skip to Main Content

ফিচার I যে জীবন প্রথম আরব মডেলের

বয়স ছুঁয়েছে ৮০। তবু দৃষ্টি থেকে দুর্দান্ত দ্যুতি এতটুকু কমেনি! পেছন ফিরে তাকিয়ে একটি গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনাকালের স্মৃতিচারণা করলেন লেবাননের স্বর্ণালি যুগের ফ্যাশন আইকন আন্দ্রি আকোরি

কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা সোনালি চুল খেলে যাচ্ছে ঢেউ। শীর্ণ চেহারা ও বাদামি চোখে ঝিলিক দিচ্ছে দ্যুতি। ইতালির রোমে বসে হাসলেন প্রাণজুড়ানো হাসি। ইদানীং এ শহরেই থাকেন। ৮০ বছর বয়সে পৌঁছে ফিরে তাকালেন গৌরবময় অতীত—বিশ্বের প্রথম আরব মডেল হিসেবে কাটানো দিনগুলোর দিকে। বলছি আন্দ্রি আকোরির কথা।
গল্পের শুরু ১৯৬২ সালে, ইতালিয়ান কূটনীতিক ইতালো লিভাদিয়োত্তিকে বিয়ের দুই বছর পরে। ‘বাবা ছিলেন ফ্যাব্রিক মারচেন্ট, আর লেইস ও গুইপুর ম্যাটেরিয়ালের প্রতি দারুণ টান ছিল আমার; তবু ফ্যাশন দুনিয়ায় নাম লেখানোর কথা ভাবিনি,’ স্মৃতিচারণায় বলেন আকোরি। ‘একদিন ননদের সঙ্গে বসে আছি সুইজারল্যান্ডের এক রেস্তোরাঁয়। পরনে শ্যানেল স্যুট। আমাকে দেখে জনৈক বিখ্যাত ডিজাইনার তার কালেকশনের মডেল হওয়ার প্রস্তাব দিলেন।’ ওই ডিজাইনারের কাছে তখন মডেল হিসেবে অনভিজ্ঞতা অকপটে স্বীকার করে নেন আকোরি। তবু ডিজাইনার নাছোড়বান্দা। তার অনুমান মিথ্যে হয়নি। ১ দশমিক ৭৮ মিটার বা প্রায় ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার সেদিনের সেই লিকলিকে তরুণী স্বীকার করেন, প্রথম শোতে রীতিমতো ছিলেন নার্ভাস। তবে দ্রুতই তা কাটিয়ে উঠে দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেন।
মডেল হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে আকোরিকে স্বামী সমর্থন দিলেও বাবা বেঁকে বসেন; দুই বছর কন্যার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। বহু পরে আকোরি জানতে পারেন, তার বাবা এত দিন গোপনে ঠিকই দেখেছেন কন্যার শো! অবশেষে সেন্ট ট্রোপেজে চলা এক শোর পর সে কথা মেয়ের কাছে স্বীকার করেন ওই ভদ্রলোক। ‘এ ছিল আমার পাওয়া সেরা উপহার,’ বলেন আকোরি।
লেবাননের রাজধানী বৈরুতে বেড়ে ওঠা এই নারী আরও জানান, বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হওয়ার সময় তিনি ছিলেন ৯ বছরের বালিকা। ‘সে সময়ে বিবাহবিচ্ছেদ ছিল বিরল,’ বলেন তিনি। ‘মাকে দেখে খুব কষ্ট হতো। বাবা আমাকে আবাসিক স্কুলে পাঠিয়ে দিলেন। আমি তখন বেপরোয়া; স্কুলের নিয়মনীতি মানতাম না। মর্জিমতো চলতাম।’
মা ভায়োলেটের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল আকোরির ওপর। কিংবদন্তি এই মডেল স্বীকার করেন, শোকেসে ক্যারিয়ার বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে মায়ের ছাপই তাকে প্রেরণা জুগিয়েছিল।
প্রথম শো শেষে একের পর এক প্রস্তাব আসতে শুরু করে। ডিওর থেকে নিনা রিকি, শ্যানেল ও সেন্ট লরেন্ট পর্যন্ত—বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন হাউসগুলোর অন্যতম কাক্সিক্ষত মডেল হয়ে ওঠেন তিনি। নিজস্ব ক্যারিশমা ও উজ্জ্বল আভার গুণে আকোরি ঢুকে পড়েন ফ্যাশন দুনিয়ার বড় সব দরজায়, সাক্ষাৎ পান বড় বড় ব্যক্তিত্বের, যাদের মধ্যে ছিলেন ক্রিশ্চিয়ান ডিওর, নিনা রিকি ও কোকো শ্যানেল। ‘মঞ্চে যেন প্রজাপতির মতো উড়ছিলাম,’ বলেন স্মৃতিচারণায়।
তার ক্যারিয়ারে নিবিড় ভূমিকা ছিল রিকির। আকোরি শুধু ব্র্যান্ডটির মডেলই ছিলেন না, দ্রুতই নিয়মিত মুখে পরিণত হয়ে সাত বছর সেই অবস্থান ধরে রাখেন। ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত মডেল হিসেবে কাজ করেছেন তিনি; সেই সময়ে এত বয়স পর্যন্ত সাধারণত কেউ মডেলিং করতেন না। বিজ্ঞাপনচিত্রেও অংশ নেন।
সামাজিক বিধিনিষেধের সীমা পেরিয়ে তিনি জন্মশহর বৈরুতে একটি মডেলিং স্কুল গড়ে তোলেন। ওই স্কুলে ভর্তি হওয়া মডেলদের অন্যতম জর্জিনা রিজক। ১৪ বছর বয়স থেকেই রিজক তার নিত্যসঙ্গী। ১৯৭০ সালে ‘মিস লেবানন’ হওয়া থেকে শুরু করে ‘মিস টেলিভিশন’, ‘মিস ইউরোপ’ হয়ে অবশেষে ১৯৭১ সালে ‘মিস ইউনিভার্স’ হওয়া পর্যন্ত—সৌন্দর্যের দুনিয়ায় রিজককে বিচরণে পথ দেখিয়েছেন আকোরি। এ সময়ে তিনি সমাজের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, মা ও মডেল—এসব পরিচয়ের মধ্যে দারুণ ভারসাম্য রেখে বহু নারীকে স্বপ্নপূরণে সাহায্য করেছেন। মাতৃস্নেহবঞ্চিত আকোরির কোলজুড়ে তার প্রথম স্বামীর সঙ্গে করা সংসারে জন্ম নেয় এক কন্যা। সেই পাওলাকে তিনি নিজ জীবনের এক ও অনন্য মূল্যবান রত্ন হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ‘মেয়েই আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর উপহার। ওকে নিয়ে, ওর অর্জন নিয়ে আমি গর্বিত। আমাদের দুজনের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ।’ মা ও বন্ধু হিসেবে তিনি দারুণ—এ দুটি প্রশংসা আকোরির খুবই প্রিয়। ‘৯ বছর বয়স পর্যন্ত পাওলা আমার সঙ্গে শোগুলোতে যেত; লোকে আমাদের ক্যালিন ও ক্যালিনেট বলে ডাকত’—আন্দ্রির বদলে ক্যালিন—মডেল হিসেবে এই নামই তাকে দিয়েছিলেন সিলভিয়ো ট্যাভেট, সেই উল্লেখ টেনে বলেন আকোরি।
দ্বিতীয় স্বামী ব্রুনো লিভাদিয়োত্তির সঙ্গে বিয়ের পর আকোরির ক্যারিয়ারের গতি কমে আসে। কোলাহলপূর্ণ জীবন ও খ্যাতি সত্ত্বেও তাকে এক বেদনাবিধুর পর্যায়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়, যখন তিনি তারুণ্যের শীর্ষে থাকা সময়ে ক্যানসারে আক্রান্ত হন। তবে এ কারণে জীবনকে ভালোবাসা থামিয়ে দেননি; বরং ‘বর্তমানে’ বেঁচে ‘ভবিষ্যতে’ চোখ রাখার তৃষ্ণা বাড়তে থাকে। ‘দিন ধরে ধরে জীবন কাটানোর এবং সব সময় ইতিবাচক থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম,’ উল্লেখ করে তিনি আরও জানান, ভোগান্তি সত্ত্বেও নিয়তি তার জন্য ভালো কিছুই রেখেছিল। এখনো তিনি জীবনরসে পরিপূর্ণ।
অতীতের ডিজাইন মাস্টারদের কাজের প্রত্যক্ষদর্শী এই বর্ষীয়ান নারীকে বর্তমানকালের ফ্যাশন খুব একটা টানে না। ১৯৬০-এর দশকের সেন্ট লরেন্ট স্যুট ও ডিওর ড্রেসই তার প্রিয়; ভালোবাসেন ক্ল্যাসিক্যাল কাজ। বর্তমানে তার প্রিয় ব্র্যান্ড আরমানি। একজন লাস্যময়ী নারী ও ফ্যাশন বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি ঘোষণা করেন, ‘আজকালকার মডেলরা খুবই চর্মসার! তারা হাসেন না; তাদের হাঁটার মধ্যে উপস্থিতিসত্তা নেই। দেখে খারাপ লাগে। দিগন্ত ছড়ানো হাসির ঝিলিক নিয়ে তাদের ক্যাটওয়াক করা ও দর্শকের দিকে ঘুরে তাকানো উচিত।’ আকোরির বিশ্বাস, আদর্শ নারীমাত্রই সব সময় সুন্দর, মার্জিত, নারীত্বপূর্ণ—যেন দেখে মনে হবে, নিজ জীবনের সবকিছু মুক্তচিত্তে নিয়ন্ত্রণ করার মতো তিনি স্বাধীন। নিজেকে তাই তিনি একটা বার্তা দিয়ে রেখেছেন এবং কখনো পেছন ফিরে তাকাননি। ‘অতীত নিয়ে তেমন আক্ষেপ নেই। এলি সাব ও আরমানির হয়ে ক্যাটওয়াক করতে পারার মতো আমার বয়স এখন আর বিশের কোঠায় নেই, আক্ষেপ শুধু এটুকুই।’ তবু একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে অনুশোচনা রয়েই গেছে: ১৯৫৫ সালের ‘রিফিফি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব ঔপন্যাসিক আগুস্ত লা ব্রেতোঁকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
প্রথম আরব মডেল এবং লেবাননের স্বর্ণালি যুগের আইকন হিসেবে আকোরির নাম চিরস্মরণীয় রয়ে যাবে। ‘সেই যুগ কোনো দিন ফিরবে কি না, জানি না,’ বলেন তিনি। ‘১৯৬০-এর দশক ছিল দুর্দান্ত ও প্রাচুর্যপূর্ণ। আমরা তখন ফ্যাশনে ছিলাম চির আধুনিক। সেই দিনগুলোতে অনেক ঘুরেছি। যখনই লেবাননে ফিরতাম, নিজেকে বলতাম—পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের কোনো বৈরিতা নেই।’

 জেনি ইয়াজবেক
অনুবাদ: আরিফুল ইসলাম রুদ্র
ছবি: কিকি হো/ভোগ অ্যারাবিয়া
সূত্র: ভোগ অ্যারাবিয়া; নভেম্বর ২০২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top