টেকসহি I সবুজ গাড়ির আগমনী
‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ…’—কবি জীবনানন্দ দাশ কোন আঁধারকে ইঙ্গিত করে লিখেছেন, সেটির বহু ব্যাখ্যাই দাঁড় করানো সম্ভব। তবে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কারণে পৃথিবী যে মহাবিপদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার বেশ বড় একটা দায় যানবাহনের। তা থেকে মুক্তি দেবে কি এনভায়রনমেন্টাল কার?
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বেশ শোরগোল চলছে গোটা দুনিয়ায়। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমাতে নেওয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। তার অংশ হিসেবে চেষ্টা করা হচ্ছে যানবাহনকেও যতটা সম্ভব পরিবেশবান্ধব করে তোলার। বড় বড় অনেক গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসছে এ ধরনের গাড়ি উৎপাদনে। পরিবেশবান্ধব গাড়ি বা এনভায়রনমেন্টাল কারকে সবুজ বাহন বা পরিচ্ছন্ন বাহনও বলা হয়। এ ধরনের গাড়ি পরিবেশের ওপর প্রথাগত ডিজেল বা গ্যাসচালিত অন্তর্দহ (আইসি) ইঞ্জিনের চেয়ে কম ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
সবুজ গাড়িতে অনেক ক্ষেত্রে বিকল্প জ্বালানি ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। আবার হাইব্রিড বৈদ্যুতিক গাড়িও আছে পরিবেশবান্ধব বাহনের তালিকায়। পরিচ্ছন্ন ইথানল, প্রাকৃতিক গ্যাস, জৈব জ্বালানি ও পরিচ্ছন্ন ডিজেলচালিত গাড়িকেও এ তালিকায় রাখা হয়। তা ছাড়া ভবিষ্যতের পরিবেশবান্ধব গাড়িতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে হাইড্রোজেনও। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রচলিত মোটরগাড়িগুলোতে ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানির ভালো বিকল্প হতে পারে পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেন। জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেনের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের গাড়ি বেশ সম্ভাবনাময়। কাজেই বলা যায়, যেসব গাড়ি জীবাশ্ম ব্যবহার করে না, কিংবা ডিজেল বা গ্যাসোলিনের চেয়ে কম কার্বন ঘনত্বের জ্বালানি ব্যবহার করে, তা-ই সবুজ গাড়ি।
পরিবেশবান্ধব গাড়ির ইতিহাস
এখন পর্যন্ত পরিবেশবান্ধব গাড়ি বলতে মোটাদাগে বৈদ্যুতিক গাড়িকেই বোঝায়। কেননা বিকল্প জ্বালানির গাড়ি এখনো সংখ্যায় একেবারেই কম। পরিবেশবান্ধব গাড়ির ইতিহাস কিন্তু একেবারে নতুন নয়। প্রথম বৈদ্যুতিক বাহন তৈরি হয় আঠারো শতকের ত্রিশের দশকে। গাড়িটি চলত গ্যালভানিক সেলে (ব্যাটারিতে)। তবে ব্যয়বহুল হওয়ায় এ গাড়ির জনপ্রিয়তা কমে যায়। বৈদ্যুতিক গাড়ির সাফল্য না পাওয়ার অন্যতম কারণ ব্যাটারির অপ্রতুলতা। তবে বৈদ্যুতিক বাহনের আরেক রূপ বৈদ্যুতিক ট্রাম ও ট্রেন কিন্তু ওই সময় থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
যাহোক, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বাজারে আসে পরিবেশবান্ধব হাইব্রিড ইঞ্জিন। কিন্তু তখনো পেট্রল দামে সস্তা হওয়ায় হাইব্রিড ইঞ্জিন মার খেয়ে যায়। উনিশ শতকে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে বাড়তে থাকে সচেতনতা। এর ফলে ওই সময়েই প্রথমবারের মতো হাইব্রিড ইঞ্জিনের গাড়িগুলো ব্যাপক উৎপাদনে আসে। বিশ শতকের প্রথম দশক থেকে বাড়তে থাকে এ ধরনের গাড়ির জনপ্রিয়তা।
২০০৮ সালের দিকে তৈরি হয় টেসলা মোটরস রডস্টার ও নিসান লিফের মতো সম্পূর্ণ বিদ্যুৎনির্ভর গাড়ি। এর পর থেকেই বৈদ্যুতিক গাড়ির জনপ্রিয়তা আবার বাড়তে থাকে। এই গাড়িগুলো চলে মূলত রিচার্জ করার উপযোগী লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে।
অগ্রগতি ও সম্ভাবনা
গত দুই দশকে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে পরিবেশবান্ধব গাড়ি। টেসলার মতো বড় কোম্পানিগুলো এখন রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি) উৎপাদনে নামছে। বিশেষজ্ঞরা আভাস দিয়েছেন, ২০৪০ সাল নাগাদ বিশ্বজুড়ে ৯ কোটি ৭০ লাখ ইভি বিক্রি হবে। বিপরীতে প্রচলিত জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো গাড়ির বিক্রি নেমে আসবে এক-তৃতীয়াংশে। এ ছাড়া বিকল্প জ্বালানির, যেমন হাইড্রোজেন ব্যবহারও ক্রমেই বাড়ছে।
বিশ্ব যখন পরিবেশবান্ধব গাড়ির ব্যবহার ক্রমেই বাড়াচ্ছে, বসে নেই বাংলাদেশও। ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুচ্চালিত নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ১৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। কার্বন নিঃসরণ কমাতে বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি বাজারে আনার কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। তৈরি হচ্ছে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের কারখানা। কার্বন নিঃসরণ কমাতে সরকারি উদ্যোগে ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো দূরপাল্লার রুটে চালানোর জন্য বাস কেনার পরিকল্পনা করছে বিআরটিসি। এ ছাড়া টয়োটা, নিটল মোটরসসহ বেশ কিছু কোম্পানি বাংলাদেশে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের জন্য শুরু করেছে কর্মযজ্ঞ। নিটল মোটরসের উৎপাদিত বৈদ্যুতিক গাড়ির দাম ১০-১২ লাখ টাকা। ২৫ কিলোওয়াট ব্যাটারির এই গাড়ি একবার চার্জে ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারবে। আর দেশে টয়োটা উৎপাদিত ইভি কার বিক্রি হবে ১২-১৫ লাখ টাকায়। ৫০ কিলোওয়াট ব্যাটারির এই ইভি একবার চার্জে চলতে পারবে ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও জীবাশ্ম জ্বালানিচালিত গাড়ি উৎপাদন বন্ধ করে দেবে ধীরে ধীরে। ২০২১ সালেই মার্কিন অটোমোবাইল জায়ান্ট জেনারেল মোটরস জানিয়েছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে পেট্রল ও ডিজেলচালিত গাড়ি বিক্রি বন্ধ করে দেবে তারা। আরেক বিখ্যাত কোম্পানি অডি-ও ২০৩৩ সালের মধ্যে পেট্রল ও ডিজেলচালিত মোটরগাড়ি উৎপাদন বন্ধের পরিকল্পনা করছে। তাই সামনের দিনে থাকবে ইভিসহ সব ধরনের পরিবেশবান্ধব গাড়িরই জয়জয়কার। সব মিলিয়ে বলতেই হয়, অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিলেও এবার টিকে থাকতেই আসছে পরিবেশবান্ধব গাড়ি।
প্রভাব-প্রতিপত্তি
বিশ্বজুড়ে পরিবহনের (স্থল, নৌ ও আকাশপথ) কারণে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয়, তার প্রায় এক-চতুর্থাংশের জন্য দায়ী জীবাশ্ম জ্বালানি। আর বৈশ্বিক মোট দূষণের ১৭ শতাংশের জন্য সড়কপথের বাহনের নিঃসরণ দায়ী। এ নিঃসরণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ করে বাস, ট্রাকের মতো হেভি ডিউটি ডিজেলচালিত বাহন। বাকি দুই-তৃতীয়াংশ নিঃসরণ করে পেট্রলচালিত হালকা বাহন। এ ধরনের যানবাহনকে যদি বিদ্যুচ্চালিত বাহনে পরিণত করা হয় এবং বিকল্প পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ব্যবহার করা যায়, তাহলে পরিবহন খাতের কার্বন ডাই-অক্সাইড ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব।
তবে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির কিছু নেতিবাচক প্রভাবের কথাও বলছেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন গাড়ি নির্মাণ, বিক্রি ও সার্ভিসিংয়ের কাজের সঙ্গে যুক্ত কয়েক কোটি মানুষ। প্রচলিত গাড়ির জায়গায় বৈদ্যুতিক গাড়ি এলে কর্মহীন হয়ে যাবেন তাদের অনেকেই। এ ছাড়া হাইব্রিড ও বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহারের ফলে ব্যাপকভাবে কমে যাবে তেল ও গ্যাসোলিনের ব্যবহার। এর ফলে বিরাট ধাক্কা খেতে পারে তেলনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলো।
আরেকটা সমস্যা হলো, হাইব্রিড গাড়ির ব্যাটারিগুলোর স্থায়িত্ব অনেক দিনের হলেও একসময় বদলাতেই হবে। ব্যাটারি বদলানো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এ ছাড়া ব্যাটারি ঠিকমতো রিসাইকেল করা না হলে ব্যাপক পরিবেশদূষণেরও প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। কাজেই এসব সমস্যার সমাধান মাথায় রেখে তবেই পরিবেশবান্ধব গাড়ি চালুর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া উচিত। তবে মোদ্দা কথা হলো, সম্ভবত আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই ডিজেল ও পেট্রলচালিত গাড়ি নিষিদ্ধ হয়ে যাবে বেশির ভাগ দেশে। পরিবেশ রক্ষার জন্য উন্নত দেশগুলো ইতিমধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানিচালিত যানবাহনের সংখ্যা কমাতে শুরু করেছে। তাই বলা যায়, আগামী দিনে পরিবেশবান্ধব গাড়িই সড়কে আধিপত্য বিস্তার করবে।
মারুফ হোসেন
ছবি: ইন্টারনেট