ছুটিরঘণ্টা I টি প্ল্যান্টার্স সমাধির খোঁজে
বিভিন্ন দেশে সমাধিক্ষেত্র ঘিরে বছরজুড়ে লেগে থাকে পর্যটকদের আনাগোনা। সবচেয়ে বড় উদাহরণ মিসরের পিরামিড। রাষ্ট্রনায়কদের সমাধিক্ষেত্রও অনেক দেশে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। সেই তুলনায় আমাদের দেশের চিত্র কেমন? সিলেট বিভাগ ঘুরে প্রশ্নটির উত্তর খুঁজেছেন এলিজা বিনতে এলাহী
এই ভূখন্ডে যুগে যুগে পা পড়েছে ভিনদেশিদের। কোনো কোনো জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে দীর্ঘ শাসন পরিক্রমা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সংযুক্তি। সেই সুবাদেই পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাসের বিষয়টি যুক্ত হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাদের অনেকেই সমাহিত হয়েছেন এই মাটিতে। এ দেশের প্রায় সব জেলাতেই রয়েছে তাদের সমাধিস্থল।
গোটা দেশে ভিনদেশিদের সমাধিক্ষেত্রের হাল-হকিকত এই গদ্যে নেই। রয়েছে শুধু সিলেট বিভাগের টি প্ল্যান্টার্স সমাধিগুলোতে ঘুরে বেড়ানোর গল্প! এসব সমাধিস্থলের প্রতিটি সমাধি যেন একেকটি ইতিহাস। কতই না জানা-অজানা বার্তা লুকিয়ে রেখেছে! দুর্ভাগ্যক্রমে, দেশে ভিনদেশিদের সিমেট্রিবিষয়ক তেমন কোনো বইয়ের খোঁজ মেলেনি। রয়েছে তথ্যের অপ্রতুলতা। ভ্রমণপ্রেমী হিসেবে সরেজমিন যা দেখেছি এবং স্থানীয়দের কাছ থেকে যা শুনেছি, সেই সব কথা আর উপকথার তথ্যের ভিত্তিতেই এগিয়েছে এ লেখা।
ইতিহাসে উঁকি
এ দেশের চা পৃথিবীব্যাপী ‘সিলেট টি’ নামে খ্যাত। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের দশম চা উৎপাদনকারী দেশ আর রপ্তানিতে নবম। এই অঞ্চলে চাষের শুরুতে চা-বাগানের সিংহভাগ দখল ছিল ব্রিটিশ বণিকদের। মাইলের পর মাইল বিস্তৃত বাগানগুলোতে কাজ করার জন্য দরকার ছিল বিপুল শ্রমিক। বিহার, উড়িষ্যা, উত্তর প্রদেশসহ ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিম্নবর্ণের হিন্দু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে আসা হয় তখন। বংশপরম্পরায় তারা বাস করছেন এই ভূখন্ডে। বৃহত্তর সিলেটে শতাধিক চা-বাগানে এখন কাজ করেন প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার শ্রমিক। মোট শ্রমিকের প্রায় ৬৪ শতাংশই নারী।
আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর আগে চীনের সম্রাট শেন নাং চা আবিষ্কার করেন। ‘দ্য হারবাল ক্যানন অব শেন নাং’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়, চায়ের নির্যাসের রয়েছে ৭২ রকম বিষ দমনের ক্ষমতা। ১৬৬৭ সালে ব্রিটিশরা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চীন থেকে চা রপ্তানি শুরু করে। চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে ১৭৮০ সালে পরীক্ষামূলকভাবে চা-গাছ উৎপন্ন হয় কিড সাহেবের বাগানে। সেই বাগান এখন কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেন। কিড সাহেব কোম্পানিকে জানান, শিবপুর চায়ের জন্য উপযুক্ত নয়। রবার্ট ব্রুস ১৮৩৪ সালে আসামের উঁচু অঞ্চলে চা-গাছের সন্ধান পান। সিলেট অঞ্চলে ১৮৪৭ সালে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয়।
সে সময়কালে টি প্ল্যান্টাররা এ অঞ্চলজুড়ে বাগান গড়ে তোলেন। কোনো কোনো কর্মকর্তা পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস শুরু করেন এখানে। কেউ কেউ এই পরিক্রমায় সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে করেন মৃত্যুবরণ। তাদের কিছু সমাধিক্ষেত্র এখনো রয়ে গেছে এই বিভাগে। সিলেটে টিকে থাকা সমাধিভূমিগুলোর মধ্যে রয়েছে শ্রীমঙ্গলের ডিনস্টোন সিমেট্রি, হবিগঞ্জের বেগম খান সিমেট্রি, কুলাউড়ার লংলা চা-বাগান সিমেট্রি এবং শমশেরনগর সিমেট্রি। এ ছাড়া একটি-দুটি করে সিমেট্রি থাকার কথা লালাখাল চা-বাগান, ফুলতলা টি এস্টেট, ফেঞ্চুগঞ্জের মণিপুর চা-বাগান, কাপনাপাহাড় চা-বাগান এবং রাজকী চা-বাগানে। তবে লোকমুখে শুনলেও মণিপুর, কাপনাপাহাড় ও রাজকী চা-বাগানে কোনো সমাধি খুঁজে পাইনি। সিলেট বিভাগের এই সমাধিভূমিগুলোর সন্ধান পেয়েছি জন রাডফোর্ড ও সুসান মারিয়া ফ্যারিংটোনের লেখা ‘টম্বস ইন টি: টি গার্ডেন সিমেট্রিস সিলেট, বাংলাদেশ’ বই থেকে। এই জায়গাগুলো ঠিক তেমন জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র নয়। কিছু কিছু জায়গার সমাধিতে নেই কোনো নামফলক।
ডিনস্টোন সিমেট্রি
এই সমাধিক্ষেত্রের অবস্থান মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে। রাজঘাট ইউনিয়নের খেজুরীছড়ায় ফিনলে টি কোম্পানির চা-বাগানে। ১৮৮০ সালে এই অঞ্চলে ব্রিটিশরা বাণিজ্যিকভাবে চা-চাষ এবং ধীরে ধীরে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস শুরু করে। সে সময় অনেক কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা মারা গেলে এখানে তাদের সমাহিত করা হয়। সমাধিক্ষেত্রটি কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সঠিক জানা না গেলেও এখানে প্রথম সমাহিত করা হয় ১৮৮৫ সালের ৩০ আগস্ট, ব্রিটিশ নাগরিক রবার্ট রয় বেইলিকে।
ডিনস্টোন সিমেট্রিতে রয়েছে ৪৩ জন ব্রিটিশ নাগরিকের সমাধি। সেখানে থাকা একটি বোর্ডের লেখা থেকে এ তথ্য জেনেছি। সমাধিক্ষেত্রটি বেশ পরিচ্ছন্ন। সব কটি এপিটাফই শতবর্ষ পরেও রয়েছে অক্ষত। ঢাকার নারিন্দা কবরস্থানের মতো এপিটাফগুলো হারিয়ে যায়নি। ডিনস্টোন সিমেট্রিতে প্রবেশ করতে চাইলে নিতে হয় অনুমতি।
লংলা চা-বাগান সিমেট্রি
সিলেট বিভাগে টিকে থাকা টি প্ল্যান্টার্স সমাধিগুলোর মধ্যে সংখ্যায় মৌলভীবাজারে বেশি; যদিও সব কটি যে খুব যত্নে রয়েছে, তা নয়। কোনো কোনো উপজেলায় টিকে রয়েছে মাত্র একটি সমাধি; তা-ও আবার শায়িত ব্যক্তির পরিচয় জানা যায়নি। কুলাউড়া উপজেলার লংলা চা-বাগানে রয়েছে ২৮টি সমাধি। সমাধিস্থলটি কাঁটাতারে ঘেরা। চারদিকে রাবার বাগান, মাঝে সমাধিস্থলের পরিবেশ খুব মায়াময়। তবে কোনো কোনোটিতে থাকলেও সব সমাধিতে নেই এপিটাফ।
শমশের নগর সিমেট্রি
মৌলভীবাজারের শমশের নগর সিমেট্রিতে রয়েছে ১৮টি সমাধি। এর প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৫৮। ১৯৮৮ সালে করা হয়েছে পুনঃসংস্কার। সমাধির অবয়ব থাকলেও নামফলক নেই একটিরও। তবে একসময় নামফলক ছিল, সেটা বোঝা যায়। প্রতিটি সমাধির সামনের বাড়তি অংশে ছিল এপিটাফ; কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে না বলে বলা ভালো, হয়ে গেছে চুরি!
স্থানীয়দের দাবি, এখানে সমাধি ছিল প্রায় ২০০টি। সমাধিস্থলের চারদিকে বুনো ফুল আর ঝোপঝাড় জন্মেছে। পুরো স্থাপনাজুড়ে অবহেলার ছাপ স্পষ্ট। এর মাঝে একটি সমাধি লম্বায় বেশ বড়। প্ল্যান্টারদের গল্প যখন শুনেছি, তখন কিছু প্রচলিত গল্প ছিল এমন—সাহেবের ঘোড়াকেও নাকি সাহেবের পাশেই দেওয়া হয়েছিল কবর। লম্বা সমাধিটি দেখে আমার সে রকমই মনে হচ্ছিল।
বেগম খান সিমেট্রি
২৬ ব্রিটিশ নাগরিকের সমাধি রয়েছে হবিগঞ্জ জেলার এই সিমেট্রিতে। এরা সবাই চা-বাগানের কর্মকর্তা ছিলেন। এই সমাধিভূমি কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, জানা যায়নি। তবে সমাধিক্ষেত্রের একটি তালিকা থেকে জেনেছি, এখানে প্রথম সমাহিত করা হয় জেমস স্পেইড নামে এক কর্মকর্তাকে, ১৮৭৯ সালে। অবশ্য কালের ধুলোয় এপিটাফগুলো বেশ মলিন হয়ে গেছে। অনেকগুলোর লেখা পড়া যাচ্ছে না ঠিকমতো। দীর্ঘদিন নেওয়া হয়নি যত্ন। এ রকম একটি ঐতিহাসিক স্থানের সংরক্ষণ ও যত্নের প্রয়োজন, সে কথা বলা বাহুল্য। এখানকার কয়েকটি এপিটাফে রয়েছে নান্দনিক কারুকাজ। ফ্রেডরিক রোজ জোনসের সমাধিটি বেশ দৃষ্টিনন্দন। ১৯০৮ সালে মারা যান তিনি।
লালাখাল চা-বাগান সিমেট্রি
সিলেট জেলার জৈন্তাপুরের লালাখাল টি এস্টেটের ভেতরে থাকা সিমেট্রিতে সমাধি খুঁজে পেয়েছি একটি। সমাধিটি ২৫ বছরের এক ব্রিটিশ যুবকের, নাম ই এফ ডব্লিউ এলেন। ১৯০২ সালের ১৯ এপ্রিল লালাখালে গোসল করতে গিয়ে মারা যান তিনি।
ওই বাগানে প্রবেশের অনুমতি পেতে আমাকে সাহায্য করেছেন স্থানীয় সাংবাদিক সাব্বির। যাওয়ার রাস্তা বেশ দুর্গম। জৈন্তাপুরের ফেরিঘাট থেকে লালাখাল ছোট বাজার পর্যন্ত সিএনজিচালিত অটোরিকশা দিয়ে গেলাম। অটোরিকশাটি সেখানে রেখে নৌকায় সারি নদী পার হয়ে হেঁটে যেতে হবে নিশ্চিন্তপুর বটতলা বাজারে। সেখান থেকে লালাখাল ফ্যাক্টরির ভেতর দিয়ে বাঁশবাগানের কাছে গেলে দূর থেকে দেখা যায় সমাধিটি। অটোরিকশা রেখে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার হাঁটার পথ। এখানে একটিমাত্র সমাধি দেখে আমি অবাক হয়েছি। বাঁশবাগান দেখে মনে হয়েছে, আরও সমাধি থাকা সম্ভব। কারণ, ইংরেজদের দীর্ঘ শাসন পরিক্রমায় একটিমাত্র সমাধি থাকার কথা নয়। হয়তো বাকিগুলো হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে।
মণিপুর চা-বাগান সিমেট্রি
ফেঞ্চুগঞ্জের মণিপুর চা-বাগান বেশ পুরোনো। প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৬৩। এখানে কোনো সমাধি এখনো দৃশ্যমান রয়েছে কি না, সেই তথ্য পেতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। স্থানীয়দের শরণাপন্ন হলাম। তরুণ সাংবাদিক রোমেল আলী যোগাযোগ করিয়ে দিলেন সিনিয়র ও অভিজ্ঞদের সঙ্গে। রিয়াজ উদ্দিন যোগাযোগ করিয়ে দিলেন ইফতেখার মাহমুদ হেলিমের সঙ্গে। মণিপুর চা-বাগান সম্পর্কে বিশদ গবেষণা তার। শৈশবের বেশ কিছু সময় সেখানে কাটিয়েছেন। তিনি আমাকে লোকেশনসহ একটি সমাধির তথ্য দিলেন। সেখানে গিয়ে ইউপি মেম্বারের সহায়তায় আরও তিনটি সমাধির কথা জানলাম; কিন্তু সেগুলোর নাম-ঠিকানা কিছু পাইনি! যে সমাধির কথা হেলিম বলেছিলেন, সেটি রালফ ইগলটনের। ওই সমাধির অস্তিত্ব নেই এখন। যদিও হেলিম একসময় এপিটাফসহ সমাধিটি নিজে দেখেছিলেন, সেটি ১৯৭৮ সালের কথা। স্থানীয়রা বলছেন, কে বা কারা সমাধি খুঁড়ে অস্তিত্বহীন করে গেছে ঐতিহাসিক স্থানটি! এপিটাফের লেখাটি নাকি ছিল এ রকম: ‘হিয়ার স্লিপস ইন জিসাস রালফ ইগলটন রাইডসডেল’।
ফুলতলা টি এস্টেট
ফুলতলা টি এস্টেটের ভেতরে যে সিমেট্রি রয়েছে, সেটি আসলে সিমেট্রি নয় হয়তো। কারণ, সেখানে সমাধি রয়েছে মাত্র একটি। এক শিশুর। মৌলভীবাজারের জুড়ি উপজেলার এই চা-বাগানের প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৯৬। সেখানে ডিরেক্টরস বাংলোর ভেতর ওই সমাধির অবস্থান। আগে বাড়িটি আসলেই ডিরেক্টরস বাংলো ছিল কি না, নিশ্চিত হতে পারিনি। এপিটাফের লেখাগুলো একেবারেই অস্পষ্ট। পরিষ্কার করার পরও শিশুটির নাম কিংবা মৃত্যুতারিখ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বাগানের বর্তমান কর্মকর্তারাও জানাতে পারেননি তথ্য।
কাপনা পাহাড় চা-বাগান সিমেট্রি
জুড়ি উপজেলার আরেকটি সমাধির কথাও জেনেছি ‘টম্বস ইন টি’ বইটি থেকে। চা-বাগানের ভেতরে সমাধিটির কথা শুনলাম লোকমুখে। সেটির অস্তিত্ব এখন আর নেই। স্থানীয়রা বলছেন, এখানে বাগানের সাহেবের কবর ছিল; কিছু লোক সমাধি খুঁড়ে নিয়ে গেছে! কিন্তু কার সমাধি, কবে তিনি মারা গেছেন—কিছুই জানা যায়নি। কাপনা পাহাড়ে চা-শ্রমিকদের গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ প্রেমা চাষার সঙ্গে কথা হলো। বয়স আনুমানিক ১০৩। এখনো বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করেন। জানালেন, চা-বাগানের ভেতরে সাহেব আর বেগমের কবর ছিল। তারা এক রাতে পরস্পরকে গুলি করে মেরে ফেলেন! প্রেমা চাষার বয়স তখন ১৫।
রাজকী চা-বাগান সিমেট্রি
রাজকী চা-বাগানও জুড়ি উপজেলায়। এই বাগানের সমাধি সম্পর্কে জানতেও বেশ বেগ পেতে হলো। চা-শ্রমিকদের গ্রাম পার হয়ে, বেশ বড় একটি মাঠ পেরিয়ে উঁচু এক টিলার ওপরে সমাধি ছিল বলে দাবি গ্রামবাসীর। সেখানকার আদিবাসী নারী সিতা রানীর বয়স ৮৫। তিনি জানান, সাহেব আর সাহেবের ঘোড়াকে ওই উঁচু টিলায় দেওয়া হয়েছিল কবর।
এ রকম নাম না জানা অনেক টি প্ল্যান্টারের সমাধি রয়েছে সিলেট বিভাগজুড়ে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত এগুলোতে ভ্রমণ করেছি। এসব সমাধিভূমিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার এবং এগুলো নিয়ে যথাযোগ্য গবেষণার আহ্বান জানাই।
ছবি: লেখক