সঙ্গানুষঙ্গ I লাভ ইন লিঙ্ক
নব্বইয়ের এই ট্রেন্ড আবার ফিরে এসেছে মূল স্রোতে। যার জোরে সাদাসিধে পোশাকেও তৈরি হচ্ছে স্টেটমেন্ট লুক। অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছেন সেলিব্রিটিরাও। লিখেছেন সারাহ্ দীনা
১৯৭০ সালে আইকনিক ডিজাইনার ডেভিড ওয়েব বলেছিলেন, স্টাইল থেকে চেইন কখনো বাদ পড়বে না। ৫০ বছরের বেশি সময় পার হয়েছে। মিলে গেছে ডেভিডের কথা। চেইন ফিরেছে ফ্যাশনে। সবাইকে চমকে দিয়ে। ভোগ ইউকে-এর ডিসেম্বর ২০২১ ইস্যুতে বিয়ন্সেকে দেখা গেছে ডায়মন্ড চেইন লিঙ্ক চোকারে। বিয়ন্সের বোল্ড এই ছবিতে চোখ পড়েছে ফ্যাশন-সচেতনদের। ফ্যাশন দুনিয়াতে হারিয়ে যাওয়া বলে কিছু নেই। ফিরে আসাটাই সত্য। চাঙ্কি চেইনে বিয়ন্সের বোল্ড লুক, সে কথা প্রমাণ করেছে আবারও। নব্বইয়ের দশকের ব্যান্ড সংগীতের জোয়ারে বিশ্ব যখন মাত, তখন রকস্টারদের স্টাইলিংয়ে দেখা গিয়েছিল চেইনের ব্যবহার। সেই শুরু। এরপরে ঘুরেফিরে আবার কি তবে এসেছে হেভি মেটাল লুক?
চেইনের সময় ফিরে আসার কারণ হিসেবে বলা যায়, এটি সব বয়সে মানানসই। আবার, সব বয়সের কাছেই গ্রহণযোগ্য। জেন্ডার নিউট্রাল অ্যাকসেসরিজ হিসেবেও এর কদর বিশ্বজোড়া। চেইনের প্রকারভেদ অনেক। নকশাভেদে আরবান থেকে ক্ল্যাসিক—দুই ধরনের ফ্যাশনের সঙ্গেই যা মানিয়ে যায়। এটি এমন এক জুয়েলারি পিস, যা বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। লাইট ওয়েটের কারণে লেয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে সুবিধা পাওয়া যায়। থিন থেকে থিক—বেছে নেওয়া যায় ইচ্ছা অনুযায়ী। আবার, এটি তেমন দুর্লভ না বলে হাতের নাগালে থাকা চেইনে মন চাইলেই স্টাইলিং সম্ভব নিজের মতো করে।
ফিরে আসা ফ্যাশনে চেইন লিঙ্ক জুয়েলারি শুধু নেকপিসের জন্য ডিজাইন করা হচ্ছে, এমন কিন্তু নয় আর বিষয়টি। এটি ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে ব্রেসলেট, কানের দুল, আংটি। এ বছরের ক্ল্যাসিক চেইন লিঙ্কে দেখা যাচ্ছে হীরা। টিফানি অ্যান্ড কোং নিয়ে এসেছে ডায়মন্ড ডটেড লিঙ্কড চাঙ্কি চেইন। এর বাইরে যুক্ত করা হচ্ছে এনামেল, স্টোন। চেইনকে মূল জুয়েলারি হিসেবে রেখে এর সঙ্গে অনুষঙ্গ যোগ করার চল এসেছে।
চিক সামার ট্রেন্ডে এ বছর চেইনের জয়জয়কার থাকবে বলে ধারণা করা যায়। কেননা, বিশ্বের জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলো ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করছে চেইন লিঙ্ক জুয়েলারি নিয়ে। জুয়েলারি ব্র্যান্ড ওয়াল্টারস ফেইথ চেইনকে তাদের সিগনেচার জুয়েলারি হিসেবে নিয়ে এসেছে। এর কারণ হিসেবে ব্র্যান্ডটির উদ্যোক্তা স্টেফাইন আব্রামো এবং মলি গুড জানান, বর্তমান সময়ের ক্যাজুয়াল ফ্যাশন লুক নিয়ে কাজ হচ্ছে বেশি। পোশাকে দেখা যাচ্ছে রিভিলিং ট্রেন্ড। ড্রেস ডাউন লুকের সঙ্গে চেইন জুয়েলারির জোড় দারুণ দেখায় বলেই তাদের ধারণা। সুপার সাইজড ওভাল শেপের স্যাক্সন লিঙ্কড চেইন তৈরি করেছেন তারা। ডেনিম বটম আর টি-শার্টের সঙ্গে নিজেরাই পরে নিয়েছেন এই জুয়েলারি।
এবারের সিজনের ফ্যাশন শোগুলোতে চেইন লিঙ্কের হাই ফ্যাশন অ্যাপিল নজর কেড়েছে। শ্যানেল, কোল, সেন্ট লরেন, সাকাইয়ের আয়োজনে দেখা গেছে চেইনের গয়না। লিঙ্কড চেইন গয়নাকে প্রাধান্য দিয়েছে এই ব্র্যান্ডগুলো। ফ্যাশনে যেহেতু নানান নকশার চেইন প্রচলিত, কোনটার স্টাইলিং কীভাবে হবে, সেটা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে স্টাইলিস্টদের। চেইনের নকশা আর আকার দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথাই বলছেন তারা।
স্মল চেইন নেকলেস
ডেইলিওয়্যার জুয়েলারিতে রাখা যেতে পারে স্মল চেইন নেকলেস, আবার এই চেইন ব্যবহৃত হতে পারে স্টেটমেন্ট জুয়েলারি হিসেবেও। ১৬ ইঞ্চি পর্যন্ত চেইন ব্যবহার করা যায় স্মল চেইন নেকলেস হিসেবে। যেকোনো ধরনের মেটালে তৈরি। স্বর্ণের চেইন ব্যবহার করতে চাইলে হোয়াইট, ইয়েলো অথবা রোজ গোল্ড শেড বেছে নেওয়া যেতে পারে। এখন বেশ চলছে এ ধরনের শেড। রিসাইকলড গোল্ডের চেইনের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে মানুষের।
মিডিয়াম চেইন নেকলেস
স্টেটমেন্ট জুয়েলারির সময় চলছে এখন। ক্যাজুয়াল পোশাকের সঙ্গে এ ধরনের জুয়েলারি পিস ব্যবহার করে ভিন্নতা আনা যায় লুকে। চেইন জুয়েলারি ব্যবহারে স্টেটমেন্ট স্টাইল তৈরি করতে চাইলে মিডিয়াম চেইন নেকলেস বেছে নেওয়া যেতে পারে। এ ধরনের গয়না যেহেতু অনেকটাই দৃশ্যমান হয়, কাজেই এখানে নকশা ও মানের সমন্বয় জরুরি। মিডিয়াম লেন্থ চেইনের ক্ষেত্রে ইন্টারলিঙ্ক কেমন, দেখে নিতে হবে প্রথমে। খেয়াল রাখতে হবে, চেইনে কেমন লক ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলো অ্যাডজাস্টেবল হলে ব্যবহার সহজ।
ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ডগুলো তৈরি করছে মিডিয়াম লেংথ চেইন নেকলেস। টিফানি অ্যান্ড কোং তৈরি করেছে গ্র্যাজুয়েটেড লিঙ্কড নেকলস। চোখে পড়ছে এনওয়াইসি ইন্সপায়ারড নেকলেসও।
লং চেইন নেকলেস
মিনিমালিস্ট কিন্তু ট্র্যাডিশনাল লুক চাইলে গয়নার বাক্সে একটা লং চেইন মাস্ট। ফ্যাশনে ফিরছে নব্বইয়ের প্রশস্ত নেকলাইনের পোশাক। এগুলোর সঙ্গে লম্বা চেইন নেকলেস দারুণ পেয়ার আপ হবে। লং চেইনের নকশার প্রকারভেদ অনেক। এর মাঝে গুরুত্ব দিতে হবে ব্যক্তিগত পছন্দ, কোন পোশাকের সঙ্গে পেয়ার আপ করা হবে কিংবা কোথায় যাবেন—এই বিষয়গুলো। আয়তক্ষেত্র নকশার চেইন লিঙ্ক নেকলেসও এবার জনপ্রিয়তা পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ডগুলো এ ধরনের চেইনের নকশা তৈরি করেছে দেদার।
চোকার চেইন নেকলেস
ধারণা করা হচ্ছে, নব্বইয়ের দশকের জুয়েলারি ফ্যাশনের মধ্যে চেইন চোকার এবার ফিরে আসবে বেশ জোরেশোরে। গর্জাস লুকের জন্য এক চেইন লিঙ্ক চোকারই যথেষ্ট। তাই এর চাহিদা বছরজুড়ে থাকবে বলা যায়। হালকা ওজনের চোকার স্বস্তি দেবে। চোকারে ফিনিশিংও গুরুত্বপূর্ণ। লাইট ওয়েট সোনালি রঙা ফিনিশের চোকার লিঙ্কের চল থাকবে এবার। নকশায়ও দেখা যাবে রকমফের। একই নকশা লিঙ্ক করে তৈরি চোকারের কাটতি বাড়বে। পাশাপাশি দুই রকমের বাকল লিঙ্ক করে বানানো চোকারও চলবে। এ ক্ষেত্রে হরাইজন্টালের সঙ্গে ভার্টিকেল যোগ করে নকশা হতে পারে। মাঝারি বাকলের নকশায় তৈরি নেকলেসই থাকবে ট্রেন্ড লিস্টের শীর্ষে।
হীরার দ্যুতি
লিঙ্কড চেইন নেকলেসের সঙ্গে দামি পাথর জুড়ে দেওয়ার চল বাড়বে এ বছর। সে ক্ষেত্রে ডায়মন্ড থাকবে তালিকার ওপরের দিকে। নেকলেসের পাশাপাশি চেইন ব্রেসলেট এবং ফিঙ্গার রিঙের সঙ্গে দেখা যাবে হীরার দ্যুতি। কখনো পুরোটাজুড়ে, কখনোবা অন-অ্যান্ড-অফ বাকলে।
সিলভার চেইন নেকলেস
চেইন নেকলেসে সোনালি আভার প্রতি আগ্রহ থাকবে অনেকের। এর পাশাপাশি রাজত্ব করবে রুপাও। সিলভার নেকলেসে মন মজবে ফ্যাশনিস্তাদের। সিলভার শেডের ক্ষেত্রে একটু ডাউন টোন বেশ চলবে। এসব ক্ষেত্রে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিনিশ পাবে প্রাধান্য। সোনালি-রুপালির আবেদন চিরন্তন। লিঙ্কড চেইন জুয়েলারিতে সেজে ওঠার ক্ষেত্রে এই দুয়ের পেয়ার-আপেও হবে স্টাইলিং।
এ তো গেল চেনাজানা নামের চেইন লিঙ্ক নেকলেসের গল্প। এর বাইরেও কিছু নকশা মাতিয়ে রাখবে ফ্যাশন জুয়েলারির দুনিয়া।
ক্যাবল চেইন
ইন্টারলক করে তৈরি হয় এটি। সঙ্গে থাকতে পারে পেনডেন্ট। তবে এ ক্ষেত্রে চেইন আর পেনডেন্টের আকারের সামঞ্জস্য থাকতে হবে।
স্নেক চেইন
সাপের মতো সর্পিল নকশার স্নেক চেইন নব্বইয়ের দশকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিল। এবারের ফ্যাশনিস্তাদের গয়নার বাক্সে এই জুয়েলারি জায়গা করে নেবে বলে ধারণা করা যায়। স্নেক চেইন নিজেই একটি স্টেটমেন্ট জুয়েলারি। এর সঙ্গে হালকা একটি পেনডেন্ট থাকতে পারে। ভারী কিছু এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
বার্ড কেইজ
চেইন নেকলেসে ডিটেইল সৃজনশীলতা দেখা যায় বার্ড কেইজ নেকলেসে। প্রতিটি লিঙ্ককে একটি আলাদা কেইজ হিসেবে ব্যবহার করে নকশা করার সুযোগ রয়েছে এখানে। দূর থেকে মনে হতে পারে সহজ নকশার অন্ত্যমিলে তৈরি একটি চেইন। তবে এর ক্ষুরধার সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে দেখতে হবে কাছ থেকে।
ফিগারো চেইন নেকলেস
ফিগারো চেইন নেকলেসে বড় ও ছোট—এই দুই ধরনের প্যাটার্নকে লিঙ্ক করা হয়। বেসিক নকশার সঙ্গে নান্দনিকতার পরিমিত মিশেলের ফলে ফরমাল ও ক্যাজুয়াল উভয় ধরনের পোশাকের সঙ্গে পরে নেওয়া যাবে।
ফিলেগ্রি চেইন নেকলেস
এগুলো লাইট ওয়েটের হয়ে থাকে। আলাদা আলাদা টুকরো একসঙ্গে করে তৈরি করা হয় এই চেইনের নকশা। বার্ড কেইজ ডিজাইনের সঙ্গে এর পরোক্ষ মিল রয়েছে। স্টেটমেন্ট জুয়েলারি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে অনায়াসে।
বল লিঙ্কড চেইন
একটির পর একটি বল যুক্ত করে তৈরি করা হয় বল লিঙ্কড চেইন। এখানে বলের আকার সাধারণত ছোট থেকে মাঝারি হয়ে থাকে। বল লিঙ্কড চেইন একটি ক্যাজুয়াল জুয়েলারি পিস। এটি ফরমাল পোশাকের সঙ্গে মানানসই নয়।
চেইন লিঙ্কড নেকলেস যেহেতু নানা প্রকারের, তাই কেনার আগে মাথায় রাখতে হবে কখন, কোথায় পরা হবে এই অ্যাকসেসরিজ। অফিসের নিয়ম মানা মিটিং, নাকি একান্ত সময় কাটানোর ডেটিং? পরা হবে কোন পোশাকের সঙ্গে, তা-ও বিবেচনায় রাখা জরুরি। শাড়ি, নাকি ইভনিং গাউন? নাকি বিয়ের উৎসবের জমকালো লেহেঙ্গা? এসবের বাইরে গিয়ে পাশ্চাত্যের পোশাকের সঙ্গেও পরা যেতে পারে চেইন লিঙ্কড নেকলেস। জুয়েলারির সঙ্গে আলো বেশ খানিকটা সম্পর্কযুক্ত। সূর্যের আলোতে উজ্জ্বল হীরার লিঙ্ক করা চেইন না পরে চাই ম্যাট কিছু। দ্যুতিময় উজ্জ্বলতা রাতের জন্য রেখে দেওয়াই ভালো।
চেইন লিঙ্ক জুয়েলারির সঙ্গে ব্রেসলেটও পরে নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, একই প্যাটার্নের তৈরি হলে ছন্দ তৈরি হবে। হাতে কয়েকটি ব্রেসলেট ব্যবহার করলে সেখানে বিভিন্ন নকশা থাকতে পারে। তবে আকারের দিক থেকে সব প্যাটার্ন কাছাকাছি হলে ভালো লাগবে।
পোশাক স্লিভ স্কিনি হলে ব্রেসলেট পরে নেওয়া চাই স্লিভের ওপরে। এ ক্ষেত্রে আঁটসাঁট স্লিভ হলে ভালো। এর ওপরে ব্রেসলেট বেশ মানিয়ে যাবে।
মডেল: আনসা
মেকওভার: পারসোনা
জুয়েলারি: ক্যানভাস
ছবি: তানভীর খান