skip to Main Content

কাভারস্টোরি I সম্ভাবনার স্বপ্নযাত্রা

‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ মহান স্বাধীনতা এ দেশে এসেছে অর্ধশতাব্দী হলো। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে একেবারেই বিধ্বস্ত হয়ে পড়া বাংলাদেশ দিনে দিনে ঘুরে দাঁড়িয়েছে নিজের মতো। মুক্তিযুদ্ধের সব প্রত্যাশা হয়তো পূরণ হয়নি এখনো, তবু সম্ভাবনা আর প্রাপ্তির তালিকাও ছোট নয়। লিখেছেন রুদ্র আরিফ

‘পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখী; কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি;/ গুঞ্জরিয়া আসে অলি পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে/ তারা, ফুলের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে;/ এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,/ সকল দেশের রানী সে যে—আমার জন্মভূমি…’ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা এমন মমতাভরা, আবেগ ছড়ানো কথা যখন গলা ছেড়ে গান নানা বয়সী মানুষ; কিংবা জেমসের মতো উদাত্ত কণ্ঠে কোনো তরুণ যখন গেয়ে ওঠেন, ‘তুমি সুরের পাখি আব্বাসের দরদ ভরা সেই গান/ তুমি আবদুুল আলীমের সর্বনাশা পদ্মা নদীর টান;/ তুমি সুফিয়া কামালের কাব্য ভাষায় নারীর অধিকার/ তুমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শাণিত ছুরির ধার/ তুমি জয়নুল আবেদিন, এস এম সুলতানের রংতুলির আঁচড়/ শহীদুল্লা কায়সার, মুনীর চৌধুরীর নতুন দেখা সেই ভোর/ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি,/ জন্ম দিয়েছ তুমি মাগো, তাই তোমায় ভালোবাসি…’—তখন আবেগের আদুরে এক উত্তাল ঢেউ ছুঁয়ে যায় ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ মহান স্বাধীনতা পাওয়া এই ভূখন্ডের প্রতিটি প্রান্তর। গর্বে বুক ফুলে ওঠে আমাদের। আকাশ-পাতাল একাকার করে আনন্দাশ্রুর বান বয়ে যায়।
‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র মতো তকমাসহ নানা অপমান, অসম্মানের যথাযোগ্য জবাব দিয়ে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এক দাপুটে বাংলাদেশের খবর জানছে সারা দুনিয়া। অমিত সম্ভাবনা ও বিস্ময়কর প্রাপ্তির নানা স্বাক্ষর রেখে নিজেদের প্রকৃত পরিচয়ের ইতিবাচক বার্তা জারি রাখছেন এ দেশের মানুষ। এরই মাঝে হয়তো কিছুটা বেদনাবোধ, কিছুটা অভিমান জমা হয়েছে তিলে তিলে; তবু সেসব ছাপিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে নিজ পরিচয়ে আজ সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের মুখ দারুণ উজ্জ্বল।
আলো আসে, আলো খেলে যায়
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। এক অসম অথচ অকুতোভয় লড়াইয়ে, সারা দুনিয়াকে চমকে দিয়ে, ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত সেই ভূখন্ডে তখন অঢেল অভাব। দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাতেই ত্রাহি অবস্থা অগুনতি মুখের। সেই বাংলাদেশ দারিদ্র্যের ভার পিঠে বয়ে, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে দিনে দিনে হাঁটা দিয়েছে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে।
করোনাভাইরাস নামের বৈশ্বিক মহামারির কালেও, ২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি এ দেশের মানুষ পেয়েছেন এক দারুণ সুখবর। এদিন ‘স্বল্পোন্নত’ দেশের তালিকা থেকে ‘উন্নয়নশীল’ দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করে বাংলাদেশ।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে সংস্থাটির কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) পাঁচ দিনের বৈঠক শেষে এ সুপারিশ করা হয়। বলে রাখা ভালো, জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো দেশ পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় নির্ধারিত মানদন্ড পূরণে সক্ষম হলে তবেই পায় স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ। দ্বিতীয়বারের মতো মানদন্ডগুলো অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
ইতিহাসে চোখ রেখে জানা যায়, ১৯৭৫ সাল থেকে স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে থাকা এ দেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে সিডিপির সব শর্ত পূরণ করেছে ২০১৮ সালে। সাধারণত সিডিপির চূড়ান্ত সুপারিশের তিন বছর পর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে দেওয়া হয় চূড়ান্ত স্বীকৃতি। তবে কোভিড-১৯ বাস্তবতায় বৈশ্বিক অর্থনীতি যেহেতু নাজুক, এমন পরিস্থিতিতে সেই প্রভাব মোকাবিলায় বাড়তি দুই বছর সময় পেয়েছে বাংলাদেশ। তাই এখন শুধুই অপেক্ষা। সবকিছু ঠিক থাকলে, ২০২৬ সালেই আনুষ্ঠানিকভাবে ‘উন্নয়নশীল দেশ’ হিসেবে স্বীকৃতি ও পরিচিতি পাবে ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা পাওয়া আমাদের মাতৃভূমি।
জাগো বাঘিনী
মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এ জাতিকে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে। সেই গৌরবময় অর্জন আমাদের নিত্যদিন প্রেরণা জোগায় আরও উন্নত ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনে। পুরো জাতিকে এক সুতোয় বাঁধার ক্ষেত্রে আরেকটি বড় ভূমিকা রয়েছে ক্রিকেটের, এ কথা কারও অজানা নয়। গত শতকের শেষ ভাগে আকরাম খান, মোহাম্মদ রফিকদের হাত ধরে পুনরুজ্জীবিত হওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এ শতকে মাশরাফি বিন মর্তুজা, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিমদের ব্যাটিং-বোলিংয়ের জাদুতে পরিণত হয়েছে এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তিতে। এরই মধ্যে আগামী প্রজন্মের প্রতিনিধি, অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বাহাদুরিতে প্রথমবারের মতো কোনো ক্রিকেট বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ। ‘অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০২০’ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে লাল-সবুজের কিশোর প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব দিয়েছেন আকবর আলী। তার উঁচিয়ে ধরা শিরোপা যেন বিশ্ব ক্রিকেটকে দিয়েছে এ দেশের পক্ষে এক অমিত সম্ভাবনার বার্তা—আগামীর ক্রিকেটে দাপট দেখাতে আমরা প্রস্তুত।
যদিও করোনাভাইরাস বিরতি শেষে মাঠে ফেরা বাংলার ‘টাইগার’দের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স কিছুটা ¤্রয়িমাণ, তবে এরই মধ্যে ‘টাইগ্রেস’ বা বাঘিনী, কিংবা সহজ কথায়—বাংলার ভগিনীরা এনে দিয়েছেন আনন্দের এক নির্মল উপলক্ষ। গত নভেম্বরে তাদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। এমন অর্জনের পেছনে হৃদয়ে দাগ কাটার মতো ভূমিকা রেখেছেন শারমিন আক্তার সুপ্তা। ২৩ নভেম্বর ২০২১, বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন এই বাঘিনী। প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে বাংলাদেশের হয়ে এটিই কোনো নারী ক্রিকেটারের প্রথম সেঞ্চুরি। রুমানা-সালমা-জাহানারা-সুপ্তারা যে আমাদের ক্রিকেটে আরও দারুণ কিছু এনে দেবেন, সেই স্বপ্ন দেখাই যায়। অন্যদিকে, ভুলচুক পেরিয়ে নিশ্চয়ই নিজ মর্যাদায় ঘুরে দাঁড়াবেন টাইগাররাও।
পুনরুত্থানের পথে
দলগত হিসেবে বিশ্বমঞ্চে ফুটবলের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় খেলা বোধ হয় আর নেই। এ অঞ্চলের ফুটবলেরও রয়েছে গৌরবময় অতীত। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অবদান আমরা কম-বেশি জানি। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম কোনো যুদ্ধকালীন দল হিসেবে ১৯৭১ সালে দলটি ভারতে বেশ কিছু প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত বৃদ্ধির পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার জন্য অর্থ তহবিল সংগ্রহেও রেখেছিল উদাহরণ সৃষ্টিকারী ভূমিকা। সেই জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ শংকর হাজরাদের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে নব্বইয়ের দশকজুড়ে দাপুটে ফুটবল উপহার দিয়েছেন মোনেম মুন্না, কায়সার হামিদরা। এ শতকের শুরুতে আসে এক অনাকাক্সিক্ষত ক্রান্তিকাল। বিভিন্ন কারণেই জনপ্রিয়তা ও মর্যাদা হারাতে শুরু করে এ দেশের ফুটবল। সেই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় জাতীয় ফুটবল দলকে এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন জামাল ভূঁইয়া। ডেনমার্কে জন্মগ্রহণকারী এই মধ্য মাঠের খেলোয়াড় নিজ মাতৃভূমির টানে ফিরে এসেছেন লাল-সবুজের দেশে। তার অধিনায়কত্বে হারানো মর্যাদা ফিরে পাবার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন বর্তমান কালের ফুটবলাররা। শুধু বাংলাদেশই নয়, ভারতের স্থানীয় ফুটবল প্রতিযোগিতায়ও ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে জাত চেনাচ্ছেন জামাল। এ দেশের ফুটবল জামালদের জাদুতে ঘুরে দাঁড়াবে, সেই প্রত্যাশায় দিন গুনছেন অগুনতি ক্রীড়ানুরাগী। তাতে রসদ জোগাচ্ছেন ভগিনীরাও। দিন কয়েক আগেই সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবলের শিরোপা উঠেছে রিতু-আনাই-মারিয়াদের হাতে।
সেলুলয়েডের ফিতায় রাঙা
বলা হয়ে থাকে, একটি দেশের শিল্প-সংস্কৃতি বৈশ্বিক পরিমন্ডলে সেই দেশের অন্তস্তলীয় সমৃদ্ধির বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠে। নাটক, সাহিত্য, সিনেমা, আলোকচিত্র, চিত্রকলার মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে সেই দেশের নিজস্বতার মর্যাদাশীল বার্তা। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অর্জনের ভান্ডার নেহাত কম নয়। তবু বেদনার মতো বুকের বাম পাশে চিনচিনে ব্যথা হয়ে বেজেছে সবচেয়ে নবীন অথচ প্রভাবশালী শিল্পমাধ্যমটি—সিনেমা! কথিত মূলধারার চলচ্চিত্রে একের পর এক পতনের গুঞ্জন শুনেছি আমরা। ব্যবসা হারিয়ে, একে একে বন্ধ হয়ে গেছে অনেকগুলো প্রেক্ষাগৃহ। এফডিসি পরিণত হয়েছে যেন পরিত্যক্ত কোনো শিল্পশালায়। তবু আশা থেমে নেই!
কথিত মূলধারার বাইরে, অনেকটাই ইনডিপেনডেন্ট ফিল্মমেকিং প্রক্রিয়ায় দ্যুতি ছড়াচ্ছেন কয়েকজন প্রতিভাধর নির্মাতা। তাদের সিনেমাগুলো বাংলাদেশি সিনেমাকে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে আত্মপরিচয় জানান দেওয়ার জুগিয়েছে রসদ। তেমনই এক তরুণ নির্মাতা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ। তার বহুল আলোচিত সৃষ্টিকর্ম ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ১২ নভেম্বর ২০২১ দেশে মুক্তি পাওয়ার মাস কয়েক আগেই বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসব—ফ্রান্সের কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রথম বাংলাদেশি সিনেমা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিল প্রতিযোগিতা বিভাগে। জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত সেই আসরে সিনেমাটি কোনো পুরস্কার না জিতলেও, বিশ্বের নানা প্রান্তের চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের মনোযোগ কাড়তে পেরেছে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জন্ম দিতে পেরেছে এ দেশের চলচ্চিত্র নিয়ে নানা ইতিবাচক আলাপের।
সাদ ছাড়াও প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার নূরুল আলম আতিকের ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’, অমিতাভ রেজার ‘রিকশা গার্ল’, এন. রাশেদ চৌধুরীর ‘চন্দ্রাবতী কথা’, প্রসূন রহমানের ‘ঢাকা ড্রিম’সহ একগুচ্ছ নতুন সিনেমা আলো দেখাচ্ছে কালো হয়ে থাকা চলচ্চিত্র-আকাশে। তা ছাড়া দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ওটিটি প্ল্যাটফর্মে নিয়মিতই নিজ প্রতিভা ঝালাই করে নেওয়ার স্বাক্ষর রাখছেন বেশ কিছু তরুণ নির্মাতা। এদের মধ্য থেকে অদূর ভবিষ্যতে নতুন কোনো জহির রায়হান, আলমগীর কবির, তারেক মাসুদ উঠে আসবেন, সেই প্রত্যাশা চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শকদের।
রুপালি দ্যুতি
আজমেরী হক বাঁধন। অথবা, রেহানা মরিয়ম নূর! অভিনয় দ্যুতিতে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন রুপালি পর্দায়। সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা থেকে যাত্রা শুরু করে, ছোট পর্দা হয়ে বড় পর্দায় এ সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নামগুলোর একজন হয়ে উঠেছেন। তার এ যাত্রাপথ স্বভাবতই ‘ফুলের বিছানা’র মতো সাজানো ছিল না। ব্যক্তিগত জীবনের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, সমাজের নেতিবাচক ও পশ্চাৎপদ মানুষদের রক্তচক্ষু তোয়াক্কা না করে, সিঙ্গেল মাদার হিসেবে দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে চলা বাঁধন এখন একটি আন্তর্জাতিক নাম। গুণী এই অভিনেত্রী ইতিমধ্যেই ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে স্বতঃস্ফূর্ত ও দাপুটে অভিনয় করে জিতে নিয়েছেন বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে খ্যাতিমান ভারতীয় নির্মাতা সৃজিত মুখার্জির ওয়েব সিরিজ ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেনি’র কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় তার এ প্রতিভায় যোগ করেছে বাড়তি মাত্রা। দেশের গন্ডি শুধু ওটিটি মাধ্যমেই নয়, বড় পর্দায়ও পেরোনোর পথে তিনি। ইতিমধ্যেই নাম লিখিয়েছেন বলিউড চলচ্চিত্রে। প্রখ্যাত পরিচালক বিশাল ভরদ্বাজের ‘খুফিয়া’ চলচ্চিত্রে দেখা যাবে তাকে।
‘পাশের বাড়ির মেয়েটি’ ভাবমূর্তি থেকে বাঁধন এখন শুধু অভিনেত্রী হিসেবেই নন, সমাজসংস্কারে দারুণ সচেতন ও সক্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব হিসেবেও নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। এভাবেই অনেক অভিনয়শিল্পী ও ব্যক্তিমানুষের প্রেরণার নাম হয়ে উঠেছেন তিনি।
ধনধান্য…
এই ভূখন্ডের গণমানুষের ভাত ছাড়া চলেই না! ইতিহাসে যত দূর পেছনে তাকানো যায়, তাতে ছড়িয়ে রয়েছে প্রধান কৃষি ফসল হিসেবে ধানের বিস্তার। আদিগন্ত জমিনে আশীর্বাদের বার্তা হয়ে দুলতে থাকে সোনালি এ ফসল। তাই ধান নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। এর সাফল্যের ফিরিস্তিও কম বড় নয়। এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী ধান গবেষক ও জিনবিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী এনে দিলেন এক দারুণ খবর। তার উদ্ভাবিত উন্নত জাতের ধানগাছের এক রোপণ থেকেই পাঁচবার মিলবে ফসল! এই ধানগাছকে ‘বর্ষজীবী’ আখ্যা দিয়েছেন তিনি।
গণমাধ্যমে ড. আবেদ জানান, ধানগাছ কেন অন্যান্য গাছের মতো বছরজুড়ে টিকে থাকতে পারে না, এ নিয়ে গবেষণায় তিনি মন দিয়েছিলেন। তাতে দেখেন, চারটি জাতের ধান চারবার করে ফসল দিলেও বাকিগুলো এ সময়ে মারা যায়। সেই চার জাতের ধান নিয়ে এরপর টানা ১০ বছর গবেষণা করেন তিনি। এরই অংশ হিসেবে ২০২১ সালে ওই চার জাতের ধানের চাষ করেন ১৫ শতক জমিনে। একই বছরের জুনে প্রথমবার কাটতে গিয়ে পাওয়া যায় হেক্টরপ্রতি চার মেট্রিক টন ধান। পরবর্তীকালে ৪৫ দিন অন্তর প্রতি মৌসুমে দুই থেকে তিন মেট্রিক টন ধান পাওয়া গেছে হেক্টরপ্রতি। আর তাতেই, এক ধান গাছ থেকে ৫ বার ফসল ওঠানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
এখানেই অবশ্য থামতে নারাজ এই বিজ্ঞানী। আরও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন, কীভাবে একবার ধানগাছ রোপণ করে সেখান থেকে ছয়বার ফসল তোলা যায়!
করোনার সঙ্গে লড়াই
এই ভূখন্ডে করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। একই বছরের ১৮ মার্চ এ ভাইরাসে এ দেশে প্রথম কারও মৃত্যু ঘটে। ‘অচেনা’ ও ‘বহুরূপী’ ভাইরাসটির দাপটে কম-বেশি সবাই যখন আতঙ্কগ্রস্ত, তারই মাঝে অণুজীববিজ্ঞানী ড. সেঁজুতি সাহা চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য নিয়ে আসেন আলো। তার নেতৃত্বে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) এক দল গবেষক প্রথমবার বাংলাদেশের রোগীদের কাছ থেকে পাওয়া নমুনা থেকে উন্মোচন করেন নতুন করোনাভাইরাসের পূর্ণাঙ্গ জিনোম বিন্যাস। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নিজের ও দেশের নাম উজ্জ্বল করা এই তরুণ বিজ্ঞানীকে নিয়ে বিল গেটস জার্নালে প্রকাশিত হয় বিশেষ লেখা।
শিশুকাল থেকেই তুমুল মেধাবী এই বিজ্ঞানী তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালে রাখেন প্রতিভার স্বাক্ষর। স্কুলের বিজ্ঞান মেলায় রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের প্রকল্প বানিয়ে সাড়া ফেলে দেন। ধাপে ধাপে নিজেকে আরও ঝালাই করে নিয়েছেন তিনি। দেশ থেকে এ-লেভেলের পাঠ শেষ করে কানাডা থেকে নেন উচ্চতর ডিগ্রি। ২০১১ সালে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামে পড়াকালে শরীরে ধরা পড়ে মরণব্যাধি ক্যানসার। তবু হাল ছাড়েননি; যদিও চিকিৎসার কারণে খানিকটা বিরতি পড়ে পড়াশোনায়। পরে সুস্থ হয়ে আবারও পুরো মনোনিবেশ করেন গবেষণায়। ২০১৬ সালে দেশে ফেরেন জিনোম সিকোয়েন্সিং নিয়ে গবেষণার কাজে; যোগ দেন সিএইচআরএফে। বছর দুয়েক পরে উচ্চতর গবেষণার জন্য পাড়ি জমান আমেরিকায়। নিরলস প্রচেষ্টা ও অনুসন্ধিৎসু মনের অধিকারী এই বিজ্ঞানী পেয়েছেন তার ফলও। ২০১৯ সালে উন্নয়নশীল দেশের গবেষক প্রতিনিধি হিসেবে তিনি স্বয়ং বিল গেটসের সঙ্গে বক্তব্য দেন জাতিসংঘের অধিবেশনে।
করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং নিয়ে গবেষণার সাফল্য সেঁজুতিকে অন্যতর উচ্চতায় নিয়ে গেলেও এ পথ তার জন্য মসৃণ ছিল না। করোনাভাইরাসে দেশে প্রথম মৃত্যুর ঘটনার পরপরই এ গবেষণা শুরু করেছিলেন তিনি। এরই মধ্যে তাকে যেতে হয়েছিল ইংল্যান্ডে, ব্যক্তিগত প্রয়োজনে। পৃথিবীর সব প্রান্তের মতো বাংলাদেশেও তখন ভাইরাসটি নিয়ে জনমনে ভীষণ সন্ত্রস্ত অবস্থা; দেশে দেশে কঠোর বিধিনিষেধ। এই বাস্তবতায় ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন শেষে ২০২০ সালের ২৯ মার্চ দেশে ফিরে গবেষণা শেষ করার পরিকল্পনা ছিল ড. সেঁজুতির। কিন্তু বাধা-বিঘ্ন ছাড়া ইতিহাস লেখা হয় না—এমনটাই যেন নিয়তি! ঠিক সেদিনই লকডাউন ঘোষণা করা হয় ইংল্যান্ডে। ব্যাগ গুছিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লেও ফিরতে পারেননি দেশে। কেননা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বিমানবন্দর। তবু দমেননি। বিদেশে বসেই অনলাইন প্রযুক্তির সহায়তায় চালিয়ে যান কার্যক্রম। এর চূড়ান্ত ফল আসে সে বছরেরই ১২ মে। বাংলাদেশে কোভিড-১৯-এর জিনোম সিকোয়েন্সিং উন্মোচন যে এই জনগোষ্ঠীর জন্য ভবিষ্যতে আরও কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কারে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, সে কথা বলাই বাহুল্য।
ড. সেঁজুতির সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। ইতিমধ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পোলিও ট্রানজিশন ইনডিপেনডেন্ট মনিটরিং বোর্ডে (টিআইএমবি) সদস্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। তার সাফল্য ও দেখানো পথ এই ভূখন্ডের অসংখ্য তরুণকে নিশ্চিতভাবেই জোগাবে প্রেরণা।
বৈষম্যহীনতার পথে
ট্যাবু কিংবা অচলায়তন একটি দেশের সামাজিক মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। প্রকৃত সভ্যতাকে দেয় পিছিয়ে। বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে মহান মুক্তিযোদ্ধাদের অমূল্য আত্মত্যাগে পাওয়া এ দেশে এমনতর অচলায়তন থাকা স্বস্তির কিছু নয়। তবু ক্ষেত্রবিশেষে রয়েই গেছে। আর সেটি ভাঙার ক্ষেত্রে এক দারুণ ধাক্কা দিয়েছেন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের নজরুল ইসলাম ঋতু। সদ্য সমাপ্ত স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ের মালা গলায় পরেছেন তিনি। একই সঙ্গে নাম লিখিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়। ঋতুই এ দেশের প্রথম নির্বাচিত ট্রান্সজেন্ডার চেয়ারম্যান।
এ শুধু ঋতুর ব্যক্তিগত বিজয় নয়; কাঁধে কাঁধ রেখে, বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার পথে আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়ারও অনন্য উদাহরণ এটি।
শরীরের সাহসী ভাষা
‘কোমলমতি’ তকমার প্রলেপে নারীকে দৃশ্যত দুর্বল করে রাখার ‘ষড়যন্ত্র’ বহু দেখেছেন এ দেশের মানুষ। সেই দুর্বলতা কাটিয়ে বেগম রোকেয়ার আজন্ম লড়াই করে যাওয়া নারীমুক্তির পথে একে একে পা বাড়িয়ে সফলও হয়েছেন অনেক নারী। এ ক্ষেত্রে নতুন ও সাহসী সংযোজন বডিবিল্ডার মাকসুদা আক্তার। বডিবিল্ডিংয়ের মতো একটি ক্রীড়ামাধ্যমে আলো ছড়ানো এ নারী ২০২০ সালে হয়েছিলেন জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে স্বর্ণপদক জিতে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গেমসে। একই বছর বাংলাদেশি নারী বডিবিল্ডার হিসেবে প্রথমবারের মতো কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নাম লেখান তিনি। ‘পুরস্কার নয়, অংশগ্রহণই বড় কথা’—এমন ছেলেভোলানো বার্তায় যারা অভ্যস্ত, তাদের সামনে মাকসুদা রেখেছেন ভিন্ন জবাব। ভারতের মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত আইএইচএফএফ অলিম্পিয়া অ্যামেচার বডিবিল্ডিংয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৩০ জন প্রতিযোগীর মধ্যে ‘ওম্যান ফিজিক’ ক্যাটাগরিতে তিনি হয়েছেন তৃতীয় রানার্সআপ।
ঢাকার একটি জিমে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত মাকসুদা গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, বডিবিল্ডিং নিয়ে বাংলাদেশে প্রচলিত ট্যাবু ভেঙে দিতে চান তিনি। তার এমন আত্মবিশ্বাসী দৃঢ় উচ্চারণ শুনে দূর থেকে যেন ভেসে আসে উদ্দীপনাজাগানিয়া সেই গান—‘যদি লক্ষ্য থাকে অটুট…।’
বৈদ্যুতিক গাড়ির যুগে…
জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ার আশঙ্কা যেসব ভূখন্ডের, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা আমাদের এই মাতৃভূমির নাম সেই তালিকায় দুর্ভাগ্যক্রমে রয়েছে একেবারেই শুরুর দিকে। এ নিয়ে আলোচনা-পরিকল্পনার শেষ নেই। ২০২১ সালের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় যানবাহনে কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি। কার্বন নিঃসরণ কমাতে সারা বিশ্বই, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলো ঝুঁকে পড়েছে বৈদ্যুতিক পরিবহন ব্যবস্থার দিকে। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই।
মেট্রোরেলের মধ্য দিয়ে বৈদ্যুতিক গণপরিবহনের যাত্রা শুরু এ দেশে। এখন কাজ চলছে সড়ক পরিবহনেও এ প্রযুক্তি আনার ব্যাপারে। এ জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ বছর। গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই নীতিমালা প্রণয়ন ও গাড়ির চার্জার স্টেশন নির্মাণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
আলোর পথযাত্রী
স্বাধীনতার ৫০ বছরে অনেক অভিমান, না পাওয়ার বেদনা হয়তো জমা হয়েছে গণমানুষের মনে। তবু প্রাপ্তি ও আশার আলোও নেহাত মন্দ নয়। সব বাধা পেরিয়ে, বিশ্বের মানচিত্রে ঝলমলে রোদের মতো উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবে এ দেশের ভাবমূর্তি, সব প্রজন্মের অংশগ্রহণে গড়ে উঠবে প্রত্যাশিত সমাজব্যবস্থা—নতুন বছরে এমন স্বপ্ন আমরা দেখতেই পারি।

মডেল: অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন ও ফুটবলার জামাল ভূঁইয়া
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: জুরহেম
অটোমোবাইলস: মিতসুবিশি মোটরস বাংলাদেশ
ছবি: জিয়া উদ্দীন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top