টেকসহি I শিকারির নাম গ্রিনওয়াশিং
শব্দটা শুনতে দারুণ লাগলেও এর শিকার আমি, আপনি বা সচেতন ক্রেতা—সবাই। তা নিয়েই বিস্তারিত
ইনভেস্টোপিডিয়ার সংজ্ঞা অনুযায়ী গ্রিনওয়াশিং হলো কোনো প্রতিষ্ঠানের পণ্য কতটা পরিবেশগতভাবে ভালো, সে সম্পর্কে ভুল তথ্য সরবরাহ করার প্রক্রিয়া বা বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়ার কৌশল। গ্রিনওয়াশিং হলো পণ্য সম্পর্কে অপ্রমাণিত দাবি, যেটায় ভোক্তাকে প্রতারিত করা হয় কোনো পণ্য পরিবেশবান্ধব বলে গছিয়ে দিয়ে।
১৯৬০-এর দশকে এই ধারণার উৎপত্তি হয়েছিল একটি হোটেল থেকে। তারা পরিবেশ রক্ষার দোহাই দিয়ে হোটেল রুমের টাওয়েল না ধুয়ে আবার ব্যবহারের নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়েছিল। অবশ্য এতে হোটেলের লন্ড্রি খরচের সাশ্রয় হয়েছিল অনেকখানি। ১৯৮৬ সালে জে ওয়েস্টারভেল্ট এই ধারণার নামকরণ করেন গ্রিনওয়াশিং।
ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিও এর বাইরে নয়। পরিবেশসচেতন, পরিবেশবান্ধব, টেকসই—এই ধরনের সবুজায়িত বিশেষণ দেখা যায় বিভিন্ন ব্র্যান্ড বা প্রতিষ্ঠানে। জলবায়ু সংকটে সাড়া দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে আসা বেশ ইতিবাচক হলেও, ক্রেতা আসলেই দায়িত্বশীল ভোক্তায় পরিণত হচ্ছেন, নাকি গ্রিনওয়াশিংয়ের শিকার হচ্ছেন, তা বোঝা বেশ দুষ্কর। সাসটেইনেবল অ্যাপারেল কোয়ালিশনের মতে, কোনো কিছুকে টেকসই বলে প্রমাণ ছাড়াই বেশ সহজে পার পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু সব সময় এগুলো আসল ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য দেয় না। এর ফলে ভোক্তারাও সমস্যার সম্মুখীন হন।
ইন্টারন্যাশনাল কনজ্যুমার প্রটেকশন অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্ক (আইসিপিইএন) ৬৫টি দেশে গ্রিনওয়াশিং গাইডেন্স নিয়ে কাজ করলেও বাংলাদেশে এমন কোনো সংস্থা নেই। তারা আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে গ্রিনওয়াশিংয়ের তথ্য-প্রমাণ পেলে প্রতিষ্ঠান ও ভোক্তাদের সতর্ক করে দেয়। সম্প্রতি তারা ইউরোপ-আমেরিকার অনলাইন শপগুলো নিরীক্ষা করে দেখে, সেগুলোর প্রায় অর্ধেক (৪৫ শতাংশ) প্রকৃতিবান্ধব বলে দাবি করা পণ্যই ভোক্তাদের ঠকিয়ে চলেছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ওয়াচডগ সংস্থা কম্পিটিশন অ্যান্ড মার্কেট অথরিটি (সিএমও) বলছে মোট ক্রেতার অর্ধেকের বেশি এসব দাবি মাথায় রেখে ভুল পণ্য কিনতে প্ররোচিত হন।
ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে গ্রিনওয়াশিংয়ের প্রবণতা প্রবল। গত কয়েক বছরে এইচঅ্যান্ডএম, বুহু, অ্যান্ড আদার স্টোরিজ, প্রাইমার্ক, অ্যাসোস, জারার মতো বড় ব্র্যান্ড এই দোষে দোষী হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বে ওয়াচডগ প্রতিষ্ঠানগুলো দুটো বিষয় নিয়ে কাজ করছে—বিভ্রান্তকর পরিবেশবান্ধব দাবি থেকে ক্রেতাদের সচেতন করা এবং পরিবেশবান্ধব দাবি করা ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক বাজার গড়ে তোলা। ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো ‘ইকো’, ‘অর্গানিক’, ‘সাসটেইনেবল’, ‘রিসাইকলড’—এই শব্দগুলোর বাইরে কিছু করছে না, আবার এগুলোর যথেচ্ছ ব্যবহার করে চলেছে। এই যথেচ্ছ ব্যবহারের পরিবর্তে একটা গাইডলাইন তৈরির পরিকল্পনা আছে বলে আইসিপিইএন ও সিএমও জানিয়েছে। পাশাপাশি সাপ্লাই চেইনের প্রতিটি ধাপে কী ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে, সেটাও সমাধান করার কথা ভাবছে তারা। বিশেষত যে ব্র্যান্ডগুলো একাধিক দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করে, তাদের মধ্যে এ ধরনের সমস্যা হয় সবচেয়ে বেশি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো এক প্রতিষ্ঠান হয়তো তাদের পোশাক তৈরি করছে বাংলাদেশ, চীন বা ভিয়েতনামে, কিন্তু ব্র্যান্ডিং করছে—তাদের পণ্য ইউরোপীয় কোনো এক কারখানায় তৈরি। এশীয় তৃতীয় বিশ্বের কারখানা আর ইউরোপীয় কারখানার মানদন্ড, পরিবেশ এক নয়। এসব ক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো সংস্থা দিয়ে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা হচ্ছে। তবে এগুলোর বাস্তবায়নে কঠোর জরিমানার কথা বলা হচ্ছে, এই উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও ইউরোপে গ্রিন গাইডলাইন করা হয়েছে।
এ থেকে রক্ষা পেতে ছয়টি সাবধানতা অবলম্বনের কথা বলেন ব্র্যান্ড বিশেষজ্ঞরা। প্রথমত সংখ্যার দিকে নজর দিন, কথায় নয়। ব্র্যান্ডটি গ্রিনওয়াশিং করছে কি না, সেটা বোঝার সবচেয়ে সহজ তরিকা হলো তাদের দাবির সমর্থনে গাণিতিক সাক্ষ্য-প্রমাণ খতিয়ে দেখা। প্রতিষ্ঠানগুলো ‘টেকসইভাবে তৈরি’ বা ‘পরিবেশবান্ধব’ ট্যাগ লাগিয়ে দেয় পণ্যে। কিন্তু তাদের মোট উৎপাদনের কতটুকু রিসাইকলড জিনিস দিয়ে তৈরি বা কতটুকু এনার্জি রক্ষা করছে, সেটার পরিসংখ্যান জানারও প্রয়োজন রয়েছে।
দ্বিতীয়ত প্রাকৃতিক মানেই পরিবেশবান্ধব নয়। ভিসকস, রেয়ন ও বাঁশের মতো উপকরণকে পরিবেশবান্ধব বলা হলেও তা পুরোপুরি নির্ভর করে সেগুলো কোথায় কীভাবে জন্মেছে ও বেড়ে উঠেছে আর কীভাবে তা সংগ্রহ করা হয়েছে তার ওপর। যেমন প্রতিবছর ভিসকস উৎপাদন করতে গিয়ে পৃথিবীতে মোট ১৫ কোটি গাছ কাটা পড়ে। সে কারণে ভিসকসকে বলা হয় বন বিনাশকারী। অবশ্য সনদপ্রাপ্ত নির্দিষ্ট এলাকা থেকে গাছ কাটা হলে সেটা ভিন্ন ব্যাপার। একই সঙ্গে বাঁশ দ্রুত বেড়ে ওঠে, কিন্তু প্রায়ই লালন-পালনের সময়ে তাতে কীটনাশক, সার আর তন্তুতে পরিণত করতে রাসায়নিক ব্যবহার করতে হয়। ফলে জৈব উৎস থেকে সংগৃহীত না হলে বাঁশও অবিশ্বাস্য দূষণের কারণ। কোন ধরনের টেক্সটাইল পরিবেশে কী ধরনের প্রভাব ফেলে, তা জানার চেষ্টা করুন। কীভাবে এবং কোথা থেকে উপকরণ সংগ্রহ করা হয়েছে, সেটা সম্পর্কে যত পরিষ্কার ধারণা থাকবে, সেগুলো কতটা টেকসই আর সেগুলোর সুবিধা-অসুবিধা আরও বেশি জানার সুযোগ তৈরি হবে।
তৃতীয়ত ভেগান হয়ে যাওয়াটাও টেকসই সমাধান নয়। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে চামড়া ও পশমের সিনথেটিক বিকল্প ব্যবহারের কথা বলা হয় প্রায়ই। এগুলোকে অনেকেই টেকসই বা সাসটেইনেবল দাবি করে। কিন্তু সেগুলো বেশির ভাগ সময়েই তেল থেকে তৈরি হয়, যা পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকর। অনেকেই প্রাণী রক্ষার দোহাই দিয়ে এগুলো কেনেন; অথচ এই প্রাণী রক্ষায়ও বলি হচ্ছে পরিবেশ। ভেগান চামড়া ও কৃত্রিম পশম দায়িত্বের সঙ্গে পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব না ফেলেও তৈরি করা সম্ভব।
চতুর্থত কে তৈরি করছে আপনার পোশাক, সেটা জানা জরুরি। ব্র্যান্ডগুলো পণ্য সরবরাহকারীদের নিয়ে দিন দিন প্রচারণা বাড়িয়ে চললেও তাদের ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের আসল চিত্র সম্পর্কে ধোঁয়াশা তৈরি করে রাখে। শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার স্বাধীনতা আছে কি না বা ঠিকঠাক মজুরিটা পান কি না, সাধারণত তা জানা যায় না। তাই ব্র্যান্ডগুলো এই ব্যাপারে কতটা স্বচ্ছ, জানা প্রয়োজন।
পঞ্চমত তাদের সার্টিফিকেট পরীক্ষা করা। প্রতিটি পণ্যেরই ইন্ডাস্ট্রি স্ট্যান্ডার্ড সার্টিফিকেট থাকে তাদের দাবির বিপরীতে। টেক্সটাইল শিল্পে পরিবেশগত স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার জন্য ব্লুসাইন, বায়োডিগ্রেডেবল পণ্যের জন্য ক্রেডল টু ক্রেডল, ফেয়ার ট্রেড টেক্সটাইল স্ট্যান্ডার্ড থাকে পুরো সাপ্লাই চেইনের কর্মীদের সুরক্ষা আর ক্ষমতায়নের জন্য। অর্গানিক কটনের জন্য গ্লোবাল অর্গানিক টেক্সটাইল স্ট্যান্ডার্ডের সার্টিফিকেট থাকে।
ষষ্ঠত কোনো ব্র্যান্ডকে সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করতে হবে। যারা সামগ্রিকভাবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে, নির্দিষ্ট ব্যাপারগুলোকে নিয়ে পড়ে থাকে না, তাদের পণ্য কেনা যেতে পারে।
গ্রিনওয়াশিং বাংলার ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে বলেকয়ে নেই। তবে যে হারে কাপড়ের কলগুলো আমাদের দেশের মাটি, পানির প্রবাহ আর বাতাস দূষণ করছে, কদিন পর বলেকয়েই আসবে এটা। আর আমাদের ক্রেতাদের মধ্যে যারা খানিকটা পরিবেশবাদী, তারা অজান্তেই শিকার হয়ে যাচ্ছেন গ্রিনওয়াশিংয়ের। বলে রাখা ভালো, আমাদের এখানে কৃষিতে গ্রিনওয়াশিং চলছে বহুকাল ধরে, অর্গানিকের নাম দিয়ে। অন্যদিকে, কিছুদিন আগে এক সাবান কোম্পানি এ দেশে এক সাবান বাজারে এনেছিল অর্গানিক বলে, কিন্তু বাইরে রপ্তানির সময়ে তার মোড়ক বদলে লেখা হচ্ছে হ্যান্ডমেইড। কারণ, ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে অর্গানিক সার্টিফিকেশন ছাড়া রপ্তানি করা সম্ভব নয় এটা। তার মানে, এ হলো পরিষ্কার আরেকখানা গ্রিনওয়াশিং!
আল মারুফ রাসেল
ছবি: ইন্টারনেট