ছুটিরঘণ্টা I ভ্রমণে নয়, ভুবনে
কেবল সমুদ্রসৈকত নয়, মজাদার খাবারও দেশটির আকর্ষণ। আর আছে রসিক মানুষ, যারা জ্ঞানপিপাসু, প্রাণবন্ত, সুন্দর। লিখেছেন রাজু আলাউদ্দিন
গত শতাব্দীর শেষ বছর মেক্সিকোতে প্রথমবার এসেছিলাম। দেশের বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই প্রথম বিশ্বের বিত্তশালী দেশগুলোর কোনো একটি বেছে নেয়। আমি তা করিনি। ভ্রমণের জন্য বেছে নিয়েছি সেই ভূখন্ড, যেখানে ভিন্ন মাত্রায় বিকশিত হয়েছে সাহিত্য ও সংস্কৃতি। স্বাভাবিকভাবেই আমার গন্তব্য লাতিন আমেরিকার মেক্সিকো, যেখানকার সাহিত্য সারা পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
২৭ বছর আগে মেক্সিকোতে সেবার একাকী এলেও এবার সপরিবার এসেছি। আমার পাঁচ বছরের মেয়ে মায়ার মাতৃভূমিতে আগমন এই প্রথম। গত শতাব্দীর প্রথম দশকে মার্কিন গোয়েন্দাদের তাড়া খেয়ে মহান বিপ্লবী নেতা এম এন রায় মেক্সিকোয় আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই দেশে দুই বছরের বেশি কাটানোর পর একে নিজের দ্বিতীয় জন্মভূমি বলে অভিহিত করেছিলেন। আমার অনুভূতিও তাই। আমি তার চেয়ে আট বছর বেশি ছিলাম, ফলে এই দেশের প্রতি আমার অনুভূতি নানা কারণেই এম এন রায়ের তুলনায় বেশি তীব্র। এ দেশের এক নারীকে বিয়ে করার কারণে বন্ধন আরও প্রবল হয়েছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠিতে মেক্সিকো আহামরি কোনো দেশ নয়, কিন্তু সাংস্কৃতিক উষ্ণতা ও বৈভবে এটি আমার কাছে ইউরোপের যেকোনো উন্নত দেশের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। তাদের সাংস্কৃতিক তপ্ত কড়াইয়ে প্রত্যেক মেক্সিকান যেন খইয়ের মতো ফুটছে। ফুটন্ত, জীবন্ত ও কলরোলময় জীবনের সৌন্দর্য বহিরঙ্গে যেমন, তেমনি তা প্রকাশিত তাদের অন্তর্মহলেও। রসবোধ, অদম্য জীবনীশক্তি ও সৌজন্যবোধের এমন স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ লাতিন আমেরিকা ছাড়া আর কোথায় পাওয়া যাবে!
সাত বছর পর এ দেশে এসে মনে হলো, সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্য ও বর্ণময়তা এখানে আগের মতোই আছে। ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগোর সঙ্গে মেক্সিকোর সম্ভবত তিনটি গারিতা (‘গারিতা’ মানে সীমান্তচৌকি) রয়েছে। মেক্সিকোর তিহুয়ানা শহরের সঙ্গে দুটি: একটি সান ইসিদ্রো, অন্যটি ওতাই। আর তিহুয়ানারই পার্শ্ববর্তী শহর তেকাতের সঙ্গে রয়েছে আরেকটি গারিতা। ওতাই আমার বাসা থেকে কাছাকাছি ছিল বলে এখান দিয়েই আমেরিকায় বেশির ভাগ সময় আসা-যাওয়া করেছি। এবারও সাত বছর পর মেক্সিকোতে প্রবেশ করার জন্য ওতাইকেই বেছে নিলাম। ছোট বোন সাথী থাকে সান দিয়েগো, ওর বাসাতেই অতিথি হিসেবে দিন গুজরান শেষে ওর বাহনে করে ওতাই আসা। সাথী আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমরা হেঁটে সীমান্ত অতিক্রম করছি। মায়াকে বললাম, তোমার মাতৃভূমিতে তুমি পা রাখতে যাচ্ছ। উড্ডীন বিশাল পতাকাটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বলো তো, ওটা কোন দেশের পতাকা? ওটা তো মেক্সিকোর পতাকা, ড্যাড। মায়া মেক্সিকো প্রবেশের আগে যে দুটো দেশের পতাকা চিনতে শিখেছে, সে দুটি হলো বাংলাদেশ ও মেক্সিকো।
সীমান্ত পার হওয়ার পরই আমার চিরচেনা সেই দৃশ্য: মানুষের কোলাহলে স্প্যানিশ ভাষার ধ্বনিমাধুর্য ডালিমের দানার মতো দৃশ্যমান হয়ে আছে। মেক্সিকো সীমান্তে প্রবেশ করার পরই আমার বউয়ের ইচ্ছে হলো ফেরি করে বিক্রি করা র্বুরিতো কেনার। আইসবক্সের মধ্যে রাখা গরম র্বুরিতো খেতে খেতে রাস্তা পার হচ্ছিলাম আর বহুদিনের চেনাজানা চারপাশের দৃশ্যে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। রাস্তার অপর পাশেই আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য বাল্যবন্ধু রহিম গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে।
রহিম আমার স্কুলজীবনের বন্ধু। মেক্সিকোতে সে আছে প্রায় তিরিশ বছর ধরে। তার মানে নিজের দেশের চেয়ে ওর এই প্রবাসজীবন অনেক বেশি দীর্ঘ। মেক্সিকো এখন তার আরেক স্বদেশ হয়ে উঠেছে। বিয়ে করেছে সেখানে, ওর তিন সন্তানেরও জন্মভূমি এই মেক্সিকো।
বন্ধুর বাসাটি ছোট্ট হলেও এটি আমার পছন্দ এই কারণে যে, তা সমুদ্রের কাছেই। সকালবেলার নাশতা খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সেই সমুদ্র দেখার জন্য। সমুদ্র তো আছেই, আর আছে সুস্বাদু খাবারের আকর্ষণ। টাটকা সামুদ্রিক মাছের ফ্রাই এবং পেসকাদো সারান্দেয়াদো। পেসকাদো সারান্দেয়াদো হলো পছন্দের মাছটির পেট চিরে নাড়িভুঁড়ি বের করে কয়েক ধরনের মসলা ও পেঁয়াজের একটা আস্তর দিয়ে তা অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে মুড়িয়ে ফেলা। তারপর আগুনের আঁচে সেদ্ধ করা। আমার খুব পছন্দ এই আইটেমটা। তৈরি হওয়ার আগে আপনি টাটকা মাছটি নিজেই পছন্দ করে নিতে পারবেন। তারপর বাকি সব কাজ ওই রেস্তোরাঁর লোকেরাই করে দেবে। এরই মধ্যে অর্ধসেদ্ধ চিংড়ি মাছ কিংবা অন্য সব সিফুডের হালকা খাবার খেতে খেতে পান করতে পারেন বিয়ার অথবা তেকিলা। রেস্তোরাঁগুলো তেমন আহামরি কিছু নয়, বরং বলা যায় খুবই সাধারণ, কিন্তু খাবারের মান, স্বাদ আর উন্মুক্ত পরিবেশের কারণে তিহুয়ানা শহরের পাশে পর্যটন এলাকা রোসারিতোর এই পোপোত্লা আমার খুব প্রিয়। প্রতিদিন, বিশেষ করে শনি ও রবিবার এখানে মার্কিনদের ভিড় বেড়ে যায় খুব। কতোবার যে এখানে এসেছি, হিসাব নেই। আমার ছেলেটা তখন বেশ ছোট ছিল। ও তো পানির পাগল। আমি পারতপক্ষে পানিতে নামতাম না ঠান্ডার ভয়ে। কিন্তু সে জামাকাপড় খুলে দিব্যি পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। জলকেলি শেষে যখন উঠে আসতো, তখন দেখা যেত নাক থেকে শিকনি ঝরে পড়ছে। আর কাঁপছে। কিন্তু আনন্দ যা সঞ্চয় করার তা করে ফেলেছে বলে এই কাঁপুনি ওকে কাবু করতে পারছে না।
ওর বয়স আজ ১৫, পানিতে গড়াগড়ি খাওয়ার আকর্ষণ ও আনন্দে তার একটুও ঘাটতি নেই। সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে মেয়েটা। পানিতে দুজনের দাপাদাপি দেখলাম। তিহুয়ানা থেকে মেক্সিকোর দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত গুতিয়েরসেস সামোরায় আমার শ্বশুরবাড়িতে যখন গেলাম, সেখানেও এই দুই জলপান্ডবের দাপাদাপি অব্যাহত ছিল, যেহেতু শ্বশুরবাড়ি থেকে সমুদ্রসৈকত মাত্র ১৫ মিনিটের দূরত্বে। এটার নাম তেকোলুতলা সমুদ্রসৈকত।
এবারের সফর আমার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে মেক্সিকো সিটি দেখার অভিজ্ঞতার কারণে। অদ্ভুত ব্যাপার, টানা দশ বছর মেক্সিকোতে থাকলেও এই কিংবদন্তি শহরটি কখনোই দেখার সুযোগ পাইনি। শুধু তা নয়, সুযোগ হয়েছে তানভীরের আতিথেয়তার সূত্রে আমার আট বছরের বন্ধু মার্কো ফাব্রিসিওর সঙ্গে সরাসরি পরিচিত হবার। ই-মেইলে তার সঙ্গে ২০১০ সালে পরিচয়ের সূত্রপাত, বিভিন্ন সময়ে স্প্যানিশে রবীন্দ্রনাথের রচনা বা রবীন্দ্রবিষয়ক বহু লেখার হদিস সে আমাকে দিয়েছিল। ‘কানাল ওনসে’ (চ্যানেল ১১) বলে একটি বিখ্যাত টিভি চ্যানেলের সে সাংবাদিক। তার কাজের এলাকা ইতিহাস হলেও সাহিত্যে প্রবল আগ্রহ। মার্কোর হাত ধরেই এক সকালে শহর দেখতে বেরিয়ে পড়েছিলাম। তার মাধ্যমেই মেক্সিকোর মেট্রো-ট্রেনে চড়ার প্রথম অভিজ্ঞতা আমার। বোধ হয় ২০/২৫ মিনিট পরে সুড়ঙ্গ পথ বেয়ে আমরা আবির্ভূত হলাম শহরের ঐতিহাসিক সব স্থাপত্যের কাছাকাছি। একদিকে বেইয়াস আর্তেস (চারুশিল্প ভবন) অন্যদিকে পালাসিও। এগুলো সত্যিই দেখার মতো ভবন। কিন্তু মার্কো আমাকে নিয়ে গেল আমার আগ্রহের মূল কেন্দ্র বইয়ের রাজ্যে। বেলা ১১টায় বোধ হয় পৌঁছেছিলাম ওখানে। যে সড়কটির দুপাশে বইয়ের দোকানগুলো গড়ে উঠেছে, সেটার নাম কাইয়ে দন্সেলেস। এই সড়কের উল্লেখ আমি প্রথমে দেখতে পাই কার্লোস ফুয়েন্তেসের ‘আউড়া’ নামক এক ছোট উপন্যাসে। উপন্যাসে বর্ণিত জায়গার সঙ্গে বাস্তবে পরিচিত হওয়ার আনন্দ ও শিহরণ কে না অনুভব করে! আমার জন্য বইয়ের রাজ্য মানেই স্বর্গ। হোর্হে লুইস বোর্হেসের একটি কবিতায় পড়েছিলাম এই বইয়ের রাজ্যের কথা: টু থিংক আই হ্যাড ইমাজিন্ড প্যারাডাইস/ ইন দ্য ফর্ম অব সাচ আ লাইব্রেরি। আমি এই কাইয়ে দন্সেলেসে এসে যেন সেই জান্নাতের সাক্ষাৎ পেলাম। এখানে দেখতে পাচ্ছি বেশির ভাগ, বলতে গেলে প্রায় সবই পুরোনো বইয়ের দোকান। আর বিস্ময়কর তথ্য হলো একেকটি দোকানে ঠাসা রয়েছে লাখ লাখ বই। নতুন বইয়ের দোকানের তুলনায় পুরোনো বইয়ের দোকানের প্রতি আমার বেশি আগ্রহ সব সময়ই। এমনকি স্প্যানিশ সাহিত্য পাঠের ক্ষেত্রেও আমার আগ্রহ বুম-পূর্ববর্তী লেখকদের প্রতি। এই এলাকায় দুটি দিন কাটিয়েছিলাম বই দেখে এবং পছন্দের বইগুলো কিনে। এবং দুদিনই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিলাম। এখানেই পেয়ে গিয়েছিলাম আমার প্রিয় লেখক অক্তাবিও পাসের সাক্ষাৎকারের একটি বই, ‘এল পয়েতা এন সু তিয়েররা’। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ব্রাউলিও পেরাল্তা। পাসের সাক্ষাৎকারের বই আছে অনেক, কিন্তু এই বইটি আমার কাছে বিশেষ কারণে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। কারণটা হলো পাস এখানে ‘ভিসলুম্রে দে লা ইন্দিয়া’ বইটির সূত্রে আরও এমন কিছু কথা বলেছেন, যা তার অন্য কোনো লেখায় বা সাক্ষাৎকারে নেই। পেয়ে গিয়েছিলাম বোর্হেসকে নিয়ে আস্ত হোসে এমিলিও পাচেকোর লেখা একটি বই। যে কার্লোস মনসিবাইসের সঙ্গে পাসের রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে বিরোধ হয়েছিল, একসময় তিনিও যে পাসকে নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন, তা আমার জানা ছিল না। কিন্তু আমি আশ্চর্য হয়েছি পাচেকো আর মনসিবাইসের বই দুটোর মুদ্রণসংখ্যা দেখে। দুটোরই মুদ্রণসংখ্যা এক লাখ। এ ধরনের প্রবন্ধের বইয়ের মুদ্রণসংখ্যা এমন হওয়া মানে স্প্যানিশ ভাষায় আছে বিপুল মননশীল পাঠক। দুটোই ’৯৯ সালে প্রকাশিত।
আমার সন্দেহ ছিল মানুষ ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, ই-বুক ও কিন্ডলের যুগে প্রবেশ করে হয়তো কাগজনির্ভর বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু তা হয়নি। কাইয়ে দন্সেলেসের এই বিপুল বইয়ের সম্ভার দেখেই তা টের পাওয়া যায়। বোঝা যায় মানুষের হাতে বইয়ের দৃশ্য দেখেও। মেক্সিকো সিটির সেন্ট্রাল কামিওনেরা, মানে বাস টার্মিনালে দেখা একটা দৃশ্য আমাকে সেই সাক্ষ্য দিয়েছে। বাসের জন্য অপেক্ষা করছি আমি। কৌতূহলবশত আশপাশে চোখ বোলাতেই দেখতে পেলাম অল্প যে কজন তরুণ-তরুণী বাসের অপেক্ষায় বসে আছে, তাদের অনেকেই বই পড়ছে।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক
ছবি: লেখক