ফিচার I শীতাতপে সর্বনাশ
যানবাহনের এয়ারকন্ডিশনিং সিস্টেম যাত্রাপথে বেশ প্রশান্তি এনে দিলেও তিলে তিলে ক্ষতি করে ফেলে চুল ও ত্বকের। হয়তো অজান্তেই
দৈনন্দিন জীবনের হাজারো সমস্যার মাঝে অন্যতম হলো ট্রাফিক জ্যাম! দিনের একটা বড় অংশই এই জ্যামেই কেটে যায়। এই সমস্যা যে শুধু জ্যামের বিরক্তিতেই সীমাবদ্ধ, তা কিন্তু নয়। লম্বা সময় ধরে যে যানবাহনে বসে থাকায়, তার এয়ারকন্ডিশনার চুল আর ত্বকের ক্ষতি করছে নিমেষেই।
যেকোনো যানবাহনের এসি ত্বক ও চুলের অনেক ক্ষতি করতে পারে। এয়ারকন্ডিশনারগুলো আর্দ্রতা কমিয়ে ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে গরম বাতাসের অদলবদল ঘটায়। তার মানে, গাড়ির ভেতরের স্বাভাবিক আর্দ্রতা শুষে নিয়ে সেখানে প্রতিস্থাপন করে ঠান্ডা বাতাস। এর ফলে যানবাহনে খুব শুষ্ক তাপমাত্রা দেখা দেয়। এমনকি এটি ত্বক ও চুলের জন্য অতি প্রয়োজনীয় আর্দ্রতাটুকুও বের করে ফেলে। বাতাস থেকে আর্দ্রতা কমে যাওয়ার ফলে ত্বক ও চুল শুষ্ক এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই স্কিন কেয়ার কিংবা হেয়ার কেয়ার রুটিনের ঘাড়ে শুষ্ক ত্বক আর চুলের দোষ চাপানোর আগে আরও একবার ভাবা দরকার, ক্ষতির কারণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহনে কাটানোও হতে পারে। ত্বকের প্রাণহীনতা আর চুলের নিস্তেজ ভাবও হতে পারে এই এসির কারণে। আরও কিছু সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে যানবাহনের এয়ারকন্ডিশনিং সিস্টেমের কারণেই।
শুষ্ক ত্বক, উষ্কখুষ্ক চুল
যেহেতু যানবাহনে খুব বেশি জায়গা থাকে না, ছোট্ট আবদ্ধ জায়গায় খুব কম সময়েই এসি বাতাসের আর্দ্রতা কেড়ে নেয়। সেই সঙ্গে ত্বক আর চুলেরও। এটি ত্বক, স্ক্যাল্প ও চুলের বাহ্যিক আবরণকে অনেক শুষ্ক করে তোলে। এতে এগুলোর অভ্যন্তরীণ গঠনও ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যাপকভাবে। এর ফলে স্ক্যাল্পে চুলকানি হতে পারে, ত্বক টানতে শুরু করে এবং ফ্লেইকি হয়ে যায়।
প্রাকৃতিক তেল উৎপাদনে ঘাটতি
ত্বক স্বাভাবিকভাবেই তেল উৎপাদন করে, যা ত্বকের গঠন সুন্দর রাখতে এবং ত্বককে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল রাখতে খুবই দরকারি। মাথার ত্বকের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। স্ক্যাল্পের প্রাকৃতিক তেল চুলের গোড়া মজবুত রাখতেও ভূমিকা রাখে। এয়ারকন্ডিশনার চারপাশের তাপমাত্রা কমিয়ে দেয়। ফলে ত্বকে ঘাম উৎপাদন কমে যায়। এতে ত্বকের মধ্যে রয়ে যায় টক্সিন। তেলের উৎপাদনও কমে যায়; যা নিস্তেজ, ডিহাইড্রেটেড এবং অস্বাস্থ্যকর ত্বক ও চুলের অন্যতম কারণ।
স্কিন ডিসঅর্ডার
ত্বকের ক্রমাগত শুষ্কতা ডার্মাটাইটিসের কারণ হতে পারে। যদি ইতিমধ্যেই রোসাশিয়া, সোরাইসিস বা একজিমার মতো ত্বকের সমস্যা থাকে, তাহলে যানবাহনের এয়ারকন্ডিশনার এটিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। কেননা এটি ত্বকের ময়শ্চারের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়।
ত্বকের অকালবার্ধক্য
পানি ত্বকের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। কারণ, এটি ত্বকের সব উপাদানের ভারসাম্য বজায় রাখতে ভূমিকা রাখে। যখন এসি ত্বকের আর্দ্রতা সরিয়ে দেয়, তখন ত্বক শুষ্ক হয়ে এর ইলাস্টিসিটি হারায়। ফলে ত্বক কুঁচকে যেতে শুরু করে। ত্বক থেকে ক্রমাগত পানি বের হয়ে যাওয়া এবং তা প্রতিস্থাপনের উৎস না পাওয়া ত্বকের অকালে বুড়িয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
চুল পড়া
স্ক্যাল্পের প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা এবং প্রাকৃতিক তেলের অভাবে চুলে নানা সমস্যা দেখা দেয়। এগুলোর মধ্যে প্রধান হলো চুল পড়ার সমস্যা। পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাবে চুলের গোড়া এর শক্তি হারায়। ফলে চুল পড়া বাড়ে। এ ছাড়া দীর্ঘ সময় যানবাহনে থেকে বের হওয়ার পর আকস্মিক তাপমাত্রার পরিবর্তন চুলের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
ত্বকে বলিরেখা
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যানবাহনে শরীর ঘাম তৈরি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ত্বক আর্দ্রতা অভাবে ইলাস্টিসিটি হারাতে থাকে। ত্বকে বলিরেখা ও ফাইন লাইনগুলো অনেক বেশি দৃশ্যমান করে তুলতে পারে।
স্কিন রিজেনারেশন
যানবাহন থেকে বের হয়ে প্রখর রোদে পা রাখলেই ত্বক বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। এটি এমন একটি মুহূর্ত, যখন ত্বক বিরূপ পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে হেরে যেতে বাধ্য হয়, ত্বকে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা না থাকায়। এতে ত্বকের রিজেনারেশন ক্ষমতা কমতে থাকে। ত্বক পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হতে শুরু করে। ত্বকের যেভাবে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার কথা, সেই প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। ফলে ত্বক অপুষ্টিতে ভোগে; হয়ে পড়ে নিষ্প্রাণ ও নিস্তেজ।
তাই বলে কি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যানবাহনে চলাচল বন্ধ? তা নয়। বরং খুঁজে নিতে হবে সহজ কিছু প্রতিকার।
ত্বককে হাইড্রেটেড রাখতে হবে সব সময়। প্রতিদিন কমপক্ষে ৮ গ্লাস পানি পান করা চাই
চেষ্টা করতে হবে ৪ সপ্তাহ পর পর বাহনের এসির ফিল্টার বদলাতে। ব্যবহৃত যানবাহনে সব সময় পানি রাখতে হবে। রাইড শেয়ার ব্যবহার করলে ব্যাগে পানির বোতল রাখতে ভোলা যাবে না কিন্তু
ত্বকে শুষ্কতা অনুভূত হলেই ময়শ্চারাইজার ব্যবহার করতে হয়। শুধু মুখে নয়; গলায়, হাতে কিংবা ঘাড়েও
যানবাহনে ওঠার আগে খুব ভালো করে সানস্ক্রিন মেখে নিতে হবে। সানস্ক্রিন শুধু রোদ থেকে নয়, অনেক ক্ষেত্রে এয়ারকন্ডিশনিংয়ের প্রভাব থেকেও ত্বককে রক্ষা করতে পারে
চুলে অতিরিক্ত শ্যাম্পুর ব্যবহার পরিহার করতে হবে। ত্বকে ব্যবহার করতে হবে মাইল্ড সাবান, প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি অর্গানিক সাবান বরাবরই ত্বকের জন্য ভালো
সপ্তাহে অন্তত একবার চুলে দই দিয়ে তৈরি হেয়ার প্যাক ব্যবহার করা যেতে পারে। ত্বকের যত্নে দুধের সর আর মধু মিশিয়ে ব্যবহার করা যায় খুব বেশি শুষ্ক মনে হলে। এ ছাড়া নারকেল তেল, সূর্যমুখীর তেল এবং অ্যাভোকাডো ত্বক কিংবা চুলের আর্দ্রতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে রাখতে পারে কার্যকর অবদান
দীর্ঘ সময় ধরে যানবাহনে থাকলে কিছুক্ষণ পরপর চেষ্টা করতে হবে বাহনের গ্লাস খুলে দিতে। কিছুক্ষণ প্রাকৃতিক বাতাসে শ্বাস নিলে ত্বক আর চুল সুযোগ পাবে শ্বাস নেওয়ার।
শিরীন অন্যা
মেকওভার: পারসোনা
মডেল: মাহি
ছবি: তানভীর খান