ইভেন্ট I বাংলাদেশ কতুর উইক ২০২১
২ থেকে ৪ ডিসেম্বর ২০২১। রাজধানীর গুলশান নর্থ অ্যাভিনিউর ওয়াটার এজ গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ কতুর উইক ২০২১’। আয়োজক ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ (এফডিসিবি)। তিন দিনের এই আয়োজনের মূল বিষয় ছিল রেশমি কাপড়, যা সিল্ক নামেই বেশি পরিচিত। উদ্দেশ্য ছিল রেশম কাপড় যারা পরম যত্নে তৈরি করেন, তাদের সম্মান জানানো এবং সেই সঙ্গে দেশের এই সম্পদকে বিশ্ব দরবারে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পণ্য হিসেবে তুলে ধরা।
এফডিসিবির প্রেসিডেন্ট মাহিন খান বলেন, ‘অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের আট বছরের পথচলা। খাদি দিয়ে শুরু। সেখান থেকে ফ্যাশন উইক বাংলাদেশের যাত্রা। খাদির সঙ্গে মিশে রয়েছে বাঙালির স্বাধীনতার আদি ইতিহাস। তাই আশা করছি, আবারও ফিরতে পারব খাদির কাছে। খাদির পরে আমরা কাজ করেছি টাঙ্গাইলের তাঁত নিয়ে। এবার কাজ করছি দেশীয় রেশম ফ্যাব্রিক নিয়ে।’
কতুর উইক আয়োজনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কতুর মূলত ফরাসি শব্দ। এর বাংলা করলে দাঁড়ায় সমৃদ্ধ পোশাক। আমাদের প্রথম কতুর শো এর আয়োজন তাই দেশীয় সিল্ক নিয়ে। মূল্যবান এই ফ্যাব্রিকের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। যেমনটা যত্নে সিল্ক বোনা হয়, ঠিক ততোটাই যত্নে সিল্কের প্রতিটি পোশাক তৈরি করা হয়েছে এবারের বাংলাদেশ কতুর উইকের জন্য।’
এফডিসিবির জেনারেল সেক্রেটারি শৈবাল সাহা। কতুর উইকে ফ্যাব্রিক হিসেবে রেশমি ফ্যাব্রিক বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘রেশমে তৈরি সিল্ক আমাদের দেশের ঐতিহ্য। কিন্তু বর্তমানে সিল্কের বাজারে ভাটার টান। এখন মাত্র তিন শ তাঁতি কাজ করছেন রেশম ফ্যাব্রিক নিয়ে। অথচ কয়েক বছর আগেও পাঁচ-ছয় শ তাঁতি এনিয়ে কাজ করতেন। সিল্কের বাজারের দিকে তাকালেও মন খারাপ করতে হয়। বাড়ছে দাম, কমছে চাহিদা। অথচ একসময় ঐতিহ্যবাহী এ ফ্যাব্রিকে বোনা শাড়ির দারুণ কদর ছিল। রাজশাহী সিল্কের অবস্থান ছিল তালিকার শীর্ষে। স্বর্ণালি সেই দিনগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। রেশম সুতার সেই পুরোনো ঐতিহ্য আবার ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যেই এবারের কতুর উইকে বেছে নিয়েছিলাম সিল্ক।’
দেশবরেণ্য ১৭ জন ফ্যাশন ডিজাইনার অংশ নেন এফডিসিবি আয়োজিত কতুর উইক ২০২১ এ। মাহিন খান, চন্দনা দেওয়ান, এমদাদ হক, শৈবাল সাহা, লিপি খন্দকার, শাহরুখ আমিন, ফাইজা আহমেদ, ফারাহ আনজুম বারী, সারাহ্ করিম, ফারজানা নোভা, তাসফিয়া আহমেদ, সাদিয়া রশিদ চৌধুরী, রিফাত রহমান, রূপো শামস্, আফসানা ফেরদৌসী, রিমা নাজ ও নওশিন খায়ের। ডিজাইনারদের নকশা করা পোশাক দেখা গেছে প্রদর্শনী এবং দুটি ফ্ল্যাশ ফ্যাশন শোর মাধ্যমে। এতে ফ্যাশনবোদ্ধাদের সামনে তুলে ধরা হয় ডিজাইনারদের কাজের হাইলাইটগুলো। এবারে প্রদর্শিত সব পোশাকে পিওর সিল্কের পাশাপাশি দেখা গেছে দুপিয়ন, টাফেটা, অরগাঞ্জা এবং এন্ডির মতো ফ্যাব্রিকগুলোও।
মাহিন খান। দেশের শীর্ষস্থানীয় এ ডিজাইনারের কাজে সমসাময়িকতার সুস্পষ্টতা নজর কাড়ে বরাবরই। এমব্রয়ডারি, ফ্যাব্রিক, অ্যাকসেসরিজের আধুনিক উপস্থাপনে একেকটি পোশাক তখন পরিণত হয় স্টেটমেন্ট পিসে। বাংলাদেশে কতুর উইক ২০২১ এ ‘আ স্ট্র্যান্ড অব সিল্ক’ নামের কালেকশন নিয়ে হাজির হয়েছিলেন তিনি। প্রতিটি পোশাকের রং প্রকৃতিপ্রাণিত, আর্দি টোনের। এমব্রয়ডারিতে চিরাচরিত ধারাকে ভেঙে ফুটিয়ে তুলেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে। কালেকশনে নজর কেড়েছে বলেরো ও জ্যাকেট। তাতে সুনিপুণ এমব্রয়ডারির সূক্ষ্মতা যেন প্রাণ জুগিয়েছে এই পিসগুলোতে। শাড়ির সঙ্গে এগুলোর উপস্থাপনে তৈরি হয়েছিল স্টেটমেন্ট স্টাইল। শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে বটুয়া ব্যাগও দেখা গেছে কালেকশনে। এগুলোর প্যাটার্ন ও এমব্রয়ডারির নতুনত্ব পুরো কালেকশনে যোগ করে অন্যতর আভিজাত্য।
কতুর উইক উপলক্ষে ডিজাইনার শৈবাল সাহার কালেকশনের থিম ছিল ‘দ্য গোল্ডেন গডেস’। ‘প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কঠিন সময় পার করেছি আমরা। হতাশাগ্রস্ত সময়ে শান্তি খুঁজেছি প্রকৃতির কাছে। সেই দিনগুলোর কথা মনে করে বেছে নিয়েছি এই থিম। রং হিসেবে ছিল সোনালি। তুলে ধরেছি পোশাকের কালো ক্যানভাসে। সোনালি রং এখানে ব্যবহার করা হয়েছে শক্তির প্রকাশিত রূপ হিসেবে। নতুন ভোরের প্রথম আলোয় আমরা দেখতে পাই সূর্যের সোনালি রং। কালোকে আলো করে প্রকাশিত সোনালি রং। অলংকরণের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম শিবুরী। প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করেছি সব পোশাকে। বরাবরের মতো এবারও আমার নকশায় হ্যান্ড এমব্রয়ডারি প্রাধান্য পেয়েছে। নকশিকাঁথার ফোড় ব্যবহারে সম্পন্ন হয়েছে অলংকরণ,’ বলেন শৈবাল সাহা।
ডিজাইনার এমদাদ হক কাজ করেছেন বিভিন্ন ধরনের সিল্ক নিয়ে। এগুলোর মধ্যে আছে এন্ডি এবং অরগাঞ্জা। থিম হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন কাঁথা। প্রতিটি পোশাক একই থিমে তৈরি করা হয়েছে। রঙের ব্যবহার ছিল নান্দনিক। মভ, লাল, বাদামি এবং কালো রঙের ব্যবহার দেখা গেছে বেশি। অলংকরণে কাঁথার নকশার সঙ্গে সঙ্গে চুমকি এবং সিক্যুইনের কাজ ছিল। ‘লেস ইজ মোর’ বাক্যটি তিনি মাথায় রেখেছেন পোশাকগুলো নকশা করার সময়ে। কতুর শো বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কতুর শো আয়োজন করার পেছনে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এফডিসিবির ডিজাইনারদের হ্যান্ড মেইড এবং হ্যান্ড ক্রাফটেড পোশাক ফ্যাশনবোদ্ধাদের সামনে নিয়ে আসা।’ তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমরা ভবিষ্যতেও কতুর শো আয়োজনের ইচ্ছা রাখি। যত্নের সঙ্গে হাতে তৈরি পোশাক মানুষের সামনে নিয়ে আসার জন্য এ ধরনের আয়োজন জরুরি। এফডিসিবির প্রথম কতুর শো উপলক্ষে আমরা একটি বই প্রকাশ করেছি। দেশীয় ইতিহাসের এই আয়োজন লিপিবদ্ধ রাখার জন্য। আশা করছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটি তথ্যবহুল বই হিসেবে বিবেচ্য হবে।’
কতুর উইকে ফ্যাশন ডিজাইনার লিপি খন্দকার ফ্যাব্রিক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন রাজশাহী সিল্কের কয়েকটি ধরন। এগুলো হচ্ছে এন্ডি, র সিল্ক এবং সিল্ক অরগাঞ্জা। রেশমি কাপড়ের ভিন্ন ভিন্ন ধরনে কাজ নিয়ে তৈরি কালেকশনের থিম ছিল কালারস অব লাইফ। উজ্জ্বল সব রঙের দুর্দান্ত রূপ তিনি তুলে ধরেছেন কালো রং রেশমের ক্যানভাসে। পোশাকে নজর কেড়েছে অ্যাসিমেট্রিক্যাল সব প্যাটার্ন।
ফ্যাশন ডিজাইনার চন্দনা দেওয়ান বলেন, ‘এফডিসিবির এবারের আয়োজনে আমি ব্যবহার করেছি অরগাঞ্জা সিল্ক। অলংকরণে প্রাধান্য পেয়েছে প্যাচওয়ার্ক। একই সঙ্গে ছিল জারদৌসির কাজ, যা হাতে করা হয়েছে। ইস্ট এবং ওয়েস্টের ফ্যাশন একত্র করে এবারের পোশাক নকশা করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এফডিসিবি থেকে আমাদের চাওয়া ছিল দেশের পঞ্চাশতম বছরকে বিশেষভাবে উদ্যাপন করে বিশ্বের কাছে তুলে আনা। রেশমি কাপড় বাংলাদেশের একটি সম্পদ। বিশ্ব দরবারে এই পণ্যকে উপস্থাপন আমাদের দায়িত্ব।’
ডিজাইনার শাহরুখ আমিন করোনাকাল কতটা উপলব্ধি করেছেন, তা বোঝা গেছে কতুর উইক ২০২১-এ তার পোশাক নকশার থিমের বিস্তারিত শুনে। শাহরুখের নকশার পোশাকের জমিনে ফুলের ছড়াছড়ি। কেন এই বিচ্ছিন্নতা? উত্তরে ডিজাইনার জানালেন, অতিমারিতে একজনের থেকে অন্যজনের বিচ্ছিন্ন হওয়ার অনুভূতি আলোড়িত করেছিল তাকে। প্রিয়জনের থেকে দূরে সরে যাওয়া নিয়ে তখন ভেবেছেন তিনি। মিল পেয়েছেন প্রকৃতির সঙ্গে। সকালবেলা যখন ফুল ঝরে পড়ে, তখন একটা থেকে অন্য ফুলের দূরত্ব ভাবিয়েছে তাকে। সেই সময়টাকেই তিনি তুলে এনেছেন পোশাকে। মসলিন আর সফট সিল্ক ব্যবহারে তিনি তৈরি করেছেন এবারের কালেকশন। শিরোনাম ছিল ‘ট্যাপেস্ট্রি অব বোটানি’। চারটি রং নিয়ে তিনি কাজ করেছিলেন এবার। পিচ, মিন্ট গ্রিন, অফ হোয়াইট আর পিংক। প্রকৃতির মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় এই রংগুলো। কতুর উইকে পাওয়া গেছে শাহরুখ আমিনের সিগনেচার কালেকশন। ‘ট্যাপেস্ট্রি অব বোটানি’র আরও একটি বিশেষত্ব আছে। সম্পূর্ণ কালেকশন হ্যান্ড মেইড। হাতের কাজে তৈরি। নেই কোনো মেশিনের স্পর্শ।
ডিজাইনার ফারাহ আনজুম বারী পোশাক ডিজাইনের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন নিউ নরমালকে। কঠিন সময় পাড়ি দিয়ে নতুন করে জীবনযাপনের উৎসাহে তৈরি তাঁর কালেকশন। ফ্যাব্রিক ম্যানুপুলেশনের মাধ্যমে পোশাকে নকশা ফুটিয়ে তুলেছেন এই ডিজাইনার। তিনি বলেন, ‘এবারের কতুর শোতে আমরা সিল্কের বিভিন্ন প্রকারকে তুলে এনেছি। আমার কাজের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছি দুপিয়ন, এন্ডি, সফট সিল্ক, মসলিন। দুই বছর ধরে বিশ্বজুড়ে চলেছে করোনার ঢেউ, সেই সময় মনে রেখে আমার কালেকশনের শিরোনাম দিয়েছি “রিপেলস”। পাইপ ওয়ার্ক এবং ফ্যাব্রিক ম্যানুপুলেশনের মাধ্যমে সেই সময়টা তুলে আনার চেষ্টা করেছি।’
কতুর উইক ২০২১ উপলক্ষে প্রদর্শনীর শেষ দিনে ছিল বইয়ের মোড়ক উন্মোচন এবং ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী। এবার শিলু আবেদ অ্যাওয়ার্ড ইন এক্সিলেন্স ইন ক্রাফটস পদকে ভূষিত হয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের লহরপুরের বয়নশিল্পী মন্টু চন্দ্র দাস। জীবনযাপনের অংশ হিসেবে যারা ফ্যাশনকে আপন করে নিয়েছেন, তাদেরও দেওয়া হয়েছে সম্মাননা। স্টাইল ট্রেন্ড মেকার হিসেবে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন বাংলা চলচ্চিত্রের নায়ক সিয়াম আহমেদ। তরুণ সংগীতশিল্পী জেফার রহমানকে দেওয়া হয় মোস্ট স্টাইলিশ মিউজিক স্টারের সম্মাননা। স্টাইল ট্রেইলব্লেজার অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন কোরিওগ্রাফার আজরা মাহমুদ। এ ছাড়া স্টাইল গেম চেঞ্জার হিসেবে অভিনেতা এবং সংগীতশিল্পী তাহসান খান, মোস্ট স্টাইলিশ পারসোনালিটি চিকিৎসক ঝুমু খান, স্টাইল ইনোভেটর সংগীতশিল্পী মেহরীন মাহবুব, মোস্ট স্টাইলিশ পারসোনালিটি ব্যারিস্টার শুক্লা সারওয়াত সিরাজ এবং রূপবিশেষজ্ঞ ফারজানা শাকিল, স্টাইল গেম চেঞ্জার অভিনেত্রী জয়া আহসান এবং স্টাইল হল অব ফেম হিসেবে অভিনেত্রী শম্পা রেজাকে অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়।
কতুর উইকে বিভিন্ন পেশার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অ্যাওয়ার্ড প্রদানের বিষয়ে মাহিন খান বলেন, ‘ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশের ব্যানারে আমরা নিয়মিত দেশীয় পোশাকশিল্পের জন্য কাজ করে আসছি। একই সঙ্গে আমরা চিন্তা করেছি যে সফল ব্যক্তিরা আমাদের দেশের পোশাককে নিজেদের নিত্যদিনের জীবনযাপনের অংশ করে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, তাদের প্রতি সম্মান জানানোর আয়োজন করা যেতে পারে। সেখান থেকেই এই অ্যাওয়ার্ডের আয়োজন।’
সারাহ্ দীনা
ছবি: এফডিসিবি