যাপনচিত্র I সুখী হওয়ার মন্ত্র
জান্নাতুল ফেরদৌস পিয়া। ফ্যাশন মডেল ও অ্যাংকর হিসেবে পরিচিত মুখ। একই সঙ্গে আইনজীবী ক্যারিয়ার, ব্যবসা ও সংসার নিয়েও সদা ব্যস্ত। তবু একান্ত একটি দিন ছুটি পেলে কেমন কাটে তার? সেই অন্দরজীবনে দেওয়া যাক উঁকি…
সকালবেলার রোদ্দুর
সকালটা একটু দেরিতেই শুরু হয় পিয়ার। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে ঘড়িতে প্রায় সাড়ে ১০! শিশুসন্তান অ্যারেসের মুখ তার মনে এক নিগূঢ় প্রশান্তি এনে দেয়। তারপর সকালের আহার তালিকায় শুধুই মধু, কালিজিরা আর এক কাপ চা! ইন্টারমিটেন্ট ডায়েটিংয়ে বিশ্বাসী পিয়া সকালের নাশতা করেন না। ভারী খাদ্য পেটে পড়ে একেবারে লাঞ্চে।
বাসায় থাকলেও প্রচুর ছোটখাটো কাজকর্মে সময় কাটে। ফাঁকে ফাঁকে সেরে ফেলেন কিছু জরুরি কাজও, সেলফোন কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে। করেন ওয়ার্কআউট। সকালের মিষ্টি আলোয় বই পড়তে তার দারুণ লাগে। ছাদে খানিকটা হাওয়া খেয়ে, গাছের যত্ন নিয়েও কাটান দিনের প্রথম প্রহর। তবে ওয়ার্কআউট সাধারণত বিকেলেই করেন বেশি।
দুপুরের ঘ্রাণ
একটু দেরি করে ওঠেন বলেই সকালটা খুব বেশিক্ষণ পাওয়া হয় না তার। প্রতিদিনই একই সময়ে লাঞ্চ সারার চেষ্টা করেন। পরিমিত ভাত খেতে পছন্দ করেন। সঙ্গে সবজি তো থাকেই। আরও থাকে মাংস, মাছ কিংবা ডিম। জাংক ফুড কিংবা কোল্ড ড্রিংকস ভুলেও ছুঁয়ে দেখেন না! চকলেট, চিনিও খান না একদমই। যদিও কাজের চাপে অনেক সময়ই বাসায় লাঞ্চ সারা হয় না তার; তেমন দিনে যতটা সম্ভব চেষ্টা করেন বাসার খাবারই সঙ্গে রাখার। কেননা, বাইরের খাবার পারতপক্ষে পাতে নেন না পিয়া।
তার পানীয় তালিকায় সবচেয়ে প্রিয় হলো চা। সময়ে সময়ে চায়ের কাপে দেন চুমুক। অন্যদিকে, জিমে যাওয়ার আগে এক মগ কফি ছাড়া তার চলেই না। পিয়া বলেন, ‘ক্যাফেইন না নিলে একদমই এনার্জি পাই না!’
বিকেলের আলো-আঁধারি
শীতের দিনে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে একটু দ্রুতই। তাই স্বল্পকালীন বিকেলবেলাটি মূলত ওয়ার্কআউট করে কাটাতেই পছন্দ করেন পিয়া। বিকেলেও ছাদে উঠতে ভালো লাগে তার। আকাশের পানে চেয়ে, ছেলের সঙ্গে খুনসুটি করে, টবে ফুটে থাকা ফুলের ঘ্রাণ নিতে পছন্দ করেন। তারপর ছাদ থেকে ঘরে ফিরে পিয়ানোতে খানিকটা টুং-টাং…।
পিয়া জানালেন, এই মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্টটি তিনি ঘরে তুলেছেন বেশি দিন হয়নি। করোনাভাইরাস প্যান্ডেমিকের সময় কী করে একটু কোয়ালিটি টাইম কাটানো যেতে পারে, সেই ভাবনা থেকেই পিয়ানো শেখা শুরু। অ্যাপ ডাউনলোড করে, টিউটোরিয়াল দেখে, নিজে নিজেই বাজানো শিখেছেন। শিখছেন এখনো। বলে রাখি, অবসর দিনের বিকেলে মাঝেমধ্যে নিজের স্যালনেও সময় দেন পিয়া।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্রি
সন্ধ্যার পর পারিবারিক আবহে সময় কাটাতে ভালোবাসেন তিনি। কেননা, তার কাছে পরিবারের গুরুত্বই বেশি। আর মা হওয়ার পর থেকে ছেলে অ্যারেস রয়েছে তার সত্তাজুড়ে। ‘আমি আমার মাদারহুড টাইম খুব উপভোগ করছি,’ বলেন পিয়া।
আরও বলেন, ‘আমার পারসোনাল লাইফে কী চলছে, বা কী কী করি—বাইরে থেকে বুঝতে দিই না। আমি কি খুব লেভিশ লাইফ লিভ করছি, নাকি সিম্পল লাইফ, নাকি পুওর লাইফ—আমার সোশ্যাল মিডিয়া দেখে কেউ বুঝতে পারবে না। আমি এটা স্ট্রিক্টলি মেইনটেইন করি।’
পিয়ার রাতের খাদ্যতালিকাও তার লাঞ্চের মতোই। খাওয়া শেষে সন্তানকে ঘুম পাড়ানোতে মন দেন। সন্তান ঘুমিয়ে পড়লে শুরু হয় আরেক ব্যস্ততা। তখনই পড়াশোনা করার সুযোগ পান তিনি। কী এমন পড়েন? একাডেমিক বইপত্র! হ্যাঁ, পিয়া এখনো ছাত্রী। ২০১৬ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করলেও পাঠের তৃষ্ণা ফুরোয়নি। একের পর এক উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার পেছনে রত করেছেন নিজেকে। আইনজীবী হয়েছেন অনেক দিন হলো। জজকোর্টে এনরোলমেন্ট আছে তার। কয়েক দিন পরে হাইকোর্টে এনরোলমেন্ট হবে, সেটার জন্য পড়ছেন। আবার বার-অ্যাট-ল করছেন। এ ছাড়া ই-এমবিএ করছেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে।
অন্যদিকে, সাহিত্যপাঠেও রয়েছে তার ব্যাপক তৃষ্ণা। সে ক্ষেত্রে মোটিভেশনাল বই বেশি প্রিয়। তার সংগ্রহে এ ধরনের বইয়ের সংখ্যা অনেক। যখনই বিদেশে যান, এয়ারপোর্টে থাকা ম্যাগাজিন ও বইয়ের কর্নার থেকে কোনো না কোনো বই কেনেন। এ ছাড়া উপন্যাস পড়তেও ভালো লাগে। রিডিংরুম ছাড়াও বেডরুমে ছোট্ট একটা বইয়ের কর্নার রেখেছেন। কোনো কোনো রাতে, চোখ বুজে আসার আগ পর্যন্ত কোনো না কোনো বইয়ে ডুবে থাকেন পিয়া। তাহলে ঘুমান কখন? সাধারণত ভোর ৪টা-৫টায়!
জীবনের নিয়মে
স্বামী ফারুক হাসান ও ছেলে অ্যারেস ফারুক হাসানকে নিয়ে পিয়ার সংসার। বলেন, ‘এখন একেবারেই লেজার টাইম পাই না। তবু কালেভদ্রে যদি পাই, টিভি দেখতে ভালো লাগে। কারণ, টিভি দেখতে খুবই রিল্যাক্সিং লাগে। বাচ্চা হওয়ার পর টানা বই পড়ার সময় পাই না। রাত্রেও পাই না। রাত্রে বাচ্চাকে নিয়ে থাকতে হয়। তা ছাড়া অনেক জিম করি। জিরো ফিগার থাকার জন্য জিম করি, তা কিন্তু নয়; বরং করি ফিজিক্যাল ফিটনেসের পাশাপাশি মেন্টাল ফিটনেস আমার কাছে আরও বেশি জরুরি বলে। জিম করলে স্ট্রেসটা চলে যায়।’ ‘বাচ্চা, পড়াশোনা, ফ্যামিলি, শ্বশুরবাড়ি, নিজের বাসা, বাবার বাসা…সবকিছুই সামলাই। সঙ্গে সঙ্গে সোশ্যাল লাইফ, পার্টিতে যাওয়া…একজন সাধারণ মানুষ যা কিছু করে, আমি সবই করি, তারপরও আমার লাইফ বেশ গোছানো। আগে শুনতাম, যে কাজই করো, বেস্ট হও। আমার এখন মনে হয়, আমরা এমন একটা ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, যেখানে একটা মানুষের অলরাউন্ডার হওয়া খুব জরুরি। নইলে একটা টাইমে গিয়ে সে রিগ্রেট করবে। সেটা একটা বয়সের পর হতে পারে, একটা প্রফেশনের পরও হতে পারে। তাই আমি কখনো চিন্তা করিনি শুধু মডেলিং করব, কিংবা শুধুই আইনজীবী হব, কিংবা শুধুই বিজনেস করব, কিংবা শুধুই ফ্যামিলি নিয়ে বাসায় থাকব। আমি চেয়েছি সবকিছু সুন্দরভাবে গুছিয়ে করতে। আমার মনে হয়, এত বছর পর এসে বুঝতে পারছি, মানুষ যা চায় সে তার অজান্তেই নিজের জগৎটা সেভাবে সাজিয়ে নেয়,’ বলেন পিয়া।
নিজের জীবনের দিকে তাকিয়ে দৃঢ়চেতা জান্নাতুল ফেরদৌস পিয়া আরও বলেন, ‘মিডিয়ার ছোটখাটো ব্যস্ততা তো আছেই। খুব বেশি কাজ করি না; তবে কম কাজও করি না। স্ক্রিনে আমাকে খুব বেশি দেখা না যাওয়ার কারণ, আলাদাভাবে সময় বের করা খুব টাফ হয়ে যায়। কারণ, আমার কয়েকটা ছোট ছোট বিজনেস ভেঞ্চার আছে। সেগুলো সামলাতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে একসঙ্গে এতগুলো চাপ, সবকিছু গোছাতে একটু হিমশিম তো খেতেই হয়। তবু যত কিছুই করি, প্রতিদিন নিজেকে ১০ থেকে ২০ মিনিট একান্ত সময় দিই। যখনই হোক না কেন। হয়তোবা চুপ করে বসে থাকি, কিংবা শুধু শুধু গান শুনি, কিংবা একা একা চিন্তা করি, কিংবা জিমে যখন বসছি—চুপ করে চিন্তা করছি। ওটা আমার একান্ত ‘মি টাইম’। এই ‘মি টাইম’টা আমার লাগেই। কেননা, আমি সুখী মানুষ হতে চাই। আমি সুখী এখন। কখনোই এমন কোনো সুপার সাকসেসফুল, সুপার অ্যাম্বিশাস হতে চাই না—যে আসলে নিজেকে নিয়ে সুখী নয়।’
রুদ্র আরিফ
ছবি: রনি বাউল