skip to Main Content

স্বাদশেকড় I ফুচকা ফিরিস্তি

উপকথায় একে অমরত্বের খাবার বলা হয়েছে। এশিয়া মাইনরে জন্ম। উৎপত্তিগত দিক থেকে এটি লেফটওভার ফুড থেকে তৈরি বলে ধারণা প্রচলিত আছে। ফুচকা খেয়ে উপহাসের শিকার হওয়ার ঘটনাও কম নয়

ফুচকার সুলুক সন্ধান একটু জটিল। দিনক্ষণ তো জানা যায়ই না, তার ওপর রটে গেছে কিছু উপকথা। ফলে ফুচকার শিকড়ে যেতে হলে অনুমানের রথে না চড়ে উপায় নেই। সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ের সুযোগ কম। শুরু করা যেতে পারে মৌর্য সাম্রাজ্যে মেগাস্থিনিসের আগমনের ফিরিস্তি দিয়ে। প্রাচীন ভারতে লৌহ যুগের একটি সাম্রাজ্য ছিল মৌর্য। টিকে ছিল ৩২১ থেকে ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। মেগাস্থিনিস ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের এক পর্যটক ও ভূগোলবিদ। এশিয়া মাইনরে জন্ম। পরে সিরিয়ার রাজা সেলিয়াকাস ১-এর রাজদূত হিসেবে ভারতীয় রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের দরবারে দায়িত্ব পালন করেন। মেগাস্থিনিসের ভ্রমণবৃত্তান্ত মেলে ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে। তাতেই আছে সবচেয়ে পুরোনো ফুচকার বর্ণনা। চালে তৈরি ফুচকার উল্লেখ করে গেছেন মেগাস্থিনিস। সেই সূত্রে বলা যেতে পারে, বিশ্বে ফুচকার আবির্ভাব প্রায় ২ হাজার ১০০ বছর আগে। তবে সেটার বাহ্যিক রূপ যে এখনকার ফুচকার মতোই ছিল, তা হলফ করে বলা সম্ভব নয়।
ফুচকার উৎপত্তিতে আরও একটি বর্ণনা প্রচলিত আছে। কেউ কেউ একে ‘গ্রহণযোগ্য ও প্রমাণসাপেক্ষ ইতিহাস’ দাবি করেন। তা হলো, ফুচকার সূত্রপাত মহাভারতের দ্রৌপদীর হাতে। এই বর্ণনা অনুযায়ী খাবারটি মূলত লেফটওভার ফুড দিয়ে তৈরি। দ্রৌপদী বিয়ে করে আসার পর কুন্তি তাকে আগের রাতে অবশিষ্ট থাকা আলুর সবজি ও আটার মন্ড দিয়ে তার স্বামীর জন্য খাবার তৈরি করতে বলেছিলেন। দ্রৌপদী তখন আটা দিয়ে গোলাকৃতির একটি পাপড়ি তৈরি করেন। সেটির মধ্যে মসলা মাখানো সেদ্ধ আলুর পুর ভরে দেন। শেষে তেঁতুলের পানি দিয়ে পরিবেশন করেন। এটিকেই আদি ফুচকা বলে বিবেচনা করা হয়। দ্রৌপদীর তৈরি এ ধরনের খাবারকে কুন্তি অমরত্বের আশীর্বাদ দেন।
প্রাচীনে মগধের লোকেরা খাবারটিকে ‘ফুলকি’ বলে ডাকত। কালক্রমে তা ফুচকা নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। তা ছাড়া এটির অনেক প্রকরণ বেরোয়। এক অঞ্চলের ফুচকা আরেক অঞ্চলের সঙ্গে নামে ও আকৃতিতে না-ও মিলতে পারে। এমনকি উপকরণে ও স্বাদেও পৃথক। এই ফারাকের উৎপত্তি অনেক আগে থেকেই। দক্ষিণ বিহারে এটি পানিপুরি হিসেবে পরিচিতি পায়। এর উৎপত্তিস্থল অবশ্য বারানসি। সেখানে তৎকালীন বহুল প্রচলিত খাবার লুচিকে ছোট আকারে বানিয়ে তা শক্ত ও কুড়মুড়ে করে ভেজে খাওয়ার প্রচলন শুরু হয়েছিল। পরে মোগল ভারতীয়রা একে আরও ফিউশন করে। ফলে নিতান্ত সাধারণ লুচিই শেষে পরিণত হয় শক্ত ও মসলাদার পানিপুরিতে। গোলগাপ্পা নামেও পরিচিতি পায় এটি। সাধারণত পাকিস্তান, নয়াদিল্লি, জম্মু-কাশ্মীর, হরিয়ানা, ঝাড়খন্ড, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও হিমাচলের বাসিন্দারা একে গোলগাপ্পা বলে ডাকে। তামিলনাড়–র লোকেরা বলে পানিপুরি। মরু অঞ্চল রাজস্থানে খাবারটি পাতসি নামে পরিচিত। উত্তর প্রদেশেও তা-ই। তেলেঙ্গানা, ওডিশা, ছত্তিশগড়, হায়দরাবাদের অনেক অঞ্চলে খাবারটির ডাকনাম ‘গুপ চুপ’। তবে নেপালে ও শ্রীলঙ্কায় ফুচকাকে আদি নামে, মানে ফুলকি বলেই ডাকা হয়। আমাদের দেশে তা অবশ্য ফুচকাই।
নামে ভিন্নতার মতোই ফুচকা তৈরির উপকরণে পার্থক্য মেলে। মূল ফারাক থাকে পুর তৈরিতে। কোথাও আলু, সবজি ও স্যালাডের পুরে ঘুগনি কিংবা ডাবলি মিশিয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গে টকের পানি। কোথাও আবার ঝাল এড়িয়ে মিষ্টিজাতীয় পুর দিয়ে পরিবেশন করা হয় ফুচকা। সঙ্গে থাকে ধনেপাতার চাটনি, পুদিনা গোলা পানি, লেবু অথবা খেজুরের পানি।
ফুচকাকে দক্ষিণ এশীয় কুজিন হিসেবে ধরা হয়। বর্তমানে আমাদের দেশে খাবারটি বেশ জনপ্রিয় হলেও ১৯৪৭ সালের আগে বাংলাদেশে এর এত কদর ছিল না। এমনকি মানুষে মানুষে বৈষম্যও নিয়ে আসত এই খাবার। ফুচকা খেলে সেসব মানুষকে ‘ঘটি’ কিংবা ‘কেইশো’ নামে উপহাস করা হতো। তবে ভারত-পাকিস্তান আলাদা হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের অনেকে বাংলাদেশে চলে আসে। তখন এই বৈষম্য ও উপহাস উবে যায় এবং তারাই ফুচকাকে জনপ্রিয় করে তোলে। এমনকি তা এখন বাঙালির কুজিনে পাকাপাকিভাবে ঠাঁই করে নিয়েছে। বিশ্বমঞ্চে বাঙালির প্রতিনিধিত্ব করছে ফুচকা। মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার আসরে উঠেছে বাংলাদেশের হয়ে। ৩৮ বছর বয়সী কিশোয়ার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন মাস্টারশেফের আসরে। তিনি ফুচকা পরিবেশন করে বিচারকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন।
প্রেমের সঙ্গে ফুচকার বিশেষ যোগ আছে। যুগলের পথখাবার হিসেবে বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে এটি। চাহিদার কারণে ফুচকা প্রাপ্তিতে যোগ হয়েছে প্রযুক্তিও। গুজরাটে বিশেষ এক বুথ তৈরি হয়েছে, যেখান থেকে নোট নয়, বেরিয়ে আসে ফুচকা। টাকা ভরলেই তা থেকে বেরোয় পুর ভরা মসলাদার পানিপুরি! এমনকি কতগুলো ফুচকা চাই, তা বোতাম চেপে দিলেই বেরিয়ে আসবে এটিএম বুথ থেকে। মূলত করোনা মহামারিতে সামাজিক দূরত্ব এড়িয়ে ফুচকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতেই এই ধরনের মেশিনের উদ্ভাবন ঘটিয়েছিলেন সেই অঞ্চলের এক ব্যক্তি।

 ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top