ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I কার-ফ্যাশন কোলাবোরেশন
বিশ্বকাঁপানো কার ব্র্যান্ডগুলোর লিমিটেড এডিশন মার্চেন্ডাইজের মার্কেট এখন তুঙ্গে। অন্যদিকে ফ্যাশন মোঘলরা ইতিমধ্যেই কারিগরি দেখিয়েছে গাড়ির অন্দর থেকে এক্সক্লুসিভ সব পার্টস ডিজাইনিংয়ে। ফলাফল—উন্মুক্ত হয়েছে বাণিজ্যের নতুন বাজার। লিখেছেন সারাহ্ দীনা
গাড়িও যে ফ্যাশনের অনুষঙ্গ হতে পারে, এটা আগেই বুঝে গিয়েছিল বেশ কিছু কার ব্র্যান্ড। ফলে ক্রেতার চাহিদার কথা মাথায় রেখে লাইফস্টাইল অনুষঙ্গ তৈরিতেও মনোযোগী হয়ে ওঠে। তৈরি হতে শুরু করে গাড়ির ব্র্যান্ডের লাইফস্টাইল মার্চেন্ডাইজ। স্পোর্টসওয়্যার থেকে হাতে তৈরি হাই এন্ড ফ্যাশন অ্যাকসেসরিজ—গাড়ির ব্র্যান্ডগুলো সবখানেই খুঁজে পেতে শুরু করে ব্র্যান্ডপ্রেমী ক্রেতাদের। গাড়ির ব্র্যান্ড আর লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড একসঙ্গে কাজ করে তৈরি করে নেয় একটি ভিন্ন বাজার।
১৯৮৪ সালে বিখ্যাত কার ব্র্যান্ড পোজো এবং লাকোস্ট টেনিসের জন্য একসঙ্গে কাজ শুরু করে। দুটি ব্র্যান্ড একসঙ্গে আন্তর্জাতিক টেনিস টুর্নামেন্ট ‘রোলান্দ গ্যারোস’ আয়োজনের পৃষ্ঠপোষকতা করে। এই সিদ্ধান্ত পরবর্তীকালে পোজোকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। পোজোর গাড়িতে তখন দেখা গিয়েছিল একটি সিংহের সঙ্গে তিনটি কুমির দেওয়া লোগো। পোজোর সিংহ এবং লকোস্টের তিনটি কুমির স্থান পেয়েছিল স্টিয়ারিংয়ের ঠিক মাঝখানে। এর বাইরে লাকোস্ট রেয়ার পিলারসের জন্য তৈরি করে স্টিকার, হুইল কাভার ইত্যাদি।
বুগাতি আর এরমেস প্যারিসের কোলাবোরেশনের ছিল, দ্রুতগতির গাড়ির ব্র্যান্ডের সঙ্গে টপ নচ ফ্যাশন ব্র্যান্ডের যোগসূত্র। যা তৈরি করে নিয়মিত ক্রেতা। বুগাতির সঙ্গে ক্র্যাফটসমেনশিপ ব্র্যান্ড এরমেসের যৌথ উদ্যোগে তৈরি ‘বুগাতি চিরন এক্স এরমেস’ লঞ্চ হয় আটাত্তরতম জেনেভা ইন্টারন্যাশনাল মোটর শোতে। এটি তৈরির পেছনে উদ্দেশ্য ছিল শৌখিন গাড়ি এবং স্টাইল নিয়ে যারা ভাবছেন, তাদের আরও আগ্রহী করে তোলা। এই কালেকশনের শুধু একটি প্রোডাক্টই এখন দেখা যায়। যা এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির গাড়ি। গাড়িটির ইন্টেরিয়রে কাজ করেছে প্যারিসের এরমেস।
ফিয়াট ৫০০ সি বাজারে আসে ২০১১। এর সঙ্গেই সামনে আসে ফ্যাশন ব্র্যান্ড গুচির সিগনেচার টপ। গাড়িতে গুচির নিজস্বতা জানান দেয় সবুজ-লাল-সবুজ, এই তিনটি স্ট্রাইপ উপস্থিতি। হুইল সেন্টার কাভারও তৈরি করে গুচি। যেখানে ব্র্যান্ড নেম প্রকাশিত হয় দুটি জি-এর ব্যবহারে। ১৫ ইঞ্চির এই অ্যালুমিনিয়াম হুইল তৈরি করা হয়েছিল রেট্রোর উদ্দীপনায়। গাড়ির টু টোনড লেদার সিটও তৈরি করেছিল গুচি। সিট ব্যাক ও কুশন সেন্টারে লেখা হয়েছিল ‘এঁপপরংংরসধ’। ফ্রন্ট প্যাসেঞ্জার হেড রেস্ট্রেইন্সে ডাবল জি-এর মাধ্যমে গুচির ব্র্যান্ড ইন্টারলক করা হয়েছিল অ্যাম্বুশের মাধ্যমে। শিফট নবেও ছিল এমন লোগো অলংকরণ।
ইতালির বিখ্যাত গাড়ির ব্র্যান্ড মাসেরাতির ১০০ বছর উদযাপন উপলক্ষে আর একটি ইতালিয়ান ব্র্যান্ড এরমেনেযিলডো টাই আপ করে একসঙ্গে কাজ করে।
ল্যাম্বরগিনি। ইতালির লাক্সারি সুপার কার ব্র্যান্ডটি আমেরিকান স্কেটবোর্ডিং ব্র্যান্ডের সঙ্গে কোলাবোলেশনে তৈরি করেছে পোশাক এবং এর আনুষঙ্গিক পণ্য। শার্ট, হকি জার্সি এবং জ্যাকেট পেয়েছে জনপ্রিয়তা। এর সঙ্গে তৈরি হয়েছে মাংকি ক্যাপ এবং স্কেট বোর্ড। রং হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বোল্ড কালার। এর পেছনে রয়েছে বিশেষ কারণ। ল্যাম্বরগিনির পাওয়ার কারের ১২তম ভার্সনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এ রং বেছে নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। লোগো ব্যবহারের ক্ষেত্রে ছিল বাড়তি নজরদারি। ফলাফল, লাউড লোগো জায়গা করে নিয়েছে ল্যাম্বরগিনিতে।
ভক্সওয়াগন এবং অ্যাডিডাস একসঙ্গে মিলে তৈরি করেছে স্পোর্টস ক্লথিং এবং অ্যাকসেসরিজ। ভারসাচি আর ল্যাম্বরগিনিও তাদের পার্টনারশিপে তৈরি করেছে ঘড়ি, স্যুটকেস, শু এবং ড্রাইভিং গ্লভ।
আরমানি এবং মার্সিডিজ বেঞ্জ একসঙ্গে হয় ২০০৪ সালে। এর পেছনে কারণ ছিল সি এল কে ৫০০-এর জন্য একটি লিমিটেড এডিশন তৈরি। দুটি ব্র্যান্ডের মূল নীতিতে বেশ মিলে যাওয়ার কারণে এরপরে কাজের পরিধি বেড়েছে। ক্রেতাপ্রিয় ব্র্যান্ড জাগুয়ারের রয়েছে অ্যাপারেল প্রোডাক্ট। জ্যাকেট এর মাঝে অন্যতম।
বুগাতির ক্রেতাদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করে সোয়েটার, হেড ক্যাপ, ড্রাইভিং গ্লভসহ আরও বেশ কিছু পণ্য।
মেকলারেন সুপার কার তৈরির জন্য বিখ্যাত। অন্যদিকে দুঃসাহসিক কাজে আগ্রহীদের পছন্দের পোশাক ব্র্যান্ড বেলস্টাফ। এই দুটি ব্রিটিশ ব্র্যান্ড একসঙ্গে মিলে নিয়ে এসেছে দারুন একটি কালেকশন। নাম দিয়েছে ক্যাপসুল। এর বিশেষত্ব হচ্ছে পোশাকগুলোর কার্যকারিতার বিভিন্ন দিক। মূল উদ্দেশ্য ছিল মেকালারেনের চালককে স্বাধীনভাবে ড্রাইভ করতে সাহায্য করা। যেন পোশাকের কারণে গাড়ি চালাতে কোনো সমস্যা না হয়। এরগোনোমিক সিম লাইন পোশাকের সিমিং লাইনকে দারুণভাবে সামলেছে। নেকলাইন রাখা হয়েছে মিনিমাল। ফ্যাব্রিক স্ট্রেচেবেল হওয়ার কারণে জুতসই হয়েছে চালকের কাজ। লেদার জ্যাকেটের আর্মপিটে ব্যবহার করা হয়েছে পারফোরাটেড, অর্থাৎ ছিদ্রযুক্ত ফ্যাব্রিক। ফলে সহজ হয়েছে বাতাসের চলাচল। দেহের তাপমাত্রার ওপরে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। জ্যাকেটের পাশের অংশে ব্যবহার করা হয়েছে জার্সি ম্যাটেরিয়াল। ব্যবহৃত জিপারগুলো পানিনিরোধক। সব মিলিয়ে এমন পোশাক পরে আরামেই ড্রাইভিং করতে পারবেন পরিধানকারী।
ভেসপা ও ডিও, ৭৫ বছর আগে ব্র্যান্ড দুটির যাত্রা শুরু। দুটি ব্র্যান্ডেরই ফ্যানরা প্রথম থেকে আজও নিয়মিত। এই ইতালিয়ান স্কুটার এবং ফেঞ্চ ফ্যাশন ব্র্যান্ড দুটি মিলে টু হুইলার নিয়ে কাজ শুরু করে। তাদের এই উদ্যোগে বিলাসী নকশায় মুগ্ধ হয়েছেন ক্রেতারা। ডিওর ওমেন্স কালেকশনের ক্রিয়েটিভ হেড মারিয়া গ্রাজিয়া চলাচলের স্বাধীনতা উদযাপনের অংশ হিসেবে ভেসপা ৯৪৬-কে নান্দনিকভাবে সাজিয়ে তোলেন। সঙ্গে নকশা করেন ডিও প্যাটার্নের হেলমেট এবং লাগেজ সেট। এ ছাড়া তিনি লাগেজ র্যাককে নিয়ে আসেন এই কালেকশনের বিশেষ অনুষঙ্গ হিসেবে।
পোরশে ডিজাইনের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর পিয়েরে কস্টিন নকশা করেছেন মিনিমাল পোশাক। যেগুলো নকশা জাপান থেকে অনুপ্রাণিত। এ ছাড়া অ্যাকটিভ ওয়্যার, প্রিমিয়াম কিন্তু স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড পোলো টি-শার্ট, ভি-নেক সোয়েটার নিয়ে এসেছেন ক্রেতাদের জন্য। এর বাইরে অ্যাকসেসরিজও রয়েছে। আইওয়্যারের পাশাপাশি ফুটওয়্যারে আছে স্নিকারস। রয়েছে লাগেজও। নতুনভাবে পোরশে লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড তৈরির কাজে যুক্ত হয়েছে পুমার সঙ্গে।
কার ব্র্যান্ড বেন্ট লির রয়েছে জীবনযাপনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বিভিন্ন পণ্য। ব্রিটিশ এই ব্র্যান্ড তাদের পঞ্চম সুগন্ধি বাজারে এনেছে।
ফেরারি—পরিচিত প্রথম অরিজিনাল লাক্সারি ব্র্যান্ড হিসেবে। লোফার থেকে শুরু করে সানগ্লাস, অর্থাৎ টো টু টপের জন্য ফেরারির হরেক রকম পণ্য রয়েছে। ৬০টির মতো অ্যাপারেল এবং অ্যাকসেসরিজ ব্র্যান্ডের সঙ্গে ফেরারি আছে সঙ্গী হিসেবে।
মাসেরাতি এবং টেসলা—এই দুই ব্র্যান্ডের রয়েছে লেদার গুডস। অর্থাৎ পশুর চামড়া থেকে তৈরি পণ্য ব্রিফকেস থেকে ব্রেসলেট—সবখানেই পাওয়া যাবে এই দুই চাহিদাসম্পন্ন ব্র্যান্ডকে। আর উপাদান হিসেবে দুই জায়গায় লেদারেই রমরমা।
অ্যাস্টন মারটিনের সিইও অ্যান্ডি পালমার ২০১৭ সালে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, জেমস বন্ডের পছন্দের এই কার ব্র্যান্ডের সঙ্গে তৈরি করবেন লাইফস্টাইল ব্র্যান্ডও।
গাড়ির ব্র্যান্ড থেকে লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড, এই যাত্রায় আগ্রহী হচ্ছে বেশির ভাগ ব্র্যান্ড। দুটি সম্পূর্ণ আলাদা ব্যবসা হলেও এদের মধ্যে রয়েছে একটি মিল। জীবনযাপনের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এই দুটোই। বিলাসবহুল গাড়ি শুধু প্রয়োজন, এমনটি নয় বলেই ধারণা করা হয়ে থাকে; বরং বেশ খানিকটা শখ। এই শখ থেকেই ক্রেতার প্রিয় বস্তু হয়ে ওঠে গাড়ি। গাড়ির প্রতি আবেগের জায়গাও তৈরি হয় অনেকের মাঝে। সেখান থেকে প্রিয় গাড়ির লোগো এবং একই ব্র্যান্ডের পোশাক ও অনুষঙ্গে আগ্রহী হন ক্রেতারা। এর বাইরে আর একটি বিশেষ বিষয়কে উল্লেখ করা যেতে পারে; সেটি হচ্ছে বিশ্বাস। লাক্সারি কার কেনার সময় ব্র্যান্ডের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব জোরালো প্রভাব তৈরি করে। ‘লয়াল কাস্টমার’ কার ব্র্যান্ডের জন্য আশীর্বাদ। যার ফলে বিশ্বাসযোগ্য ব্র্যান্ডের অন্য প্রোডাক্টের প্রতিও সহজে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেন ক্রেতারা। আর ড্রাইভিং শুধু প্রয়োজন নয়, অনেকের প্রিয় সময়ের মাঝেও আছে এই কাজ। ড্রাইভিংকে আনন্দদায়ক কাজ বলে মনে করেন যারা, তাদের কাছে এই সময়ের জন্য উপযোগী উপাদান হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ। পোশাক এবং অনুষঙ্গ পায় আলাদা গুরুত্ব। ড্রাইভিং উপভোগ করতে সহজ-সরল ক্লথিং লাইন, আরামদায়ক এবং প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ জরুরি হয়ে ওঠে। প্রিয় গাড়ির প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা থেকে একই ব্র্যান্ডের ক্লথিং লাইনে এবং অ্যাকসেসরিজে ভরসার জায়গা তৈরি হয়। কারণ, ক্রেতার মনে বিশ্বাস তৈরি হয় একই ব্র্যান্ডের হওয়ার কারণে গাড়ি ব্যবহারকারীর চাহিদা বুঝতে পারবে প্রস্তুতকারী ব্র্যান্ডটি। তাই আস্থাতেই নিঃসঙ্কোচ ফিরে ফিরে আসা।
ছবি: ইন্টারনেট