টেকসহি I হিউম্যান লাইব্রেরির হাল-হকিকত
‘একজন বুড়ো মানুষের মৃত্যু মানে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি পুড়ে যাওয়ার সমান’—এমন প্রবাদের প্রচলন রয়েছে রাশিয়ানদের মধ্যে। হ্যাঁ, একেকজন মানুষ জীবনের চলতি পথে অনেক অভিজ্ঞতা জড়ো করে যেন একেকটি আকরগ্রন্থ হয়ে ওঠে। সেই গ্রন্থপাঠের তৃষ্ণা মেটাতে দুনিয়াজুড়ে চালু হয়েছে এক নতুন উদ্যোগ
দূর্বা জাহান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় পড়তেন, শিল্পের ইতিহাস বিভাগে। এখন পড়ছেন জার্মানিতে। তিনি একজন হিউম্যান বুক। তাকে মানব বই, চলমান বই—যা খুশি বলা যেতে পারে, তবে তিনি বই, যাকে পড়তে পারে সবাই।
দূর্বা বই হয়ে উঠেছেন বেশ আগে। বাংলাদেশে থাকাকালে। হিউম্যান লাইব্রেরির সুবাদে। একদিন ফেসবুকে দেখেন, ঢাকায় এরা মানুষকে বই বানাচ্ছে, বই বানিয়ে পড়তে দিচ্ছে অন্যকে। আগ্রহী হয়ে রেজিস্ট্রেশন করে ফেলেন তিনি। বই বানানোর তরিকাটা হচ্ছে, আয়োজকদের কাছে গিয়ে গল্প বলতে হয়; তারা শুনে বোঝেন, সেই গল্প মানুষকে যুক্ত করতে পারবে কি না কোনো নয়া অভিজ্ঞতায়। সেই রকম মনে হলে তারা পাঠক আহ্বান করেন। একবারে কয়েকটা সেশন হয়, বেশ কয়েকজন ‘বই মানুষ’ থাকেন। তাদের গল্পের একটা সামারি থাকে। সেই সামারি শুনে শ্রোতা ঠিক করেন, কোন গল্পে তারা যুক্ত হবেন, কোন গল্পটা শুনবেন। সেখানে তারা গল্প শোনেন, গল্পটা নিয়ে নিজেদের মতো করে বলেন। নিজেদের গল্পও বলা হয়ে যায় কখনো কখনো সেশনে আসা মানুষদের কারও কারও।
দূর্বা বলছিলেন, ‘আমার দুটো গল্প ছিল। ছোটবেলা থেকে কীভাবে বড় হয়েছি, সেই স্ট্রাগলগুলোকে বড় হয়ে কেমন করে বোঝাপড়া করেছি, সেই গল্প। বাংলাদেশে সৌন্দর্যের প্রচলিত মাপকাঠিতে আমি ঠিক পড়তাম না! ফলে আমার মধ্যে একটা ভয় কাজ করত উজ্জ্বল রঙের পোশাক পরার ব্যাপারে। লোকের কাছ থেকে সব সময়ই শুনতে হতো, আমি সুন্দর না। যখন প্রথম প্রেমে পড়লাম, আমার মনে হতো, প্রেমিকটি আমাকে কখনোই ভালোবাসতে পারেনি। তার এই প্রেম আসলে মোহ! মনে হয়েছিল, আমি সুন্দর না, তাই সম্পর্কে এত জটিলতা।’
‘একটা বড় সময় অবধি আমার কোনো ছবি ছিল না। বড় হয়ে ধীরে ধীরে সিদ্ধান্তে এলাম, এসবে আসলে কিছুই যায় আসে না। নিজের বাবা-মায়ের ক্রোমোজম যেহেতু আমার কাছে, ফলে আমি আসলেই সুন্দর। চাকরি করার সময় এক কলিগ বলেছিলেন, আমার সঙ্গে কেউ ডেট করবে না। জবাবে বলেছিলাম, আমার ব্রেন আছে, সেটা কারও প্রয়োজন হলে করবে’ যোগ করেন দূর্বা।
তারপর একটু থেমে বলেন, ‘এরপর আমার বাবা খুন হন। তিনটা গুলি করা হয়েছিল তাকে। সেই গুলিবিদ্ধ লাশ দেখে মনে হয়েছিল, বাবাকে আমি কতটা বেশি ভালোবাসি।’
হিউম্যান লাইব্রেরিতে পাঁচটা সেশন করেছিলেন দূর্বা জাহান। বললেন, ‘প্রতিটা সেশনের পর প্রচন্ড ক্লান্তি লাগত। মনে হতো বিশাল কোনো বোঝা যেন নেমে গেল মাথা থেকে। আর শ্রোতারা এত মগ্ন হয়ে গল্প শুনতেন, মনে হতো এরা যেন আমার পরম আত্মীয়।’
হিউম্যান লাইব্রেরির গোড়াপত্তন ডেনমার্কেন কোপেনহেগেনে, ২০০০ সালে। রস্কিল্ডে ফেস্টিভ্যালের একটা প্রজেক্ট আকারে। শুরুতে এর সঙ্গে ছিলেন রনি এবেরগেল, তার ভাই ড্যানি, সতীর্থ আসমা মওনা আর ক্রিস্টোফার এরিকসন। এই লাইব্রেরির ধারণা এসেছিল, সমাজের মানুষেরা যেন সরাসরি একে অন্যের বোঝাপড়াগুলো বুঝতে পারে। যাতে ভাবতে পারে, অন্যেরও আবেগ আছে আমার মতো। আছে অনুভূতি। আছে যন্ত্রণা। মানুষ যেন নিজের বোঝাপড়া অন্যের বোঝাপড়ার ওপর চাপিয়ে না দেয়। এর উদ্দেশ্য ছিল, স্টেরিওটাইপ ভাঙা, এটাকে চ্যালেঞ্জ করা, ক্রস কালচার মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো, আর ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসা মানুষদের মধ্যকার সম্পর্ক বৃদ্ধি।
হিউম্যান লাইব্রেরি এখন জগৎজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আনজাজ সামওয়ান স্লোগানে তারা চালাচ্ছে কার্যক্রম বিশ্বের প্রায় সত্তরটি দেশে। ঢাকাতেও সেই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠা পায় এটি। সেখানে লোকেরা এসে নিজ নিজ ‘মানুষ বই’ পছন্দ করতে পারেন। প্রতিটা বই নিয়ে করতে পারেন আলাপ। আর প্রত্যেক মানুষই, তার উঠে আসা যেখান থেকেই হোক, শোনাতে পারেন নিজের গল্প। হিউম্যান লাইব্রেরিতে কাউকেই তার বৈশিষ্ট্য কিংবা আদর্শগত পরিচয়ের বিবেচনায় আলাদা করে দেখা হয় না।
ঢাকার ধানমন্ডিতে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে বসত হিউম্যান লাইব্রেরি। করোনা মহামারির বাস্তবতায় সেই কার্যক্রম এখন আপাতত থমকে রয়েছে। ভাইরাসটির প্রকোপ একটু কমে এলে আবারও ব্যতিক্রমী এ লাইব্রেরি ফিরবে চেনা রূপে। বাংলাদেশের হিউম্যান লাইব্রেরির যাবতীয় খোঁজ পাওয়ার জন্য রইল ফেসবুক পেজের ঠিকানা—https://www.facebook.com/humanlibrarybangladesh|
মীর হুযাইফা আল-মামদূহ
ছবি: শিহাব খান ও ইন্টারনেট