skip to Main Content

এডিটরস কলাম I তবু বই পড়ুন

জীবন যতই গতিশীল হোক, ব্যস্ততা কেড়ে নিক সময় ও মেজাজ, তবু মনোজগতে খোরাক দিতে বইয়ের দ্বারস্থ হই, চলুন

‘বইয়ের চেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু আর নেই,’ বলে গেছেন নোবেলজয়ী আমেরিকান সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। প্রকৃত অর্থেই যাপিত জীবনের নানা ক্লেদ থেকে নিজের মন ও মননকে বিশুদ্ধ করে তুলতে সত্যিকারের বন্ধুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় বই। তাই নিত্যসঙ্গী হিসেবে বইকে বেছে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। তবে পাঠের জন্য কোন বই বেছে নেবেন, সেটা একান্তই আপনার পাঠরুচির ওপর নির্ভর করছে। এ ক্ষেত্রে যে পাঠ্যপুস্তক নয়, বরং ‘আউট বুক’ বলে খ্যাত বইগুলোর কথা বোঝানো হচ্ছে, সে কথা বলা বাহুল্য। কেউ কেউ অবশ্য এ ধরনের বই বলতে রাশভারী লেখা সমৃদ্ধ পুস্তকের কথাই বুঝিয়ে থাকেন। আর তাতে মুশকিল হলো, ভারী বা গুরুগম্ভীর লেখা যদি আপনার পাঠরুচির সঙ্গে না মেলে, তাহলে বই পাঠে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন। তাই বলি, হোক ভারী কিংবা হালকা ধাঁচের লেখা—যে ধরনের বই-ই পড়তে মন চায়, তা বেছে নিন নিজের জন্য।

দুই
ইতিহাসে উঁকি দিয়ে দেখা যায়, প্রাচীনকালে মুখে মুখে বার্তা ছড়িয়ে দিত মানুষ। বিভিন্ন চিহ্নের সাহায্যে পাথরে খোদাই করে বার্তা প্রচারেরও ছিল রেওয়াজ। প্রায় সাত হাজার বছর আগে লেখা আবিষ্কারের পর আসে ব্যাপক বিবর্তন। জানা যায়, প্রাত্যহিক ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব রাখতে গিয়ে লেখার উদ্ভাবন ঘটায় প্রাচীনতম সভ্যতার সুমেরীয়রা। কিউনিফর্ম পদ্ধতিতে একধরনের মাটি দিয়ে বানানো ট্যাবলেটে লেখা হতো তখন। এর প্রায় হাজার বছর পর মিসরীয়দের আবিষ্কৃত প্যাপিরাস এনে দেয় যুগান্তকারী অগ্রগতি। তারও প্রায় হাজার বছর পর গিলগামাশ মহাকাব্য লিপিবদ্ধ ছিল প্রথম বই প্রকাশের ঘটনা। এরপর প্যাপিরাসের রোলের সঙ্গে কাঠ, বাঁশ, হাড়, পাথর, মাটি ও চামড়ায় লেখার চর্চা করে গ্রিক রোমানরা।
এদিকে, এশিয়ান অঞ্চলে লেখার প্রাথমিক উপকরণ ছিল তালের পাতা, বাঁশ ও পাথর। প্রথম কাগজ আবিষ্কারের গৌরব অর্জন করে চীনারা, ১০০ খ্রিস্টাব্দের পরে। কাগজে ছাপা প্রথম বই প্রকাশে সময় লেগে যায় আরও অর্ধশতাব্দী। তারপর দিনে দিনে ঘটে গেছে মহাবিপ্লব। এখন তো বছরে সারা বিশ্বে বিক্রি হয় প্রায় ৬০০ মিলিয়ন কপি বই। এবার বলি, প্রিয় পাঠক, এ বছর আপনি কয়টা বই কিনবেন বলে ঠিক করেছেন?

তিন
বই ঘিরে আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় উৎসব বসে ফেব্রুয়ারিতে। মাসজুড়ে আয়োজিত হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা। তা ছাড়া দেশের নানা প্রান্তেই রয়েছে বইয়ের দোকান। আর আধুনিক এ সময়ে বইয়ের অনলাইন শপগুলোও বেশ সক্রিয়। ঘরে বসেই হাতে পাওয়া যায় পছন্দের বই। অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে বই আপনাকে সীমাহীন জ্ঞানই এনে দেবে না শুধু, দেবে প্রশান্তিও। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যেকোনো ধরনের মানসিক চাপ কমিয়ে মস্তিষ্ককে ইতিবাচকভাবে সচল রাখতে বই রাখে দারুণ ভূমিকা। তা ছাড়া বই পাঠে আপনার শব্দভান্ডার বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি স্মৃতিশক্তিও হয়ে উঠবে সতেজ। নিজের বিকাশ ঘটানো, কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতা বাড়ানো, অন্যের অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিজ ভাবনা বিনিময় করে অন্তস্তলে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠা, নতুন বিষয় আবিষ্কার, অন্তরাত্মার পরিচর্যা—কত উপকারই না করে বই!

চার
চলছে একুশ শতক। আধুনিক প্রযুক্তির অকল্পনীয় উন্নয়নের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে কম-বেশি সবাইকে। চোখের পলকেই উড়ে যাচ্ছে সময় যেন কর্পূরের মতো, তবু একান্ত নিজের জন্য সময় বের করতে পারাটাই হয়ে উঠেছে ‘সময়ের ব্যাপার’—ভীষণ চ্যালেঞ্জের। তার ওপর হাতের মুঠোয় ডিজিটাল ডিভাইস, তাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানা সুযোগ-সুবিধা। ‘এতটুকু’ সময় পেলে উঁকি দিয়ে দেখে নেওয়া যাচ্ছে দুনিয়ার হাল-হকিকত। তাই বই পড়ার মতো সময় বের করতে পারা, কিংবা সেই অভ্যাসে নিজেকে নিয়োজিত করা বেশ দুরূহই, স্বীকার করি। অন্যদিকে, বইয়েরও এসেছে নতুন ফরম্যাট—ই-বুক, পিডিএফ ইত্যাদি। ছাপা বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। সেই সন্দেহকে একেবারে অমূলক ভেবে উড়িয়ে দেওয়ারও কিছু নেই। তবু মুদ্রিত বইয়ের ঘ্রাণ, বই ধরে দেখার অনুভূতির সঙ্গে বোধ করি তুলনা চলতে পারে না কোনো আধুনিক ডিভাইসের। তাই মুদ্রিত বইয়ের আবেদন কোনো দিনই ফুরাবে বলে মনে হয় না। ফুরানো উচিতও নয়!

পাঁচ
জীবন যতই গতিশীল হোক, ব্যস্ততা কেড়ে নিক সময় ও মেজাজ, তবু মনোজগতে খোরাক দিতে বইয়ের দ্বারস্থ হই, চলুন। কর্মচঞ্চল কার্যতালিকায় বই পড়ার জন্য বরাদ্দ রাখুন কিছুটা সময়। দেখবেন, বই-বন্ধুটি আপনাকে কখনো নিরাশ করবে না। এ প্রসঙ্গে চলুন ফেরা যাক আমেরিকান কবি এমিল ডিকিনসনের একটি বিখ্যাত কবিতার কাছে: ‘একটি বই খোলো/ আর তুমি পেয়ে যাবে/ সব ধরনের মানুষ আর স্থান;/ একটি বই খোলো/ আর তুমি হতে পারবে/ যা যা খুশি তুমি চাও;/ একটি বই খোলো/ আর তুমি ভাগ করে নিতে পারবে/ যে আশ্চর্য পৃথিবী ওখানে তুমি পেয়েছ…’ (অনুবাদ: মুম রহমান)।
বই পড়–ন। নিজের অন্তরমহলের যত্ন নিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top