়াল অয়েল মিশিয়ে মসৃণ পেস্ট তৈরি করে নিতে হবে। চোখ বাদে পুরো মুখত্বকে মেখে নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে পনেরো মিনিট। তারপর পানি দিয়ে ম্যাসাজ করে ধুয়ে নিতে হবে প্যাক। দুধ মৃতকোষ সারাইয়ে সাহায্য করবে। ক্লে গভীর থেকে পরিষ্কার করবে ত্বক। মধু জোগাবে মসৃণতা। চন্দ্রচক্রের নিউ মুন ফেইজে নিয়মিত এ চর্চাগুলোই ত্বক সুন্দর রাখতে যথেষ্ট।
ওয়াক্সিং ক্রিসেন্ট
নতুন লুনার সাইকেল শুরু হয় এই পর্যায়ে। একফালি চাঁদ দেখা যায় আকাশে। নিউ মুন ফেইজের কিছুটা প্রভাব থেকে যায় ওয়াক্সিং ক্রিসেন্টেও। ত্বকের উজ্জীবনী শক্তি থাকে তুঙ্গে। তাই এমন সৌন্দর্যপণ্য ব্যবহার করতে হবে, যা ত্বকে শক্তি জোগাবে। গোলাপজল স্প্রে এ ক্ষেত্রে দারুণ কার্যকর। সজীবতারও জোগান দেবে এটি। ক্যাফেইনযুক্ত আইক্রিম ব্যবহার করা যায় এই পর্যায়ে। চোখের চারপাশের ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়বে এতে। পূর্ণ চন্দ্র সৃষ্টির একদম শুরুর ধাপ এটি। এ সময় ত্বকের দরকার উপর্যুপরি এক্সফোলিয়েশন। ঘরে তৈরি এক্সফোলিয়েটর দিয়ে ত্বকের মৃতকোষ দূর করার এ উপযুক্ত সময়। চন্দ্রচক্রের এই পর্যায়ে প্রাকৃতিকভাবেই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। কমে যায় তুলনামূলকভাবে। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে ত্বক ফ্যাকাশে দেখায়। তাই ভিটামিন ডি এবং ম্যাগনেশিয়াম যুক্ত সৌন্দর্যপণ্য ব্যবহার করা চাই বেশি করে। ত্বক পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়ক এ উপাদান দুটি।
এই লুনার ফেইজে টোনিং ট্রিটমেন্টগুলো সবচেয়ে ভালো কাজ করে। ব্রাইটেনিং ফেস মাস্কও হয়ে ওঠে অধিক কার্যকর। খুব সহজে বাসায় বসেই তৈরি করে নেওয়া যায় এটি। ২ টেবিল চামচ বেসনের সঙ্গে ২ থেকে ৩ টেবিল চামচ দুধ, ১ চা-চামচ হলুদ আর কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে নিতে হবে। তাতে পরিমাণমতো পানি মিশিয়ে নিলেই তৈরি ব্রাইটেনিং মাস্ক। এ শুধু মুখত্বকেই নয়, দেহত্বকেও ব্যবহার উপযোগী। প্যাক মেখে শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তারপর ঘষে ঘষে উঠিয়ে ফেলতে হবে। সবশেষে পরিষ্কার ঠান্ডা পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে ত্বক।
ফার্স্ট কোয়ার্টার মুন
একে হাফ মুন ফেইজও বলা যায়। এ সময় আধখানা চাঁদ আলো করে রাখে আকাশ। পরবর্তী পর্যায়গুলোতে পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠার প্রস্তুতি সারার এটি মোক্ষম সময়। আগের ফেইজগুলোতে ক্লিনজিং ও এক্সফোলিয়েটিং সেরে নেওয়া হয় বলে এ সময় ত্বক আর্দ্র করে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে সহজ ও কার্যকর উপায়? একটা ওয়াশক্লথ বা রুমাল উষ্ণ পানিতে ভিজিয়ে নিংড়ে নিয়ে মুখত্বকে ছড়িয়ে রেখে দিতে হবে। কিছুক্ষণ রেখে দেওয়ার পর কাপড় সরিয়ে প্রাকৃতিক বাতাসেই শুকিয়ে নিতে হবে ত্বক। তারপর একটা ভারী ফেশিয়াল ময়শ্চারাইজার মেখে নিতে হবে। আগে থেকে ক্লিনজিং ও এক্সফোলিয়েশন সেরে রাখার ফলে এ সময় ত্বকে পুষ্টি সহজেই প্রবেশ করতে পারে। তাই খানিকটা বাড়তি যত্নেই মেলে কাঙ্ক্ষিত ত্বক।
সকালটা শুরু হতে পারে রোজ কোয়ার্টজ রোলারের ব্যবহার দিয়ে। তারপর একটা মর্নিং মাস্ক। ব্যস! দিনের রূপচর্চার জন্য যথেষ্ট। ত্বকের এনার্জি লেভেল ঠিক রাখার জন্য রেড অ্যালগি এবং হায়ালুরনিক অ্যাসিডের মতো উপাদান ব্যবহার করতে হবে এ সময়। এগুলো টান টান রাখবে ত্বক, দেবে বাড়তি উজ্জ্বলতা। আর দিনভর ফ্রি র্যাডিক্যালের হাত থেকে করবে রক্ষা।
ওয়াক্সিং গিবাস ফেইজ
পূর্ণ চন্দ্র হওয়ার একদম আগের স্টেজ এটি। সাধারণত সব ধরনের নেতিবাচকতা ঝেড়ে ফেলে দেওয়ার মোক্ষম সময়। ত্বকের জন্যও ঠিক তাই। ডিটক্সিফায়িং বা দূষণ দূর করতে হবে ত্বক থেকে। পুরোটা সময় ধরে ত্বকে যে ধুলা দূষণ যোগ হয়েছে, তা ঝেড়ে ফেলার সময় এটি। ফেস ব্রাশ এ ক্ষেত্রে দারুণ কার্যকর। ত্বক ম্যাসাজ করার পাশাপাশি ত্বকের গভীরে জমে থাকা দূষণ দূর করতে সাহায্য করবে। চন্দ্রচক্র অনুসারে এ সময় ত্বকের শোষণক্ষমতা সবচেয়ে বেশি থাকে। তাই ময়শ্চারাইজার ব্যবহারে এর পূর্ণ কার্যকারিতা মেলে। এ সময় রূপরুটিন নিয়ে আবার ব্রেইনস্ট্রম করাই যায়। খানিকটা অদলবদলের জন্য। দেহের জন্য বডি অয়েল ব্যবহারের ভালো সময় এটা। বিশেষ করে শুষ্ক ও বুড়িয়ে যাওয়া ত্বকের জন্য।
বাসায় বসেই তৈরি করে নেওয়া যায় এটি। একটা গ্লাস জার নিয়ে তাতে অর্ধেকটা আর্নিকা ব্লসম তেল আর বাকি অর্ধেকটা ভার্জিন অলিভ অয়েল পুরে নিতে হবে। তেলের এই মিশ্রণ রোদে রাখতে হবে একটা পূর্ণ চন্দ্রচক্র, অর্থাৎ পুরো ২৯ দিন। মাঝে কয়েকবার গ্লাসের জারটা ঝাঁকিয়ে নিতে হবে। প্রায় এক মাস পর তেলটা ছেঁকে নিয়ে পুরে রাখতে হবে গাঢ় রঙা গ্লাসের বোতলে। খেয়াল রাখতে হবে, তারপর এ তেল যেন সরাসরি সূর্যের আলোতে না আসে। গোসলের পানিতে নিয়মিত বিশ ফোঁটা করে ব্যবহারে মিলবে চমৎকার ফল। ম্যাসাজ অয়েল হিসেবেও দারুণ।
ফুল মুন
চন্দ্রচক্রের চূড়ান্ত পর্যায় এটি। এ সময় প্রাকৃতিকভাবেই ইতিবাচক প্রভাব থাকে মনে। ফলে মন থাকে উদ্যমী, থাকে সক্রিয়। সেই সঙ্গে শরীরকে বিশ্রাম ও আরাম দেওয়ার জন্যও এ এক দারুণ সময়। তাই ত্বককে ফুল মুন ফেইজে একটু বিরতি দিলে ভালো ফল মিলবে। শুধু ক্লিনজিং আর ত্বক পুনরুজ্জীবিত করে তোলার চেষ্টা করা যেতে পারে। ইপসম সল্ট, ফুল আর ক্রিস্টাল ব্যবহারে নেওয়া যেতে পারে সুদিং বাথ। এটা দেহ-মনকে প্রশান্ত রাখতে সহায়তা করবে। তারপর ময়শ্চারাইজেশন মাস্ট। এ ছাড়া রিল্যাক্সিং রোলার, তেল, গুয়াশা, জেড স্টোন ব্যবহারে ত্বক যত্নে রাখার মোক্ষম সময় এটি। স্কিন আইসিং এবং কোল্ড কমপ্রেস করার জন্যও। জিনসেং ও অলিভ অয়েল এ সময় ত্বকের যত্নে দারুণ কার্যকর—নতুন ত্বক, উজ্জ্বল ত্বকের জন্য।
চুলে নতুন কোনো স্টাইলিং চাইলে তারও উপযুক্ত সময় এটি। বহুদিন ধরে নতুন কোনো মেকআপ কৌশল শেখার সাধ, সেটা শিখে নেওয়ার জন্যও ফুল মুন দারুণ। লিপস্টিকের শেড কিংবা শ্যাডো প্যালেট নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে চাইলে সময়টা ভালো। চুলের যত্নে পূর্ণ চন্দ্র খুব ভালো সময়। মাথার ত্বককে উজ্জ্বীবিত করার জন্যও। সে ক্ষেত্রে দুটো নেটেল টি-ব্যাগ এক কাপ পানিতে নিয়ে চা তৈরি করে নিতে হবে। রুম টেম্পারেচারে ঠান্ডা করতে হবে ব্যবহারের আগে। চুল ধুয়ে নিয়ে টাওয়েল ড্রাই করে মাথার ত্বকে আস্তে আস্তে ম্যাসাজ করে নিতে হবে। মাথার সামনের দিক থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে পেছনের অংশে ভালোভাবে ম্যাসাজ করে কিছুক্ষণ রেখে চুল ধুয়ে নিতে হবে। এটা চুলের গোড়াতে পুষ্টি জোগাবে, রাখবে উদ্দীপ্ত। চুলের বৃদ্ধিতেও সহায়ক। প্রতি পূর্ণ চন্দ্রতে এই পদ্ধতিতে চুলের যত্নে ভালো ফল মিলবে। ব্যবহার করা যেতে পারে ময়শ্চারাইজিং হেয়ার মাস্কও। একটা পেঁয়াজের রস নিয়ে তাতে সমপরিমাণ নারকেল তেল মিশিয়ে নিতে হবে। মিশ্রণে এক টেবিল চামচ করে গ্লিসারিন ও ক্যাস্টর অয়েল মিশিয়ে নিতে হবে। তাতে পছন্দসই এসেনশিয়াল অয়েল আর এক টেবিল চামচ লেবুর রস অথবা সাদা ভিনেগার মিশিয়ে বানাতে হবে মিশ্রণ। একটা তুলার বল দিয়ে মাথার ত্বকে মিশ্রণটি মেখে নিতে হবে। তারপর আলতো হাতে ম্যাসাজ করে নিয়ে রেখে দিতে হবে কয়েক ঘণ্টা। তারপর শ্যাম্পু করে নিতে হবে। পেঁয়াজের রসে আছে পর্যাপ্ত সালফার, প্রোটিন ও বায়োটিন—যা চুলের বৃদ্ধিতে সহায়ক।
ত্বকের যত্নে সিম্পল ফুল মুন রিচুয়ালের জন্য প্রথমেই পছন্দসই ক্লিনজার বেছে নিতে হবে। ফুল মুন ফেইজের জন্য নারিশিং ক্লিনজিং অয়েল, টি ট্রি জেল ক্লিনজার অথবা ব্লু ল্যাভেন্ডার যুক্ত ক্লিনজিং মিল্ক বেছে নেওয়া যেতে পারে। তারপর ফেস মিস্ট স্প্রে করে নিতে হবে ত্বকে। লেমন থাইম, তুলসী, ফ্র্যাঙ্কিনসেন্স আর রোজ পেটালের নির্যাসে তৈরি ফেস মিস্ট এ সময় ত্বকের জন্য দারুণ কার্যকর। একটা ছোট বাটিতে পছন্দসই ক্লে নিয়ে তাতে মিস্ট মিশিয়ে ক্রিমি ফেস প্যাক তৈরি করে নিতে হবে। মুখে ও গলায় মাখিয়ে নিতে হবে ব্রাশ অথবা আঙুলের সাহায্যে। প্যাক ওঠানোর ক্ষেত্রে দুটো পদ্ধতি রয়েছে। প্রথমটি বহুল প্রচলিত। প্যাক মুখে শুকিয়ে যাওয়ার পর উষ্ণ পানিতে ভালো করে ধুয়ে নেওয়া। অন্যটি আরেকটু কৌশলী। মাস্ক মুখে শুকাতে শুরু করলে মিস্ট স্প্রে করে তা আবার ভিজিয়ে নেওয়া। এতে মাস্ক মুখে আরও দীর্ঘ সময় কার্যকর থাকবে। ত্বকের ডিটক্সিফিকেশন ও মিনারালাইজেশন হবে কার্যকরভাবে। ত্রিশ মিনিট ধরে এ প্রক্রিয়া চালানো যেতে পারে। মুখের ক্লে মাখানো অবস্থাতেই গোসলের জন্য তৈরি হয়ে নেওয়া যায়।
পূর্ণ চন্দ্রের এ সময় গোসলের পানিতে আধা কাপ পরিমাণের বেন্টোনাইট ক্লে অথবা বেকিং সোডা মিশিয়ে নেওয়া যায়। সে সঙ্গে হারবাল টি মিশ্রণও মিশিয়ে নেওয়া যায় পানিতে। তারপর তাতে গা ভিজিয়ে বসে থাকা চাই। বৈদ্যুতিক আলোর বদলে জ্বলে উঠুক মোমবাতি। রিল্যাক্সিং মিউজিক ছেড়ে বই পড়ে সময়টা কাটানো যেতে পারে। গোসল শেষে সেই পানিতে মুখের মাস্কটা ধুয়ে নেওয়া যায়। তারপর টাওয়েল ব্যবহারের আগে আধভেজা শরীরে আর মুখত্বকে মেখে নেওয়া যেতে পারে অয়েল সেরাম, আপওয়ার্ড মোশনে। মুন ওয়াটার তৈরির সবচেয়ে ভালো সময় এটি। একটা বাটিতে বা জারে পানি নিয়ে তা সারা রাত খোলা আকাশের নিচে রেখে দিতে হবে যেন চাঁদের প্রতিবিম্ব পানিতে পড়ে। পরবর্তীকালে একটি ক্লিয়ার কোয়ার্টজ ক্রিস্টাল দিয়ে পানি নেড়েচেড়ে নিতে হবে। এই পানি ক্লিনজিং, এক্সফোলিয়েশন, এমনকি ফেস প্যাকেও মিশিয়ে ব্যবহার করা যাবে।
ওয়ানিং গিবাস
চন্দ্রচক্রের এ পর্যায়ে চাঁদ আকাশ থেকে বিলীন হতে শুরু করে। তাই এটি সবচেয়ে ভালো সময় নেতিবাচক যেকোনো কিছু থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য। ভয়, নিরাপত্তাহীনতা কিংবা ত্বকচর্চার নিয়ম মেনে চলার আলসেমি—সবকিছু থেকে। ক্লিয়ার ইয়োর মাইন্ড ফ্রম ক্লাটার। পুরোনোকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার এ সময় ত্বকে জমে থাকা ধুলাময়লাও তাই পরিষ্কার করে নেওয়া প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে এক্সফোলিয়েটিং বডি ওয়াশ ব্যবহার করা যেতে পারে। মুখত্বকে পছন্দসই ক্লিনজার আর ময়শ্চারাইজার মাস্ট। চোখের যত্নে আই ক্রিম। সবশেষে গুয়াশা স্টোন দিয়ে ফেশিয়াল ম্যাসাজে পরিপূর্ণ ত্বকযত্ন। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে গ্রোথ কমে যায় বলে হেয়ার রিমুভাল ট্রিটমেন্টের জন্য এই ফেইজ চমৎকার। ওয়ানিং গিবাস ফেইজে হেয়ার কালার করলে সেটা বেশি দিন টিকে থাকেও বলে প্রচলিত আছে।
এ ছাড়া মেকআপ প্রোডাক্টগুলো পরিষ্কারের জন্য আলাদা সময় রাখতে হবে। এমন সব পণ্য ব্যবহার করতে হবে, যা ত্বকের জন্য কোমল ও আরামপ্রদ। হারবাল চায়ে তৈরি পণ্য দিয়ে দূর করতে হবে ত্বকের জ্বালাপোড়া। দেহযত্নে গোসলের পানিতে ব্যবহার করা যেতে পারে ইপসম সল্ট—হিলিং, এক্সফোলিয়েটিং ও স্লিমিং এফেক্টের জন্য। এতে ব্যথা দূর হবে; মাসল রিলাক্সেশনের জন্যও দারুণ। গোসলের ঈষদুষ্ণ পানিতে দুই মুঠো ইপসম সল্ট, ২০ ফোঁটা এসেনশিয়াল অয়েল মিশিয়ে নিয়ে তাতে ১৫ থেকে ২০ মিনিট গোসল করে নিতে হবে। তারপর তেল নয়, ক্রিম বেসড বডি ময়শ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে।
লাস্ট কোয়ার্টার মুন
ত্বকের ব্যাপারে কোমল থাকতে হবে এ সময়। নতুন কোনো পণ্য বা ট্রিটমেন্ট ট্রাই করা যাবে না একদমই। এ সময় ত্বকের বিরতি। এত দিন পুরো চক্রজুড়ে যা যা ব্যবহার করা হয়েছে, তার কোনটা কাজ করল আর কোনটা করল না, তা-ই পর্যবেক্ষণ করার সময়। বেশি যত্নআত্তিতে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই স্কিনকেয়ারের একদম বেসিক রুলগুলো মেনে চললেই হবে।
ওয়ানিং ক্রিসেট
চন্দ্রচক্র পূর্ণতা পায় শেষ পর্যায়ে এসে। পরবর্তী চক্রের জন্য ত্বককে তৈরি রাখতে তাই জোগান দিতে হবে প্রয়োজনীয় পুষ্টি আর আর্দ্রতা। হায়ালুরনিক অ্যাসিড, শক্তিশালী সেরামাইড যুক্ত স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট এ ক্ষেত্রে দারুণ কার্যকর। এ ছাড়া বডি এক্সফোলিয়েশনও জরুরি, বডি ব্রাশ দিয়ে। ডিটক্সিফায়িং বডি লোশন ব্যবহার করতে হবে। ব্যবহার করা যেতে পারে বাসায় তৈরি বডি স্ক্রাবও। কমলা অথবা লেবুর খোসা ছাড়িয়ে কড়া রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। তারপর শুকানো খোসাগুলো গুঁড়া করে নিতে হবে। এটা পরিমাণমতো নিয়ে সমপরিমাণ ওটস দিয়ে মধু আর ঈষদুষ্ণ দুধ মিশিয়ে থকথকে পেস্ট তৈরি করে নিতে হবে। পুরো শরীরে এই পেস্ট মাখিয়ে শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তারপর গোসলের সময় ঘষে ঘষে তুলে ফেলতে হবে। এভাবেই পরবর্তী চক্রের জন্য তৈরি হবে দেহ ও মুখত্বক।
চাঁদ কখনো গোল, কখনো কাস্তে, কখনো ঝলসানো রুটির খানিকটা ছিঁড়ে খাওয়া অংশের মতো! কখনো নিজেকে সোনার আলোয় মুড়ে রাখে, কখনো ঝকঝকে রৌপ্যকান্তি! চন্দ্রচক্রের বিচিত্র সব পর্যায়। ঠিকঠাকভাবে ফেইজগুলো ঠাহর করতে সাহায্য নেওয়া যেতে পারে গুগলের। তারপর সে অনুযায়ী চলুক সৌন্দর্যচর্চা।
মডেল: অভিনেতা আরিফিন শুভ ও অভিনেত্রী ঐশী
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: টুয়েলভ
ছবি: জিয়া উদ্দীন