ফিচার I বাহনলিপি
এমনতর লিপির সঙ্গে মিশে থাকে একটি সমাজের বাঁকবদলের চিত্র
শীতে কুয়াশাভেজা গাড়ির কাচে আঙুল বুলিয়ে নাম লেখার অভ্যাস আছে অনেকেরই। লোকাল বাসের সিটের ব্যাকে আজও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের উদ্দেশে তিরস্কারমূলক বাক্য চোখে পড়ে। কেউ কেউ আবার প্রিয়জনের নামের প্রথম অক্ষরের সঙ্গে প্লাস চিহ্ন দিয়ে যুক্ত করেন নিজের নামের প্রথম অক্ষরটিও। বিজ্ঞাপন কিংবা প্রচারণায় গাড়ির বডি ব্যবহার হরহামেশাই হয়। তবে এসবই সাধারণ লোকের গাড়িলিপি। কর্তৃপক্ষও গাড়ির ভেতরে-বাইরে বেশ কিছু বাক্য লিখে থাকে। সেগুলো দিয়ে একটি সমাজের সভ্যতার অবস্থা সম্পর্কে আঁচ করা যেতে পারে। যেমন সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলো খাঁচার মতো হয় কেন? কেনইবা সেটির ছাদে তারের জালি দেওয়া হয়? এসবই নিরাপত্তার জন্য। মানে, ওই সমাজে চলতি পথে যাত্রী সাধারণের মালপত্র চুরি যাওয়ার ভয় আছে বলেই এমন খাঁচার ব্যবহার। মূলত এই একই কারণে গাড়ির ভেতরে লেখা থাকে ‘পকেট সাবধান’।
নিরাপত্তাবিষয়ক আরও একটি বাক্য বাসে চোখে পড়ে: ‘চলন্ত অবস্থায় চালকের সঙ্গে কথা বলবেন না।’ কার উদ্দেশে লেখা হয়েছে বাক্যটি? যদি যাত্রীদের উদ্দেশে লেখা হয়, তাহলে বুঝতে হবে, ওই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে চলন্ত অবস্থায় চালকের সঙ্গে কথা বলার ‘বদভ্যাস’ রয়েছে। একজন লোকাল বাসের যাত্রীর ওই গাড়ির চালকের সঙ্গে কী এমন কথা থাকতে পারে, তা সত্যিই রহস্যের। অনেক সময় সমবেদনা মিশ্রিত বাক্য দিয়েও নিরাপত্তার আহ্বান জানানো হয়। যেমন, ‘আমি ছোট, আমাকে মারবেন না।’ মিশুক নামের একটি বাহনে এ ধরনের লেখা বেশি দেখা যেত। এখন পথে এ বাহন খুব একটা দেখা যায় যায় না। আবার দম্ভ মিশ্রিত ভাষাতেও নিরাপত্তার আহ্বান জানানো হয়: ‘১০০ হাত দূরে থাকুন।’ যাত্রীবাহী বাসগুলো যে পার্ক নয়, সেটি বুঝিয়ে দিতেও কিছু বাসে লেখা থাকে, ‘প্রেম গাড়িতে নয়, বাড়িতে।’ এই বাক্য সাধারণত বাসের শেষের দিকের সিটগুলোতে লেখা থাকে।
যাহোক, পুরো গাড়ির ময়নাতদন্তে আরও কিছু লেখার খোঁজ মেলে। দরজাগুলোতে লেখা থাকে, ‘আগে নামতে দিন।’ যাত্রীরা তা মেনেও নিয়েছেন। কেননা, আগে নামতে না দিলে বাসের ভেতরে জায়গা হবে না। ফাঁকা না হলে তো নতুন যাত্রীরা বাসে চড়তেও পারবেন না। এই শিক্ষামূলক কথা বাস্তব জীবনেও কাজে লাগানো যেতে পারে। লিফটে ওঠানামার ক্ষেত্রে ভেতরের মানুষকে প্রথমে নামতে দেওয়াই ভদ্রতা। এরপর বাসের ভেতরে ঢুকলেই চালকের আসনের ডানে কিংবা ওপরে লেখা থাকে ‘আল্লাহর নামে চলিলাম।’ এ থেকে ওই অঞ্চলের মানুষের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে আঁচ করা যায়। কিছু স্থানে আয়াতও লেখা থাকে।
বাসে নারীদের কিছু আসন রয়েছে সংরক্ষিত। ওই আসনগুলো নিয়ে সমাজে অনেক কথা-কাটাকাটিও চলে। সাধারণত লেখা থাকে, ‘মহিলা আসন ৫ জন’ কিংবা ‘মহিলা/শিশু/প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত আসন।’ ওসব আসনে পুরুষের বসা বারণ। কিন্তু কিছু পুরুষ তা মানেন না। একটা গল্প প্রচলিত আছে। একজন পুরুষ ওই সিটে বসে পড়েছিলেন। তাতে একজন নারী প্রতিবাদ জানালে ওই পুরুষ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী!’
‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’, যারা জীবনে তিন-চারবার লোকাল বাসে চড়েছেন, তাদের চোখে এ লেখা পড়ার কথা। আমাদের শহরগুলোতে বাসের স্টাফদের সঙ্গে যাত্রী সাধারণের সম্পর্ক অনেকটাই সাপে-নেউলে। দায়টা কার বেশি—তা এখনো অনির্ণীত। লেখাটি যেহেতু কর্তৃপক্ষ থেকেই লেখা হয়, তাই আঁচ করা যেতে পারে, যাত্রীদের কাছ থেকে ভালো আচরণের প্রত্যাশাতেই এর উৎপত্তি। এ থেকে আরও আঁচ করা যেতে পারে, বাঙালির কাছে ‘বংশ’ বিষয়টি খুবই মর্যাদা বহন করে। তাই এই লেখায় হয়তো বংশের আবেগকে ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাতে ভালো ব্যবহারের হার কতটা বেড়েছে, তা পাঠকের চিন্তার ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। গতিশীল বাসে বিড়ম্বনা এড়াতে সাধারণত ‘১০০, ৫০০ টাকার ভাংতি নাই’ লেখা থাকত আগে। নতুন বড় নোট বেরোলেই এই লেখা এডিট হয়। ১ হাজার টাকা বাজারে আসার পর দেখা গেল, পুরোনো লেখাগুলো মুছে সেখানে ‘১০০, ৫০০, ১০০০ টাকার ভাংতি নাই’ লেখা হয়েছে। এখন তো ২০০ টাকার নোটও মেলে। ফলে বাসের ওই লেখা আবারও পরিবর্তন হবে, ধরে নেওয়াই যায়। অন্তত এই বাক্য জরিপ করে আন্দাজ করা যেতে পারে, কোন নোটগুলো ঠিক কোন সময়ে মানুষ সমষ্টিগতভাবে ব্যবহার শুরু করেছে।
যৌথ পরিবারের ছাপও পড়ে গাড়িলিপিতে। যেমন ‘মায়ের দোয়া’ কিংবা ‘মা-বাবার দোয়া’। এসব থেকে বাংলাদেশিরা তাদের মা-বাবার প্রতি কতটা কৃতজ্ঞ, সে বিষয়ে একটি অনুমান করা যেতে পারে। সামাজিক সচেতনতামূলক বাক্যগুলো সাধারণত লোকাল বাসের পেছনের বাম্পারে দেখা যায়। যেমন ‘আপনার সন্তানকে স্কুলে পাঠান’, ‘হর্ন বাজাবেন না’ ইত্যাদি। আবার প্রযুক্তির উৎকর্ষে বাম্পারের এই লেখাগুলোতে পরিবর্তন এসেছে। যেমন ‘সন্তানকে শিক্ষা দাও, মোবাইল নয়’। এ লেখা বিশ্লেষণ করলে একটি সমাজে কখন থেকে ব্যাপকভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহার শুরু হলো এবং সেটির ব্যবহার কেমন ফল নিয়ে এল, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সম্ভব।
যাহোক, গাড়ির বডিতে এসব লেখালেখির শুরু ঠিক কবে এবং কেনইবা, এর কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে কিছু ধারণা রয়েছে। অনেকেরই অনুমান, এসব লেখালেখির সূচনা ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে। তখন পণ্য পরিবহনে ট্রাক বা লরির ব্যবহার হতো। সে সময় রাস্তাগুলো এত উন্নত ও চওড়া ছিল না। ট্রাফিক ব্যবস্থাও এত বড় পরিসরে মিলত না। সংকীর্ণ রাস্তায় পাশাপাশি দুটি ট্রাক চলার উপায় ছিল না। তাই ওভারটেকিংয়ের সময় ধাক্কা লাগা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ছোটখাটো ধাক্কাকে চালকেরা আমলে নিতেন না। কিন্তু সেই গাড়ি দাহ্য পদার্থবাহী হলে বড় দুর্ঘটনা যেতে ঘটত। বিপদ এড়াতে তখন ওসব গাড়ির পেছনে লেখা হতে থাকে ‘OK’। এই ‘ওকে’ দিয়ে মূলত বোঝানো হতো ‘On Kerosene’, মানে গাড়িতে কেরোসিন তেল কিংবা দাহ্য পদার্থ আছে। পরে এই ঙক এর সঙ্গে যুক্ত হয় ‘Horn Please OK’। মানে, গাড়িতে দাহ্য পদার্থ আছে, তুমি যদি গাড়ি নিয়ে আমাকে অতিক্রম করতে চাও, তাহলে অনুগ্রহ করে ভেঁপু বাজাও। তা ছাড়া তখন Keep Safe Distance বাক্যটিও লেখা হতো। ধীরে ধীরে গাড়ির পেছনে এসব বাক্য লেখালেখি প্রথায় পরিণত হয়। এমনকি বাস পেইন্টারদের কাছে গাড়িতে কী লেখা হবে, সেই ক্যাটালগও থাকে। যাহোক, এখন গাড়ি থেকে নামার সময় যাত্রীদেরকে ধন্যবাদ দিতেও ভোলে না কর্তৃপক্ষ। সে কারণেই হয়তো দরজায় লেখা থাকে, ‘ধন্যবাদ, আবার আসবেন।’
শিবলী আহমেদ
ইলাস্ট্রেশন: দিদারুল দিপু